Advertisement
E-Paper

আজ মনে পড়বে নাদিয়া, মেহরুন্নিসাদের

যদি সংখ্যাগুরু সব সময় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে, তা হলে মানবাধিকার দিবস উদ্‌যাপনটাও কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়।মানবাধিকার দিবসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা এই সব মহিলাদের কথাই আমার আগে মনে পড়ে। যেমন এই শীতে কেমন থাকবেন কুতুপলং, উখিয়াতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মহিলারা।

সৈয়দ তানভীর নাসরীন

শেষ আপডেট: ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:৫৯
অধিকারের দাবিতে পথে খুদেরাও। ফাইল ছবি

অধিকারের দাবিতে পথে খুদেরাও। ফাইল ছবি

নাদিয়া মুরাদ কেমন ভাবে পালন করবেন আজকের ১০ ডিসেম্বর দিনটিকে? বা তাঁর মতো আরও বেশ কিছু ইয়েজদি মহিলা, যাঁরা আইএস-এর হাতে বন্দি ছিলেন। কথাটা আমাকে মনে করিয়ে দিলেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সোফিয়া পাণ্ডিয়া। দিল্লিতে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সোফিয়া যখন ইয়েজদি মহিলাদের, যাঁরা আইএস-এর হাতে যৌন-দাসী হিসেবে বন্দি ছিলেন, তাঁদের কথা তুললেন, তাঁদের অধিকারের কথা তুললেন, তখন হলঘরে সুচ ফেললেও শব্দ শোনা যাবে। আমরা যারা নারী-অধিকার নিয়ে কাজ করছি, তাঁরাই বা কী উত্তর দেব এই প্রশ্নের?

মানবাধিকার দিবসে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা এই সব মহিলাদের কথাই আমার আগে মনে পড়ে। যেমন এই শীতে কেমন থাকবেন কুতুপলং, উখিয়াতে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের মহিলারা। মনে আছে, দু’বছর আগের শীতে আমি রোহিঙ্গাদের জন্য তৈরি রাষ্ট্রপুঞ্জ আর বাংলাদেশ সরকারের শরণার্থী শিবিরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম বাংলাদেশের কক্সবাজার থেকে কিছু দূরে শরণার্থী শিবিরে কেমন করে শীত কাটাবেন মায়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা?

১০ ডিসেম্বর ‘মানবাধিকার দিবস’। রাষ্ট্রপুঞ্জ এই ঘোষণা করেছে দিনটিকে মানবাধিকার হিসেবে উদ্‌যাপনের জন্য। কিন্তু বন্দুকের নল যেখানে এখনও পৃথিবীর অনেক প্রান্তেই ক্ষমতার উৎস, যেখানে গণতন্ত্র এখনও খাতায়কলমে বন্দি হয়ে রয়েছে, সেই সব জায়গায় সত্যিই কি মানুষ তার অধিকার বুঝে নিতে পেরেছে? প্রথা অনুযায়ী, ১০ ডিসেম্বরই নোবেল কমিটি শান্তির পুরস্কার, প্রাপকদের হাতে তুলে দেন। নাদিয়া মুরাদ যেমন এই পুরস্কার পেয়েছিলেন যৌন নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও জীবনের কথা বলার জন্য, অধিকারের কথা বলার জন্য। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও সত্যি যে মায়ানমারের সর্বোচ্চ নেত্রী সু কি-ও শান্তির জন্য নোবেল পেয়েছিলেন, যে শান্তি তাঁর সরকার নিজেদের দেশেই রোহিঙ্গাদের দিতে পারেনি।

আসলে অধিকার একটা এমন বিষয়, যেটা শুধু খবরের কাগজের পাতায় বা সংবিধানের বইতে লেখা থাকলেই হয় না। আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সেটা অনুভব করতে হয়। এই তো কয়েক মাস আগে আমরা শিউরে উঠেছিলাম, প্রতিবেশী বাংলাদেশে আইনরক্ষা বাহিনীর হাতে ধৃত এক রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তার কিশোরী কন্যাদের ফোনে কথোপকথন শুনে। মৃত্যুর থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়েও স্নেহবৎসল পিতা তার অবুঝ কন্যাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন, কী ভাবে তিনি ফিরে আসবেন এবং কন্যাদের নিয়ে বেড়াতে যাবেন, সেই ‘মিথ্যা’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কন্যাদের আকুতি আর পিতার প্রতিশ্রুতি শুনে চোখের জল আটকে রাখা কঠিন। বাংলাদেশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে তখন মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বিচার বা তদন্ত ছাড়াই হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। বিদেশের একাধিক সংবাদপত্রও এই ‘বিচার ছাড়াই হত্যা’কে ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতির মানাবাধিকারকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হত্যার অভিযান চালিয়ে যাওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিল। ফিলিপিন্সের রাষ্ট্রপতি দুতের্তে অবশ্য মানবাধিকার শব্দটাকে কার্যত নর্দমায় বইয়ে দিয়েছেন। যে ভাষায় তিনি বিরোধী রাজনৈতিক নেত্রীদের আক্রমণ করেন বা মহিলাদের গোপনাঙ্গে গুলি করে হত্যার কথা বলেন, তাতে ম্যানিলা অন্তত মানবাধিকারের মানচিত্রের মধ্যে পড়ে বলে মনে হয় না।

মনে আছে, এমনই আর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জি পার্থসারথি আমাদের সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, চিনের বিরুদ্ধে তার উঘুর প্রদেশে মুসলিমদের উপরে যে ভাবে ‘দমনপীড়ন’ চালানোর অভিযোগ উঠছে, তা নিয়ে সরব হওয়ার সময় এসেছে। এ নিয়ে খুব বেশি হইচই সংবাদপত্রে বা তাত্ত্বিক মহলে দেখা যায় না। কিন্তু পার্থসারথির মতো আমারও ধারণা, উঘুরে মুসলিমদের যে ভাবে যাবতীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখার অভিযোগ উঠছে চিনের বিরুদ্ধে, তার প্রভাব ভবিষ্যতে বেজিংকে ভোগাবে। শুধু চিন নয়, উঘুরের দমনপীড়নের প্রভাব পড়বে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশে। মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা, জনজাতিরা এ নিয়ে ইতিমধ্যে অসন্তুষ্ট। হয়তো চিন ‘সুপার পাওয়ার’ বলে এখনও এর প্রভাব আমরা টের পাচ্ছি না। কিন্তু বেশি দিন কোনও জিনকেই ‘বোতলবন্দি’ করে রাখা যায় না। একটা সম্প্রদায় তাদের নিজেদের মতো ধর্মাচারণ করতে পারবে না, পছন্দ মতো নাম রাখতে পারবে না, দাড়ি কিংবা পোষাক রাখতে পারবে না, এর চেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন আর কী ভাবে হতে পারে?

নাদিয়া মুরাদের উদাহরণ দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম, কারণ যেখানে এক দল মানুষ ধর্মের নাম করে অন্য ধর্মের অসহায় কিছু নারীর সঙ্গে চরম অত্যাচার দিনের পর দিন করে যায়, সেখানে অধিকারই বা কোথায়, আর মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করার অবকাশই বা আমরা কোথায় পাই! যদি সংখ্যাগুরু সব সময় সংখ্যালঘুর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করে যায়, তাদের মানবাধিকারকে লঙ্ঘন করে, তা হলে মানবাধিকার দিবস উদ্‌যাপনটাও কেমন যেন ফিকে হয়ে যায়। বিভিন্ন দেশ ঘোরার সুবাদে জানি, আসলে এই সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর ‘পরিচয়’টাও নদী-সমুদ্র পেরোতে পেরোতে বদলে যায়।

তাই আমি আজ, ১০ ডিসেম্বর নাদিয়া মুরাদের মতো ইয়েজদি মহিলাদের স্মরণ করব। কুতুপলঙে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে থাকা নুরবানু কিংবা মেহরুন্নিসাদের কথা মনে করব। ওঁরাই তো আসলে শেখান, বন্দুকের নল কখনও চিরদিন ক্ষমতার উৎস হতে পারে না। অধিকার বুঝে নেওয়ার লড়াইতে চিরকাল বেয়নটের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো মানুষটাই জেতে। সেটাই মানুষের সভ্যতার ইতিহাস, সেটাই আসলে মানবাধিকারের ঝান্ডা ওড়ানোয় সগর্ব ঘোষণা।

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের শিক্ষক

Human Rights Human Rights Day Rohingya United Nations
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy