E-Paper

একার ইচ্ছায় বিপর্যয়

ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের ফলে আমেরিকার সাধারণ মানুষকে পড়তে হল বিপুল সমস্যায়। শুল্কের কারণে অভ্যন্তরীণ দাম বেড়ে গিয়ে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় আমেরিকাকে আর্থিক মন্দার মুখে দাঁড় করিয়েছে।

শৈবাল কর

শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:৩০

আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যে মুক্ত ব্যবস্থার দিকে অনেকটাই এগিয়েছিল বিভিন্ন দেশ, তা ২০২৫-এ এসে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে চলেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একের পর এক বাণিজ্য নীতির ধাক্কায়। জানুয়ারি মাসে দ্বিতীয় বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরেই ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য পদ্ধতি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। আমেরিকার উদারপন্থী নীতির অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে বাণিজ্যে যুক্ত দেশগুলো, এমনটাই মনে করেন ট্রাম্প। প্রসঙ্গত, আমেরিকার এই নতুন অবস্থানের স্বপক্ষে আগেও বলা হয়েছে যে, উন্নয়নশীল দেশগুলি যে বেতনে শ্রমিক নিয়োগ করে, তার সঙ্গে প্রতিযোগিতা অসম্ভব। ফলে, উৎপাদনের খরচ আমেরিকাতে তুলনামূলক বেশি বলেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তারা চিন-দক্ষিণ কোরিয়া-ভারতের এত আধিপত্য সহ্য করে। তার সঙ্গে এও সত্যি, ভারত, ব্রাজ়িল-সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যথেষ্ট দরাদরি করে নিজেদের প্রয়োজন অনুসারে বেশ উঁচু হারে আমদানি শুল্ক আরোপ করার অনুমতি নিয়ে রেখেছে।

এই দু’ধরনের তুলনামূলক অসুবিধার দাওয়াই হিসাবে প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে শুল্ক আরোপের নির্দেশিকা আসে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে গড় আমদানি শুল্ক ২.৫% থেকে বেড়ে ২৭% হয়ে যায় আমেরিকাতে। এর পিছনে মূল উদ্দেশ্য বিদেশ থেকে আমদানি কমানো, আর দেশের উৎপাদকদের সুরক্ষা দেওয়া। অন্য দেশ রফতানি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, এটাও পরিকল্পনার একটা অংশ। ভারতের ক্ষেত্রে এই সময়েই সব পণ্যের উপরে— এমনকি ওষুধের উপরেও— ২৫% শুল্ক ঘোষিত হয়। ট্রাম্পের আরও একটি ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল যে, ঠিক সেই হারে শুল্ক আরোপ করতে হবে যাতে করে চিন-সহ অন্য দেশের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বাণিজ্য ঘাটতি মিটিয়ে ফেলা যায়। খাতায়-কলমে এটা সম্ভব হলেও পদ্ধতিটি বাস্তবসম্মত নয়।

জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে ট্রাম্প যে ঘোষণাগুলি করেন, তার রাজনৈতিক আখ্যানটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়েছেন যে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্ষমতাবান হতে পারেন, কিন্তু এ রকম স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতা তাঁরও নেই। ট্রাম্প সেটা জানেন এবং তাই ঘোষণা করার আগেই আমেরিকাতে ‘ইমার্জেন্সি ইকনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ আরোপ করেন। এর সাহায্যে ২ এপ্রিল সেই সব দেশের উপরে ঠিক সেই পরিমাণ শুল্ক আরোপ করা হয়, যা তারা আমেরিকান পণ্যের উপরে আরোপ করেছে এত দিন। ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, আর তামার উপরে ৫০% হারে শুল্ক বসানো হয়। গাড়ি রফতানি করে যে দেশগুলো, তাদের উপর ২৫% শুল্ক বসানো হয়। তবে পরিবর্ত শুল্ক আরোপ কিছু দিন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হন ট্রাম্প, কারণ ঘোষণার প্রাথমিক ধাক্কাতেই শেয়ার বাজারে ধস নামে। আমেরিকার বহু ব্যবসা উন্নয়নশীল দেশ থেকে রফতানি করা কাঁচামালের উপরে নির্ভর করে। তাতে শুল্ক বসানোর অর্থ শুধু সে দেশের রফতানির ক্ষতি নয়, আমেরিকার অভ্যন্তরীণ পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং চাহিদা কমিয়ে দেওয়া। আমেরিকার যে রফতানি আমদানির উপরে নির্ভরশীল, এই নীতিতে সেই শিল্পের বিশেষ ক্ষতি। নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করার মোক্ষম উদাহরণ!

১৩ ফেব্রুয়ারি যখন প্রথম পরিবর্ত শুল্কের কথা ঘোষণা করেন ট্রাম্প, এবং রাজনৈতিক ভাবে ঘনিষ্ঠ দেশগুলোর সঙ্গেও অনুকূল বাণিজ্য-চুক্তি প্রত্যাহার করেন, তখন কোনও দেশই সঠিক বুঝতে পারেনি যে, ট্রাম্প কোন বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন— অন্যায্য শুল্ক আরোপ করার বিষয়কে, না কি শুল্কের সাহায্যে সরকারি ব্যয়ভার বহন করার পরিকল্পনাকে? কানাডার প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন, ট্রাম্প তাঁদের অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়ে দেশটিকে আমেরিকার সঙ্গে সংযুক্ত করে নেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। জাপানের উচ্চ পর্যায়ের আধিকারিকরা নাকি অনেক চেষ্টা করেও ট্রাম্পের দফতরের কাছে উত্তর পাননি যে, মূল লক্ষ্য ঠিক কী। এমনকি ভিয়েতনাম যখন জানায় যে, তারা সব আমেরিকান পণ্যের উপরে শুল্ক প্রত্যাহার করতে প্রস্তুত, তখন আমেরিকা তার প্রতিদানে শুল্ক প্রত্যাহারে রাজি হয়নি। তাদের লক্ষ্য তখন বাণিজ্য ঘাটতি কমানো।

এর অব্যবহিত পরেই এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে আমেরিকা চিনের উপরে ১৪৫% আমদানি শুল্ক বসায়। অর্থাৎ চিন থেকে আসা ১০০ ডলারের পণ্যের দাম আমেরিকাতে পড়বে ২৪৫ ডলার। আমেরিকাতে চাহিদা কমবে হুহু করে, ফলে চিনের ব্যবসা ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এই আমদানি করা পণ্য ছাড়া যদি না চলে— তা যদি কোনও ভাবেই আমেরিকা বা অন্য দেশে উৎপাদন করা না যায়? তা হলে আড়াই গুণ দাম দিয়ে আমেরিকার উপভোক্তা কিনতে বাধ্য হবেন। ট্রাম্প আসলে কার ক্ষতি চাইছেন, তা বুঝতে গোয়েন্দা নিয়োগ করতে হবে। এর উত্তরে চিন আমেরিকান পণ্যের উপর ১২৫% শুল্ক আরোপ করে। হ য ব র ল-র উধো আর বুধো যেমন ষাট-একষট্টি-বাষট্টি বলে নিলাম ডেকেছিল, এই গল্পটা প্রায় তেমনই।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে দু’বার হোঁচট খেয়েও শেষ পর্যন্ত ২৭ অগস্ট ভারতীয় পণ্যের উপরে আরও ২৫% জুড়ে মোট ৫০% শুল্ক আরোপিত হয়। ভারত কেন রাশিয়ার কাছ থেকে তেল কেনে, এই ছিল ট্রাম্পের গোসার প্রধান কারণ। ব্রাজ়িলের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বোলসোনারোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্যে চাপ দিতে সে দেশের উপরেও ট্রাম্প শুল্ক বসানোর হুমকি দেন। বাণিজ্যের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ নেই, এমন বিষয় যে শুল্কের হারের ক্ষেত্রে দরকষাকষির ঘুঁটি হতে পারে, একুশ শতকে এমন উদাহরণ কার্যত আর নেই। ভারতীয় ওষুধ সংস্থাগুলি যদি আমেরিকার মাটিতে উৎপাদন শুরু না-করে, তবে সেই সংস্থাগুলির উৎপাদিত পণ্যের উপরে ১০০% শুল্ক আরোপ করার কথাও ঘোষিত হয়। এই সময়ে চিনের সঙ্গে আবার নতুন বাণিজ্যচুক্তি সই করার কথা আলোচিত হতে থাকে। বাণিজ্য-সঙ্গীর উপরে চাপ তৈরি করে তাকে নিজের ইচ্ছামতো চুক্তিতে সই করতে কার্যত বাধ্য করা— ট্রাম্পের নীতির সারসত্যটি এ রকমই। তবে আশার কথা এই যে, আমেরিকান সুপ্রিম কোর্ট মনে করছে যে, ‘ইমার্জেন্সি ইকনমিক পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ প্রেসিডেন্টের হাতে যে বাড়তি ক্ষমতা দেয়, ট্রাম্প সে সীমা ছাড়িয়ে গিয়ে তার অপব্যবহার শুরু করেছেন। ফলে, যা ঘোষণা করছেন তা অবৈধ। এই মামলার রায় আমেরিকার বাণিজ্য নীতির উপরে প্রভাব ফেলবে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

ভারতের ব্যবসা যে প্রাথমিক ভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। ভারতের ক্ষেত্রে জিএসটি কমিয়ে ব্যবসা বজায় রাখার আর দেশের ভিতরে চাহিদা বাড়ানোর প্রয়াস নিতে হয়েছে। পুঁজি অনেক ক্ষেত্রে বৈদেশিক বাণিজ্যভিত্তিক ব্যবসা থেকে সরে গিয়ে অন্য ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছে। এর মধ্যে এমন কিছু পরিষেবাও রয়েছে, যেগুলো পেট্রলিয়ামের উপরে নির্ভর করে। সেগুলোর উৎপাদন আর জোগান বেড়েছে বেশ কয়েক গুণ। সুতরাং, ট্রাম্পের শুল্কের ফলে ভারতে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি কমার বদলে বেড়েও যেতে পারে।

ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের ফলে আমেরিকার সাধারণ মানুষকে পড়তে হল বিপুল সমস্যায়। শুল্কের কারণে অভ্যন্তরীণ দাম বেড়ে গিয়ে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় আমেরিকাকে আর্থিক মন্দার মুখে দাঁড় করিয়েছে। অন্য দিকে, প্রেসিডেন্ট যা-ই বলুন না কেন, রাতারাতি আমদানি বন্ধ করে দেওয়া অসম্ভব— কারণ, সেই পণ্যগুলি দেশের ভিতরে উৎপাদন করার জন্য তৈরি হতেও তো সময় লাগে। আমেরিকার মতো উন্নত দেশ হলেও এই আশা করা অন্যায্য যে, এক বছরের আগে আমদানি-পরিবর্ত তারা উৎপাদন করতে পারবে। ফলে এর মধ্যে উচ্চ আমদানি শুল্কের সাহায্যে রাজস্ব বেড়েছে তিন গুণ। সে টাকা আসছে সাধারণ মানুষের পকেট থেকেই। তবে, প্রেসিডেন্ট নাকি আবার সে টাকা মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করছেন।

কোনও এক জন অসীম ক্ষমতাধর মানুষের অবিবেচক সিদ্ধান্ত বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থাকে কোন টালমাটাল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, ২০২৫ সাল তারই সাক্ষী রইল।

অর্থনীতি বিভাগ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Donald Trump Tariff War Trump’s Tariff War

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy