Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

জমি যখন কালো ধন

বেনামি জমি কালো টাকা লুকনোর একটা প্রধান উপায়, সন্দেহ নেই। সেখানে স্বচ্ছতা আসবে কী করে? সম্প্রতি তা নিয়ে এক কৌতুকনাট্য হয়ে গেল।

অশোক সরকার
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

কালো টাকায় লাগাম দিতে গত বছর নভেম্বরে পাঁচশো, হাজার টাকার নোট বাতিল করেন প্রধানমন্ত্রী। আপত্তি উঠেছিল, কালো টাকার অতি সামান্যই নোটে জমিয়ে রাখেন ধনীরা। অধিকাংশ থাকে জমি, সোনা, শেয়ারে।

বেনামি জমি কালো টাকা লুকনোর একটা প্রধান উপায়, সন্দেহ নেই। সেখানে স্বচ্ছতা আসবে কী করে? সম্প্রতি তা নিয়ে এক কৌতুকনাট্য হয়ে গেল। কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট সচিবালয় থেকে সব রাজ্যের মুখ্য সচিবের উদ্দেশে ‘নির্দেশ’ বের হল: জমির সব নথিপত্র ডিজিট্যাল করতে হবে, তার সঙ্গে জমির মালিকের আধার কার্ডের সংযোগ থাকতে হবে। তা নিয়ে হইচই পড়তেই সরকারি বিজ্ঞপ্তি বেরোল, ওই চিঠি জাল।

কে ভুয়ো নির্দেশ দিল, এখনও খুঁজছে পুলিশ। কিন্তু আমাদের উত্তর খুঁজতে হবে, জমির মালিকানায় স্বচ্ছতা আনা যায় কী করে? আধার কার্ডের ব্যবহার কি সত্যিই বেনামি জমি কমাতে পারে? না হলে আর কী উপায় আছে?

জমির তিনটি সরকারি কাগজ আছে। এক, মানচিত্র বা ম্যাপ, যাতে জমির সীমানা, নম্বর, চরিত্র পাওয়া যায়। দুই, জমির রেকর্ড (যার কপিকে বলা হয় পরচা), যাতে জমির বিষয়ে নানা তথ্য ছাড়াও বলা আছে জমি কার দখলে। তিন, দলিল, যা মূলত জমির কেনাবেচার প্রমাণ। জমির নথিপত্রে অস্বচ্ছতার প্রধান কারণ— ম্যাপ, রেকর্ড আর দলিল রেজিস্ট্রি, এই তিনটি নথি তৈরি করে তিনটি আলাদা কর্তৃপক্ষ। রেকর্ড রাখে ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতরের ব্লক অফিস (বিএলআরও), রেজিস্ট্রি করে রেজিস্ট্রি অফিস, আর ম্যাপ রাখে সার্ভে সেটলমেন্ট দফতর, যা ভূমি দফতরেরই অধীনে, কিন্তু ভিন্ন বিভাগ। ফলে তিনটি নথির মধ্যে নানা অসংগতি থাকে। যেমন, একটিতে মালিকানা বদল নথিভুক্ত হলেও অন্য দুটিতে না-ও হতে পারে।

দলিল রেজিস্ট্রি করা জমির মালিকানার প্রমাণ নয়। রেকর্ডও জমির দখল ও মালিকানার সাক্ষ্য, কিন্তু প্রমাণ নয়। ১৯০৮-এর ভারতীয় রেজিস্ট্রেশন আইনে কোথও বলা নেই, দলিল রেজিস্ট্রি করা মানে জমির মালিকানার নথিভুক্তি। মালিকানা প্রমাণ করতে হয় জমির ইতিহাস দিয়ে। বর্তমান মালিকের কাছে জমি কী করে এল, দলিলে তার কালানুক্রমিক বর্ণনা করে বলতে হয়, জমিটা এই ভাবেই হাত বদলেছে, তাই আর কারও মালিকানার দাবি নেই।

ভারতে ৮৫-৯০ শতাংশ জমির মালিকের তথ্য রেজিস্ট্রিতে নেই। কারণ উত্তরাধিকারে পাওয়া জমির রেজিস্ট্রি হয় না। বড়জোর পনেরো শতাংশ জমির কেনাবেচা, দান, রেজিস্ট্রি হয়। এতে আন্দাজ হয়, জমিতে কালো সম্পদ রাখার কতটা সুযোগ রয়েছে।

জমির কালোবাজারির তিনটি প্রধান স্রোত। এক, জমির মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা এড়াতে বেনামে জমি কেনা। অনেকে নাকি বেড়াল-ছাগলের নামেও জমি কিনে রেখেছেন। দুই, জমির কম মূল্য দেখিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করা। তাতে বিক্রেতার ঘরে করহীন কালো টাকা এল, ক্রেতাকে কম স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হল। তিন, ম্যাপ, রেকর্ড, দলিলে জমির সীমানা, শ্রেণি, চিহ্ন বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে বেশি জমি দখলে রাখা। বা পুকুরকে ‘জমি’ বলে দেখিয়ে তা বুজিয়ে আবাসন তৈরি করা। নথিতে ভুয়ো মানচিত্র, ভ্রান্ত তথ্য দেখানো থাকে।

জমির মালিকানায় স্বচ্ছতা আনতে ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ নানা রাজ্যে কম্পিউটারে জমির রেকর্ড রাখা হচ্ছে। রেজিস্ট্রি অফিসে দলিল রেজিস্ট্রি করার সময়ে আঙুলের ছাপ, চোখের ছবি নেওয়া হচ্ছে। তাতে জমির বৈধ মালিকদের হয়রানি কিছুটা কমতে পারে, বেনামি জমি কমছে কি? ‌আধার কার্ডেও আঙুলের ছাপ, চোখের ছবিই রয়েছে। এর আগেও বিশ্বস্ত লোকের নামে জমি কিনতেন কালো টাকার কারবারিরা। আধার কার্ড আবশ্যিক করলে তাঁরা শুধু দেখে নেবেন, বশংবদ লোকটির আধার কার্ড আছে কি না। দ্বিতীয় উপায়, অর্থাৎ জমি কেনাবেচায় কালো টাকায় লেনদেন, সেটাও আধার কার্ড রুখতে পারে না। আর তিন, জমির শ্রেণি, সীমানা প্রভৃতি তথ্যে কারচুপিও আধার কার্ড আটকাতে পারবে না। তার জন্য ভূমি দফতরের কর্মীদের দুর্নীতি আটকাতে হবে।

তা হলে কী করণীয়? বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সব জমির রেজিস্ট্রি আবশ্যক করতে হবে। ম্যাপ, রেকর্ড আর রেজিস্ট্রি তৈরি ও নথিভুক্তির কাজ করতে হবে একটিই দফতরকে। এবং রেজিস্ট্রির কাগজকেই জমির মালিকানার আইনি প্রমাণ বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। বিশেষজ্ঞেরা আশা করেন, জমির মালিকানার পোক্ত প্রমাণ যাঁর হাতে পৌঁছবে, তাঁকে সম্পূর্ণ বাদ দিয়ে আড়াল থেকে জমি ভোগ করা, কেনাবেচা করা কালো টাকার মালিকের পক্ষে কঠিন হবে।

সব জমির রেজিস্ট্রেশন আবশ্যিক করার জন্য রেজিস্ট্রেশন আইনে সংশোধনের একটি প্রস্তাব ২০১৩ সালে রাজ্যসভায় পেশ হয়েছিল। আজও তা সেখানেই পড়ে। কালো সম্পদ রুখতে মোদী সরকার কতটা আগ্রহী, এ-ও তার একটা নমুনা।

আজিজ প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

black money Anonymous land
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE