Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

আঁধার থেকে লাফ দিক শান্তির সকাল

তিনি অনেকের অচেনা, কারণ নিভৃতে নিজের কাজ করতেন। বিদায় নিলেন ইতিহাসবিদ অমলেন্দু গুহ (১৯২৪-২০১৫)।গত ৭ মে বিদায় নিলেন অমলেন্দু গুহ। উত্তর-পূর্ব ভারত, বিশেষত অসমের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক অসামান্য মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তাঁর ইতিহাস গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই যে বইটির কথা আসে, তা হল, প্লান্টার-রাজ টু স্বরাজ: ফ্রিডম স্ট্রাগ্‌ল অ্যান্ড ইলেকটোরাল পলিটিক্স ইন অ্যাসাম ১৮২৬-১৯৪৭।

সিদ্ধার্থ গুহ রায়
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

গত ৭ মে বিদায় নিলেন অমলেন্দু গুহ। উত্তর-পূর্ব ভারত, বিশেষত অসমের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে এক অসামান্য মাত্রা যোগ করেছিলেন তিনি। মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত তাঁর ছিল স্বচ্ছন্দ বিচরণ। তাঁর ইতিহাস গবেষণা নিয়ে আলোচনা করতে হলে প্রথমেই যে বইটির কথা আসে, তা হল, প্লান্টার-রাজ টু স্বরাজ: ফ্রিডম স্ট্রাগ্‌ল অ্যান্ড ইলেকটোরাল পলিটিক্স ইন অ্যাসাম ১৮২৬-১৯৪৭। একটি প্রদেশের ওপর এ ধরনের পূর্ণাঙ্গ, তথ্যসমৃদ্ধ, প্রামাণ্য গ্রন্থ বিরল।

অসমের রাজনৈতিক বিকাশের প্রেক্ষিতে প্রাদেশিক আইনসভার বিবর্তনের ইতিহাস আলোচনা করেছেন অমলেন্দুবাবু, তুলে ধরেছেন ঔপনিবেশিক আর্থ-সামাজিক কাঠামোর প্রেক্ষাপট, অসমে আইনসভার ভিতরে ও বাইরে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী রাজনীতির আবর্তনের নিপুণ বিশ্লেষণ, অর্থনৈতিক দাবি ও রাজনৈতিক ধারণা অসমের জাতীয় আন্দোলনকে কী ভাবে নিয়ন্ত্রিত করে, তার যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা। আর এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছিল কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি দেখিয়েছেন, অসমের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনও একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একক কর্মকাণ্ড নয়, অসংখ্য উপাদান ও ধারা-উপধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছিল সাম্রাজবাদ-বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। স্থানীয় মহাফেজখানা থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত সংগ্রহ, অসমিয়া সাহিত্য, সমস্ত কিছুর সাহায্য নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা বইটি তথ্যসমৃদ্ধ, কিন্তু তথ্যভারাক্রান্ত নয়।

উপসংহারে তাঁর বক্তব্য: জাতীয়তাবাদের গতিপথ সর্বত্র দু’টি ধারায় অগ্রসর হয়েছে: গোটা ভারতের ঐক্য সংক্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ‘বৃহৎ জাতীয়তাবাদ’ (গ্রেট ন্যাশনালিজ্‌ম), এবং আঞ্চলিক দাবিদাওয়া ও ভাষাগত ঐক্যের ভিত্তিতে নির্মিত ‘ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ’ (লিট্‌ল ন্যাশনালিজ্‌ম)। প্রথমটি বরাবর ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেছে। দ্বিতীয়টি ছোট বুর্জোয়া শ্রেণির, বিশেষত আঞ্চলিক মধ্যবিত্ত শ্রেণির স্বার্থরক্ষার সঙ্গে জড়িত। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এবং ঐক্যের মধ্যে বৈচিত্র— ভারতের ইতিহাসে দুটো ধারাই সমান গুরুত্ব বহন করে এসেছে। আজও কাশ্মীর বা উত্তর-পূর্ব ভারতের সমস্যা আলোচনা করতে গিয়ে দেখি, ভারতীয় শাসকরা দ্বিতীয় ধারাটিকে গুরুত্ব দিতে চাননি। উল্লেখ্য, অসমের জাতীয়তাবাদী নেতা তরুণরাম ফুকন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে অসমের মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে শামিল করেছিলেন। ১৯৭৭-এ তাঁর শতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের ইতিহাস গবেষণা পরিষদ অমলেন্দুবাবুর বইটি প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়।

তপন রায়চৌধুরী ও ইরফান হাবিব সম্পাদিত দ্য কেমব্রিজ ইকনমিক হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া-র প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৯৮২ সালে। তাতে অমলেন্দু গুহ রচিত ‘দ্য মেডিয়িভল ইকনমি অব অ্যাসাম’ প্রবন্ধে দেখি, মধ্যযুগীয় অসমের অর্থনীতি প্রসঙ্গে ধান-নির্ভর অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের ভূমিকা, ধান উৎপাদনে প্রযুক্তির ব্যবহার, পতিত জমিতে কৃষির সম্প্রসারণ, কিছুই তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। জাতপাত, শ্রম বিভাজন, মধ্যযুগীয় অসমের সমাজে পরিবেশের প্রভাব, বাণিজ্য ও হস্তশিল্প, এ সবও তাঁর গবেষণায় স্থান পেয়েছে। তাঁর লেখা মধ্যযুগীয় ও প্রথম দিকের ঔপনিবেশিক যুগের অসমের এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ১৯৯১ সালে মেডিয়িভল অ্যান্ড আর্লি কলোনিয়াল অ্যাসাম: সোসাইটি, পলিটি, ইকনমি নামে প্রকাশিত হয়।

তাঁর পাণ্ডিত্য ও উৎসাহের ব্যাপ্তি ছিল বিরাট। ঔপনিবেশিক ভারতে বৃহৎ বুর্জোয়া শ্রেণির ভূমিকা, রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা, বিশেষত ভারতীয় পুঁজিপতি শ্রেণির চরিত্র নিয়ে গবেষণাঋদ্ধ বিতর্কে যোগ দিয়েছেন অমলেন্দু গুহ। পশ্চিম ভারতে পুঁজিবাদের বিকাশে পার্সিদের ভূমিকা নিয়েও প্রবন্ধ লিখেছেন। (ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি, ২৯ অগস্ট, ১৯৭০) ইতিহাস ও সমাজবিজ্ঞান চর্চার বাইরে তিনি ছিলেন এক জন কবি। তাঁর লুইত পারের গাথা কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে।

এখন ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীদের কাছে অমলেন্দুবাবু খুব পরিচিত নয়। এর প্রধান কারণ, তিনি ছিলেন আদ্যন্ত প্রচারবিমুখ, নিভৃতে একনিষ্ঠ গবেষণায় রত। প্রথম জীবনে তিনি অসমের দারাং কলেজে শিক্ষকতা করেন। আপসহীন বামপন্থী, ১৯৬২’র চিন-ভারত যুদ্ধের সময় গ্রেফতারি পরোয়ানা এড়িয়ে অসম ছাড়তে বাধ্য হন। পরে ভারত রক্ষা আইনে গ্রেফতার হন। মুক্ত হয়ে মন দেন সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাস চর্চায়। পুণের গোখলে ইনস্টিটিউট ফর সোশ্যাল স্টাডিজ ও কলকাতার সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ গবেষণায় যুক্ত ছিলেন। ১৯৮০-র দশকের গোড়ায় সেন্টারে গবেষণা করার সুযোগ পাওয়ার পরই আমার জীবনের এই শ্রেষ্ঠ শিক্ষকের সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য, তিনি ছিলেন আমার পিএইচ ডি গবেষণার সুপারভাইজার। কমপক্ষে দশ বছর ছাত্র হিসেবে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার সুযোগ হয়। তিনি শিখিয়েছিলেন ইতিহাস চর্চার কৃৎকৌশল, তথ্য বিশ্লেষণের পদ্ধতি। বাড়তি পাওনা ছিল অকৃত্রিম স্নেহ। অনেক সময় তাঁর সঙ্গে একমত না হতে পারার ধৃষ্টতা দেখিয়েছি, কিন্তু তিনি কখনওই তাঁর মত আমার ওপর চাপিয়ে দেননি, বরং গবেষণার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গের সারস্বত সমাজে তাঁর কোনও নিন্দুক ছিল না। তিনি যে ইতিহাসবিদের বক্তব্যের কঠোর সমালোচক, তাঁর সঙ্গেও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল সৌজন্যের। কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পরে এঙ্গেলস বলেছিলেন, তাঁর অসংখ্য রাজনৈতিক বিরোধী ছিল, এক জনও ব্যক্তিগত শত্রু ছিল না। একনিষ্ঠ মার্কসবাদী অমলেন্দুবাবুকে হয়তো মার্কসের চরিত্রের এই দিকটি প্রভাবিত করেছিল।

দীর্ঘদিন কলকাতায় চাকরি করলেও তাঁর শিকড় ছিল অসমেই। অবসরের পর নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় গুয়াহাটি চলে যান। বছর তিনেক আগে সেখানে দেখেছি তাঁর ও তাঁর স্ত্রী অণিমা দেবীর বিপুল জনপ্রিয়তা। পেশায় নৃতত্ত্ববিদ অণিমাদেবী সমাজকর্মী হিসেবে সুপরিচিত।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ও গণপ্রজাতন্ত্রী চিনের খোলাখুলি পুঁজিবাদী পথ গ্রহণ মার্ক্সবাদে বিশ্বাসীদের কাছে সুখবর ছিল না। কিন্তু এই কঠিন সময়েও অমলেন্দুবাবু তাঁর মতাদর্শ বা বিশ্বাস থেকে বিচ্যুত হননি, যদিও সমসাময়িক অনেক তথাকথিত বামপন্থী কার্যকলাপের তিনি ছিলেন কঠোর অথচ সংবেদনশীল সমালোচক। বামপন্থীদের গতিপ্রকৃতি শেষ জীবনে হয়তো তাঁকে ব্যথিত করেছিল। নন্দীগ্রামে গুলিচালনার সমালোচনায় কুণ্ঠিত হননি তিনি।

কবি অমলেন্দু গুহ লিখেছিলেন, ‘লুইতের পাড়ে পাড়ে আজ রাতে গান গাই এসো/ বারুদের ঋতু শেষে এল ফুল ফোটানোর কাল!/ যে গানে উতলা হোক মিসিসিপি,/ হোয়াংহোর ঢেউ,/ সে গানে আঁধার থেকে লাফ দিক শান্তির সকাল।’

সেই শান্তির সকালের প্রত্যাশায় রইলাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE