Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ওদের এই যন্ত্রণা ভোগ করানোর কোনও দরকার ছিল কি

আমার প্রতিবাদের ভাষা

আপনি তো ডাক্তার নন, হলে জানতেন, এদের জীবনের কোনও ঝুঁকি নেই। উপর থেকে নির্দেশ আসামাত্রই সব ক’টা জানকে মৃত্যুর হুক থেকে খুলে, কোমা থেকে টেনে বার করে নরমাল ফ্ল্যাট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমরা।

মেডিক্যাল ছাত্রদের অনশন।

মেডিক্যাল ছাত্রদের অনশন।

অনিতা অগ্নিহোত্রী
শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

মেডিক্যাল ছাত্রদের অনশন ধর্মঘট তাদের সমস্যার গণ্ডি ছাড়িয়ে বৃহত্তর সমাজের প্রতিবাদ ক্ষমতার প্রশ্নে জুড়ে গিয়েছে। কয়েক দিন ধরেই খেতে বসলে ছাত্রছাত্রীদের ব্লাড প্রেশার চার্টগুলি মনে আসে আর গা গুলিয়ে ওঠে, ভাত নামিয়ে রাখি। রবিবার দিন উৎকণ্ঠা নিয়ে সকালের কাগজ খুলে দেখলাম, আজ ছুটির দিন, আজ কোনও সিদ্ধান্ত হবে না। তা ছাড়া চাপের কাছে নতিস্বীকার করবেন না কর্তৃপক্ষ। আপৎকালেও রবিবারে সিদ্ধান্ত হয় না— এমন কথা সাড়ে তিন দশকের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতায় প্রথম শুনলাম। বন্যা দুর্যোগ দুর্ঘটনা ভিআইপি ভিজ়িট— কাজ চলে ২৪ বাই ৭। এটাই তো দস্তুর। এগারো দিন টানা অনশনে থাকা তরুণ ডাক্তারদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে ঝুলে থাকা— আপৎকালীন অবস্থা নয় বুঝি?

নয়ই তো! আপনি তো ডাক্তার নন, হলে জানতেন, এদের জীবনের কোনও ঝুঁকি নেই। উপর থেকে নির্দেশ আসামাত্রই সব ক’টা জানকে মৃত্যুর হুক থেকে খুলে, কোমা থেকে টেনে বার করে নরমাল ফ্ল্যাট করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমরা।তাই বলে চাপ দেবে আমাদের? আর তার কাছে আমরা নতিস্বীকার করব? আমরা কি কাপুরুষ? আমাদের ছেলেমেয়েদের সমান বয়সিদের এমন হিম্মত যে জান নিয়ে খেলে আমাদের চাপ দেবে? আরে, চাপ হল রাজনৈতিক। সে তো সইতেই হচ্ছে। মাসখানেক ধরে কলেজে কলেজে অ্যাডমিশনের নামে তোলা আদায় চলল, কেউ কিছু বলিনি। সে সব রাজনৈতিক ব্যাপার। আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে। যাদবপুরে অ্যাডমিশন নিয়ে পলকে পলকে নীতি বদল চলল। সে সবও ঠিক আছে। মেধা নির্ধারণের মানদণ্ডটাকেই দুমড়েমুচড়ে নষ্ট করার চেষ্টা হল। সেখানে আমাদের, মানে প্রশাসকদের তো করার কিছু ছিল না। তাই বলে হস্টেল কাউন্সেলিংয়ের মতো প্রশাসনিক ব্যাপারে চাপ? তা-ও অনশন করে! হস্টেল আবণ্টনের কাউন্সেলিং তো আমাদের করানোর ছিল, নাকি? হস্টেলগুলির নরককুণ্ডের মতো অবস্থা শোধরানো, সময়মতো পরিদর্শন না করার অকর্মণ্যতা আমাদের বিবেকে কোনও দাঁত বসায় কি? বোধ হয় না। কারণ ওই আবর্জনাগুলি তো আমরা বাড়ি থেকে বয়ে আনিনি। আমাদের আগেও সরকার ছিল, প্রশাসন ছিল। তারা কী করছিল? আমাদের বিবেক আমরা স্বচ্ছ ভারত অভিযানের লম্বা ঝাড়ু দিয়ে সাফ করে দিয়েছি। টানা দশ দিনের অনশন পর্ব জুড়ে অতি দায়সারা ভাবে আলোচনা চলছিল। ভাবখানা যেন, মানবজীবনের চেয়ে বেশি হেলাফেলার কোনও বস্তু নেই, বিশেষত ধর্মঘটীরা যদি শাসক দলের না হন। শনিবার সন্ধে পর্যন্ত টানাটানি করে একটা প্রশাসনিক নির্দেশ বার করা গিয়েছিল, কিন্তু সরকারের আশীর্বাদধন্য না হতে পারায় শেষ পদক্ষেপটি হতে হতে রয়ে গেল। তার মধ্যে এসে গেল কালান্তক রবিবার।

সোমবার ধর্মঘট শেষ হয়েছে। তরুণ প্রাণগুলিকে নিয়ে যে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তা, তার থেকে রেহাই মিলেছে। ছাত্রছাত্রীরা ফিরে যাবে নিজ নিজ দায়িত্বে। কিন্তু গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে স্বাস্থ্য-শিক্ষা প্রশাসনের বড় অফিসার ও ডাক্তাররা অসংবেদনশীলতা ও অমানবিকতার যে দৃষ্টান্ত জনসমক্ষে পেশ করলেন, তা কোনও পর্দা দিয়েই ঢাকা পড়বে না।
যে অনশন ধর্মঘটের কোনও প্রয়োজনই ছিল না— কারণ সংশ্লিষ্ট সমস্যাগুলির সমাধান করা প্রশাসকদের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে— সেই ধর্মঘট তরুণ ডাক্তারদের জীবনের মূল্যে দীর্ঘায়িত করে, আবার তাদের ঘাড়েই চাপানো হল চাপ দেওয়ার দায়, এবং রবীন্দ্রনাথ বিভূতিভূষণ সত্যজিতের বাংলায় নির্মমতার নতুন দৃষ্টান্ত নির্মাণ করলেন কর্তারা। রাজনীতির লোকেরা তাঁদের যা সাজে তা-ই করেছেন। হস্টেলের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কোনও মহত্তর উদ্দেশ্য তাঁদের ছিল না। কিন্তু আপনাদের মধ্যে কারও হিম্মত ছিল না ক্যাম্পাসে পুলিশ না ডেকে আনার, ধর্মঘটীদের পরিবারের উপর চাপ সৃষ্টি না করার, অনশনের বারোতম দিনে, রবিবারে, কোনও শীর্ষকর্তার দিবানিদ্রা ভাঙিয়ে বিশেষ আদেশটি বার করে আনার? ভয় ছিল, শো-কজ়ড হওয়ার, নিলম্বনের খাঁড়া মাথার উপর নেমে আসার?

না কি এ সব আর স্পর্শই করে না আপনাদের— ক্ষীয়মাণ রক্তচাপ, রক্তে শর্করা, মায়ের চোখের অকিঞ্চিৎকর অশ্রু। বেশ করেছেন, যথার্থ করেছেন। এই ভাবেই তো মানুষ তার মানবিকতা হারায়। আমার প্রতিবাদের ভাষা, ১৯৪৮ সালে লেখা গানটি অনেক ক্ষণ ধরে শুনলাম আজ। আপনারাই শুনতে বাধ্য করলেন বলা যায়। সেই জন্য আপনাদের ধন্যবাদ দিই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Hunger Strike Calcutta Medical College অনশন
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE