Advertisement
E-Paper

আমরা তো মোটামুটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলায় পড়েছি

আমাদের দেশে জাতিভেদের কাঠামোটা খুব প্রাচীন। এখন, নীচের তলার মানুষের প্রতি উঁচু জাতের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটার মধ্যে তো আইডেন্টিটি বা সত্তার একটা প্রশ্ন আছে। এবং সেটা রক্ষণশীল হিন্দু আইডেন্টিটি।

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৭ ০০:২৮
অমর্ত্য সেন

অমর্ত্য সেন

প্রশ্ন: সম্প্রতি আপনি বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের সমাজে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা ঐতিহ্য আছে, ইদানীং এখানেও সাম্প্রদায়িকতার উপদ্রব ঘটছে কেন, খতিয়ে দেখা দরকার। এই প্রসঙ্গেই প্রশ্ন, সামগ্রিক ভাবে ভারতীয় সমাজেরও তো নিজস্ব কিছু শক্তি ছিল, জোরের জায়গা ছিল? আজ সেটা কেন এমন দুর্বল হয়ে গেল যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি দেশ জুড়ে এত প্রবল হয়ে উঠতে পারল? আমরা এই অবস্থায় এসে পৌঁছলাম কী করে?

অমর্ত্য সেন: আমার ধারণা, এই সম্ভাবনাটা ভারতে চিরকালই ছিল। আমাদের দেশে জাতিভেদের কাঠামোটা খুব প্রাচীন। এখন, নীচের তলার মানুষের প্রতি উঁচু জাতের যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটার মধ্যে তো আইডেন্টিটি বা সত্তার একটা প্রশ্ন আছে। এবং সেটা রক্ষণশীল হিন্দু আইডেন্টিটি। এই সত্তাটাকে বাকি সমাজের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা বরাবরই ছিল। গাঁধীজি এক ভাবে এই সমস্যাটার মোকাবিলা করতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলি, অরুন্ধতী রায় অম্বেডকরকে নিয়ে তাঁর একটি লেখায় এ ব্যাপারে গাঁধীর কঠোর সমালোচনা করেছেন। লেখাটি নানা দিক দিয়ে সুন্দর, কিন্তু অরুন্ধতীর গাঁধী-নিন্দাটি বোধ হয় ন্যায্য নয়। আমি মনে করি গাঁধী আসলে চেষ্টা করেছিলেন, কিছু কিছু ব্যাপারে উঁচু জাতের হিন্দুদের সঙ্গে আপস করে অন্য কিছু বিষয়ে সংস্কারে তাদের রাজি করাতে, যেমন জাতিভেদের তেজ কমানো, রিজার্ভেশন বা সংরক্ষণ চালু করা, এবং সর্বত্র ‘নিচু’ জাতের মানুষের প্রবেশাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আসলে গাঁধীর রাজনীতির জটিলতাটা বোঝা দরকার।

কী করে আমরা এত দিন সাম্প্রদায়িকতার বিপদটাকে অনেক দূর ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছি, এখানে তার একটা উত্তর আছে বলে আমি মনে করি। কেবল গাঁধী নন, আমরা কিছু ভাল নেতা পেয়েছি, যাঁরা বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে, কিছু কিছু আপস করে, ওই বিপদটার মোকাবিলা করেছেন। স্বাধীনতার পরেও বড়লোক এবং উঁচু জাতের হিন্দুদের মধ্যে একটা আঁতাঁতের সম্ভাবনা গোড়া থেকেই ছিল। এবং সেই আঁতাঁত থেকে অন্যদের সরিয়ে রাখার বা বিচ্ছিন্ন করার একটা আশঙ্কাও ছিল। রাজনৈতিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে, কিছু কিছু আপস করে, সেটা অনেক দিন ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল। কিন্তু উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রভাব বিস্তারের একটা তাগিদ বরাবরই ছিলই। এখন সেটাই অনেক বেশি উন্মুক্ত ও তেজী হয়েছে। হিন্দুত্বের রাজনীতিও মাথা চাড়া দিয়েছে এবং খোলাখুলি দেশবিজয়ের পর্যায়ে হাজির হয়েছে। উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া দেশের বাকি লোকেদের এতে ত্রাস বোধ করার সত্যিই কারণ আছে।

প্র: এখন কী করণীয়?

উ: এটা খুব দুঃখের কথা যে, আমরা এখানে এসে পৌঁছেছি। কিন্তু আমাদের মানতে হবে, আমরা এখানে পৌঁছেছি। এখন যে অবস্থা, সেটা তো মোটামুটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলায় পড়ে যাওয়া বলতে পারি। এখন যদি বলা হয় যে, এখানে থাকলে চলবে না, ওপরে উঠে সমতল, উর্বর জমি চাষ করতে হবে, সেটা খুবই ভাল কথা, কিন্তু আগে এই ক্যানিয়ন থেকে বেরোতে হবে তো!

প্র: কী ভাবে সেটা সম্ভব?

উ: ইতিহাসের দিক দিয়ে দেখলে সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না, আর ভবিষ্যতের দিক দিয়ে দেখলে কোনও সহজলভ্য সমাধান পাওয়া যায় না। অন্তত সে রকম কোনও সমাধান আমার জানা নেই। তবে ইতিহাসের কিছু শিক্ষা হয়তো আমরা নেওয়ার চেষ্টা করতে পারি।

বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকে ইটালিতে আন্তোনিয়ো গ্রামশির চিন্তাধারায় বিশেষ ভাবে অনুপ্রাণিত— তাঁর ছাত্রই বলা যায়— পিয়েরো স্রাফা, গ্রামশিকে দুটো জিনিস বলেছিলেন। স্রাফা, আমার মাস্টারমশাই, ছিলেন কেমব্রিজে, তাই তাঁর রাজনৈতিক বিশ্লেষণ আমার খুবই পরিচিত। তাঁর একটা বক্তব্য ছিল— যারা ফ্যাসিজমের বিরোধী, তাদের সঙ্গে একত্র হওয়া এখন কর্তব্য, অন্যান্য ব্যাপারে আমাদের মতবিরোধ থাকলেও। দ্বিতীয়ত, স্রাফা বললেন, যে জিনিসটা ‘আমরা মার্ক্সিস্টরা’ তুলনায় তুচ্ছ বলে মনে করেছি, যেমন পার্সোনাল লিবার্টি বা ব্যক্তিগত স্বাধিকার, সেগুলো ফ্যাসিজমের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। সেগুলোকে রক্ষা করা আমাদের প্রধান কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। যদিও এটা শ্রেণিসংগ্রামের ছকে বাঁধা নয়, কিন্তু এই মুহূর্তে শ্রমিক শ্রেণির সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হচ্ছে পার্সোনাল লিবার্টি— ব্যক্তিগত স্বাধিকার। স্রাফার বক্তব্যগুলো গ্রামশি তখন মানলেন না। তিনি বললেন, স্রাফা সূক্ষ্ম চিন্তায় সক্ষম হলেও এ ক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাধারা বুর্জোয়া। কমিউনিস্ট পার্টি তখন বৃহত্তর ঐক্যের পথ স্বীকার করল না। কিন্তু তার পরে যখন ফ্যাসিবাদ প্রবল হয়ে উঠল, তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরি হল, সেই প্রতিরোধে বিভিন্ন বিরোধী শক্তি এক হল, কমিউনিস্টরাও তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এবং এর পরে সেই সম্মিলিত প্রতিরোধ আরও অনেকটা অগ্রসর হল, ইউরোপের দেশগুলির অভ্যন্তরেই কেবল নয়, তাদের পরস্পরের মধ্যে একটা সংহতি নির্মাণে উদ্যোগী হলেন ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের কিছু বামপন্থী নেতা। অর্থাৎ, প্রথমে কমিউনিস্টদের অবস্থানটা ছিল: শ্রেণিযুদ্ধ ছাড়া কিছু চলবে না। তার পরে দাঁড়াল: শ্রেণিযুদ্ধ মাথায় রেখেও এখন ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে ইটালিতে। তার পরে বলা হল: ফ্যাসিবাদের এ রকম উত্থান যাতে আর না হয়, সে জন্য ইউরোপে আমাদের সমবেত ভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, যে সূত্রে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গোড়াপত্তন হল।

সমন্বয়: নানা বিরোধী দলের নেতারা সমবেত হয়েছেন রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মীরা কুমারের নাম ঘোষণা করতে। দিল্লি, জুন ২০১৭। ছবি: পিটিআই

প্র: এখন ভারতে সেই রকম একটা কোয়ালিশন তৈরির প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?

উ: হিন্দুত্বের বিভেদসৃষ্টিকে রাজনীতিতে প্রতিরোধ করা এখন খুবই প্রয়োজনীয়। তার জন্যে রাজনীতির বিভিন্ন মহলের কর্মীদের পরস্পর হাত মেলানো দরকার। কোয়ালিশন মানে এই নয় যে, সেটা সব সময় সুস্থির থাকবে। তার মধ্যে নানা রকম দ্বন্দ্ব থাকতে পারে, বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন শরিকের মতের অমিল থাকতেই পারে, কিন্তু যে লক্ষ্যটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তার কথা মাথায় রেখে নানা রকম মতভেদকে মানিয়ে চলতে হবে। কী ভাবে সেই সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটাও বিচারবিবেচনা করা দরকার। দুটো দল পরস্পর হাত মেলাচ্ছে, এ ভাবে বললে হয়তো সমস্যা হতে পারে, কিন্তু কোনও কোনও বিষয়ে তারা একমত হয়েছে, এটা বলতে সেই সমস্যা হবে না। এটাই সুচিন্তিত স্ট্র্যাটেজির প্রশ্ন।

প্র: সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বার্থে অন্য নানা প্রশ্নে, যেমন দুর্নীতির প্রশ্নে আপসের প্রয়োজন হতে পারে...

উ: সেই প্রশ্ন আছে, নিশ্চয়ই। যেমন, এটা তো ঠিকই যে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে একজোট হতে গেলে লালুপ্রসাদকে সঙ্গে না নিলে চলবে না। দুর্নীতির সম্ভাবনার দিক থেকে দেখলে সেটা বাঞ্ছনীয় না-ও হতে পারে, কারণ তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অতীতে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তাঁর মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা-বিরোধী যে শক্তি আছে— এবং যেটা ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম বলেই মনে হয়— হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে যে, দুর্নীতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা ভারতের রাজনীতিতে আশ্চর্য রকমের বেশি, এবং দুর্নীতির অভিযোগে এখন বেছে বেছে বিজেপি-বিরোধীদেরই ধরা হচ্ছে, যে যত বিরোধী তাকে তত বেশি ধরা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দুর্নীতির প্রশ্নটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে কি না।

প্র: নীতীশ কুমার কী করবেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

উ: নীতীশ কুমার কিন্তু বলেননি যে, লালুপ্রসাদের ছেলেকে পদত্যাগ করতেই হবে। এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যম একটু ভুল বলছে। নীতীশ বলছেন, হয় তেজস্বীকে পদত্যাগ করতে হবে, নয়তো তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর জবাব দিতে হবে, কেবল ‘আমাদের হেনস্তা করা হচ্ছে’ বললে চলবে না। নীতীশ বুদ্ধিমান, নীতিমান লোক, তিনি বিজেপির দিকে চলে যাবেন বলে আমার মনে হয় না। তিনি জানেন, সে ক্ষেত্রে বিজেপি এখন যা-ই বলুক না কেন, পরে ধূলিসাৎ করে দেবে। তাই আমার মনে হয়, তিনি— দুর্নীতির প্রশ্নটা তুলেও— লালুপ্রসাদের সঙ্গে থাকার চেষ্টা যথাসম্ভব করবেন। তবে প্রশ্নটা কেবল নীতীশ কুমারকে নিয়ে নয়, সামগ্রিক ভাবে বিরোধী দলগুলো কী করতে পারে ও তা যথেষ্ট করছে কি না, সেটাই ভাবা দরকার।

প্র: উপরাষ্ট্রপতি পদের প্রার্থী হিসেবে বিরোধীরা গোপালকৃষ্ণ গাঁধীকে বেছে নিয়েছে, রাষ্ট্রপতি পদের জন্যই তো এটা করতে পারত...

উ: আমি তো অনেক দিন ধরেই বলার চেষ্টা করছি যে, বিরোধী দলগুলির পক্ষ থেকে গোপাল গাঁধী রাষ্ট্রপতি পদের জন্য সবার সম্মতিতে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু কংগ্রেসি কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করলেন, ‘বিজেপি আগে নিজের প্রার্থী স্থির করুক, তার পরে আমরা আমাদের পছন্দটা জানাব’ এব‌ং ‘ওরা দলিত প্রার্থী দিলে আমরাও দলিত প্রার্থী দেব’ ইত্যাদি। এই ট্যাকটিকসর্বস্ব চিন্তাধারা শুধু ন্যায়বিরোধী নয়, এতে সাফল্যের সম্ভাবনাও খুবই কম। হিন্দুত্বের সঙ্গে লড়াইয়ে ন্যায়ের দিকে জোর দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজি তৈরি করাও খুবই প্রয়োজন।

প্র: আপনি বলেছেন, বিরোধীদের যথাযথ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে ভাবতে হবে, শুধু ট্যাকটিক দিয়ে তারা বিজেপির সঙ্গে এঁটে উঠতে পারবে না। এই সূত্রে একটা প্রশ্ন। এ দেশে শিক্ষা স্বাস্থ্য পুষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে এনটাইটলমেন্ট বা স্বত্বাধিকারের দাবি, স্বত্বাধিকারের বৈষম্য দূর করার দাবি নিয়ে আন্দোলন এখন খুব স্তিমিত। সেই আন্দোলনটা জোরদার করে তুলতে পারলে কি সাম্প্রদায়িকতার মোকাবিলা তুলনায় শক্তি পাবে?

উ: বর্তমান প্রেক্ষিতে এমন কোনও অবস্থানের কথা আমরা ভাবতে পারি না, যেখানে কোনও রকমের ‘টেনশন’ নেই, টানাপড়েন নেই। বিভিন্ন ধরনের স্বত্বাধিকারের ক্ষেত্রে এ দেশে অসাম্য, অন্যায্যতা তো খুব বেশিই, এবং তা বেড়েই চলেছে। অসাম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পাশাপাশি সবার— এবং সব জাতির, সব সম্প্রদায়ের— সামগ্রিক উন্নতির কথাও একসঙ্গে ভাবা সম্ভব। এতে কোনও বিরোধ নেই।

প্র: আপনি গত শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে এ বিষয়ে ক্রমাগত আমাদের সচেতন করে এসেছেন...

উ: আমাকে অনেকেই প্রশ্ন করেন, আমি এত কাল ধরে একই কথা বার বার বলি কেন। আমার উত্তর হল, সমস্যাটা এত কাল ধরে এক থেকে গেলে আমার কথাটাই বা পালটায় কী করে! এখন, এই দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাগুলোর মোকাবিলা করা নিশ্চয়ই দরকার। কিন্তু তার ওপর নতুন সাম্প্রদায়িক সংকট আবির্ভূত হয়েছে। যে হিন্দুত্ববাদী শক্তি এখন দেশ চালাচ্ছে, তাদের যদি না সরানো যায়, তা হলে ওই অসাম্য বা অন্যায্যতার সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করা আরও কঠিন হয়ে যাবে, তখন এ ব্যাপারে কিছু করা অসম্ভব রকম কঠিন হবে। বিজেপির মতো পার্টিকে নিয়ে এই ভয়টা খুব বেশি। পুরনো স্বতন্ত্র পার্টি যদি হত, তা হলে এই ভয়টা ততটা থাকত না— গণতন্ত্রের পথে তাদের মোকাবিলা করা যেত। কিন্তু বিজেপি তো সে ভাবে চলে না, তারা আরএসএসের আদর্শ মেনে সব কিছু নিজেদের দখলে আনতে চায়। তারা সব জায়গায় নিজের লোক বসাবে, আইনগুলো বদলে দেবে, ক্রমশ বিচারব্যবস্থাকেও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করবে এবং নতুন বিচারকদের গদিতে বসাবে।

প্র: গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য যে প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, সেগুলোকে ক্রমশ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনবে।

উ: যে প্রতিষ্ঠানগুলো থাকলে অসাম্য, অনৈক্য, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে যুদ্ধটা চলতে পারে, হিন্দুত্বের রাজনীতি সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে তুলে দিতে চায়, এ রকম মনে করার সত্যিই কারণ আছে। এই দিক থেকে দেখলে, অসাম্য, অনৈক্য, অন্যায্যতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষ করে বাম দলগুলির ভাবা দরকার যে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য সেই শক্তির বিরোধীরা যদি একজোট হয়, সেটা বামপন্থী চিন্তাধারা থেকে সরে যাওয়া নয়, বরং তা সেই চিন্তাকে কার্যকর হতেই সাহায্য করবে।

প্র: সাম্প্রদায়িকতা তো বামপন্থী আদর্শের অন্যতম প্রধান শত্রু, কারণ শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সে কেবল ভেদাভেদ সৃষ্টি করে না, অত্যন্ত কুৎসিত, নিষ্ঠুর এবং হিংস্র ভেদাভেদ সৃষ্টি করে।

উ: এখানে বাংলাদেশের কথাটা খুব প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। সেখানে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে বিরাট লড়াই চলছে। যাঁরা সেই লড়াই করছেন, তাঁরা প্রচণ্ড সমস্যা এবং আক্রমণের শিকার হয়েও মাথা নত করেননি। সেখানকার মানুষ যে এই লড়াইটা করতে পারছেন, তার কতকগুলো কারণ আছে। এক, দেশভাগের সময় একটা ব্যাপার হয়েছিল। বেশির ভাগ জমিদার হিন্দু ছিলেন, তাঁরা পালিয়ে গেলেন, ফলে বিনা যুদ্ধে একটা ভূমি সংস্কার হয়ে গেল, যেটা আর্থিক ভেদাভেদ অনেকটা কমিয়ে দিল এবং তার ফলে সমবেত আন্দোলন গড়ে তোলা তুলনায় সহজ হল। দুই, বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনে সমাজের নানা দিক থেকে বহু মানুষ একসঙ্গে যোগ দিলেন, এর ফলে পরবর্তী কালে শিক্ষা বা স্বাস্থ্যের মতো নানা ক্ষেত্রে সামাজিক অগ্রগতি সহজ হল। বিশেষ করে মেয়েদের ভূমিকা অনেক জোরদার হতে পারল। বিভিন্ন সামাজিক মাপকাঠিতে বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়ে এগিয়ে, এর পিছনে অনেকে মিলে কাজ করার এই ধারাটি খুব বড় ভূমিকা নিয়েছে। এবং এটাই আবার বিভিন্ন স্তরের মানুষকে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে একজোট হতে সাহায্য করেছে। এ থেকে আমাদের অবশ্যই শিক্ষা নেওয়া জরুরি। এবং আমার ধারণা, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে যে সংহতি গড়ে তুলতে পারি, সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি থেকে লোক থাকবেন, তাতে বামপন্থীদের মধ্যে চ্যাটার্জি, ব্যানার্জি, বসু, সেন’দের যে দাপট, সেটাও হয়তো কিছুটা ভাঙবে।

সাক্ষাৎকার: অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ও কুমার রাণা

Amartya Sen Interview Celebrity Celebrity Interview Contemporary Issues অমর্ত্য সেন
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy