Advertisement
E-Paper

গাঁধীর অনশনে উপমহাদেশে নতুন মৈত্রীর বাতাস, বললেন পাক মন্ত্রী

এত বড় রাজনৈতিক পরাভবের সামনে দাঁড়িয়েও কিন্তু মহাত্মা তাঁর নৈতিক অবস্থানটি ছাড়তে চাওয়ার লক্ষণই দেখালেন না, ‘ঐক্য’-এর লক্ষ্যে তাঁর কাজও বন্ধ হল না। কয়েক দিন আগে, ৬ জুন তিনি ভবিষ্যৎ ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আর্জি জানিয়েছেন যাতে তারা সমস্ত ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগিতা করে।

সুগত বসু

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০০:৩৪

এগারো জুন, উনিশশো সাতচল্লিশ সাল: মহাত্মা গাঁধী বললেন, তিনি ‘‘যতটা পাকিস্তানের সঙ্গে, ততটাই হিন্দুস্থানের।’’ তত দিনে কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে অনেকটা, তাঁর এত দিনের ‘ইয়েস-ম্যান’রা ইতিমধ্যে তাঁর ‘নো-ম্যান’ হয়ে উঠেছেন। ভগ্নহৃদয় মহাত্মা অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটিকে ১৪-১৫ জুন জানিয়ে দিলেন, দেশভাগের অপ্রিয় সিদ্ধান্ত তারা নিতে চাইলে নিতে পারে।

এত বড় রাজনৈতিক পরাভবের সামনে দাঁড়িয়েও কিন্তু মহাত্মা তাঁর নৈতিক অবস্থানটি ছাড়তে চাওয়ার লক্ষণই দেখালেন না, ‘ঐক্য’-এর লক্ষ্যে তাঁর কাজও বন্ধ হল না। কয়েক দিন আগে, ৬ জুন তিনি ভবিষ্যৎ ভারত ও পাকিস্তানের কাছে আর্জি জানিয়েছেন যাতে তারা সমস্ত ক্ষেত্রে পরস্পরের সহযোগিতা করে। ‘‘পাকিস্তান যদি ভাল করে, তা হলে ভারতও পাকিস্তান হতে চাইবে, সেখানে আর সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘু থাকবে না, সকলেই সমান হবে।’’ ১২ জুন। ভাবছেন তিনি, ভৌগোলিক ভাগাভাগির অর্থ কি সত্যিই দেশটাকে দুই খণ্ড করা? ভাগাভাগি হলে ঐক্য প্রতিষ্ঠার কাজ যে কঠিন হয়ে যাবে, তিনি জানেন। কিন্তু তবুও কয়েক দিন পর স্বাধীনতা-প্রত্যাশী ভারতের প্রতি একান্ত প্রার্থনা জানালেন, ‘‘কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও চারিত্রিক দৃঢ়তা, নৈতিকতা, এবং সহনশীলতা দিয়ে ভারত যেন পাকিস্তানের মুসলিমদের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে এ দেশে ধর্ম, জাত বা বর্ণের উপর ভিত্তি করে কোনও বৈষম্য ঘটবে না, কেবল ব্যক্তির গুণাগুণের ভিত্তিতেই ভারতের নাগরিকরা নিজেদের ভাগ্য তৈরি করতে পারবে।’’ ইসলামের পবিত্র স্থানগুলি ও শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে সম্মান করা হচ্ছে কি না, তার উপরই নির্ভর করবে ‘ভারতের সত্যিকারের ঐক্য’।

১৫ অগস্ট যে গাঁধী কলকাতায় ছিলেন, সে আজ আমরা সবাই জানি। কিন্তু তিনি আসলে থাকতে চেয়েছিলেন নোয়াখালিতে। কিছু দিন আগে, অগস্টের গোড়ায়, ঘুরে এসেছেন কাশ্মীর ও পঞ্জাবে। শ্রীনগরে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ মন্তব্য করেছেন: ‘‘কাশ্মীরিদের ইচ্ছার উপরেই কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।’’ ৬ অগস্ট লাহৌরে কংগ্রেস কর্মীদের বলেছেন, তাঁর বাকি জীবন কাটাতে চান পূর্ব বাংলায় কিংবা পশ্চিম পঞ্জাবে, নয়তো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে। বাংলায় পৌঁছে অবশ্য তাঁর নোয়াখালি যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করতে হল, ‘ভারতের প্রধান শহর’ কলকাতার সুস্থতা ফেরানোর কাজটা তো তাঁকে করতেই হবে। ১৩ অগস্ট বেলেঘাটার এক মুসলিম বাড়িতে আশ্রয় নিলেন, সঙ্গে রইলেন তখনকার বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সুরাবর্দি। মুসলিম লিগ নেতার সঙ্গে এতটা নৈকট্য নিয়ে স্বস্তিবোধ করছিলেন না অনেকেই। গাঁধী তাঁদের আশ্বস্ত করলেন এই বলে যে তিনি সুরাবর্দিকে চেনেন সেই অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলি থেকে। দিল্লিতে তখন চলছে স্বাধীনতার উৎসব। গাঁধী রইলেন অনেক দূরে। অজানা দরিদ্র মানুষদের সঙ্গে একত্র হয়ে, অনশন আর প্রার্থনার মধ্যে কাটল তাঁর দিনটি। ভারত সরকারের তথ্যসম্প্রচার দফতর থেকে ঐতিহাসিক দিনটিতে গাঁধীর প্রতিক্রিয়া চাইলে বলে দিলেন— তাঁর কথা আজ শুকিয়ে গিয়েছে।

সে বার ইদ পড়েছিল ১৮ অগস্ট। পঞ্জাবে চলছে ভয়াবহ হত্যালীলা। এ দিকে কলকাতায় কিন্তু হিন্দু ও মুসলিম পরস্পরকে ইদ মুবারক জানাচ্ছেন। ২১ অগস্ট গাঁধী দেখে খুশি হলেন যে তাঁর প্রার্থনাসভার পাশে এক সঙ্গে উড়ছে ভারতীয় ও পাকিস্তানি পতাকা। অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে তিনি আর শওকত আলি মিলে যে তিনটি ‘জাতীয়’ স্লোগান দিতেন: ‘আল্লাহু-আকবর’, ‘বন্দে মাতরম্’, এবং ‘হিন্দু-মুসলমান কি জয়’, সেগুলি আবারও এক সঙ্গে ধ্বনিত হচ্ছে। ২৩ অগস্ট বললেন, আল্লাহু-আকবরের মতো ‘অন্তর-মথিতকারী ধর্মীয় প্রার্থনা’কে যেন হিন্দুরা অসম্মান না করেন, যেন মুসলিম ভাইদের সঙ্গে হিন্দুরাও ওই ধ্বনিতে গলা মেলান। ২৯ অগস্ট ‘বন্দে মাতরম্’ গানটি গাওয়া হল গাঁধীর প্রার্থনাসভায়। সমবেত জনতার সঙ্গে সুরাবর্দি ও উপস্থিত অন্য মুসলিমরা শ্রদ্ধাবশত স্টেজের উপর উঠে দাঁড়ালেন। গাঁধী উঠলেন না। তিনি মনে করতেন, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য দাঁড়ানোটা পশ্চিমি প্রথা, ভারতীয় সংস্কৃতিতে তা দরকার নেই।

কলকাতায় আবার হিংসাতাণ্ডব শুরু হল অগস্টের শেষে। আবার মহাত্মা অনশনে বসলেন। কলকাতা একটু শান্ত হতে যাত্রা করলেন পঞ্জাবের দিকে, পথে পড়ল দিল্লি। দিল্লির চেহারা দেখে তাঁর মনে হল, এ যেন ‘মৃতের শহর’, হাজার হাজার গৃহহারা মানুষ চার দিকে, প্রতিশোধ প্রত্যাঘাতে দিল্লি সম্পূর্ণ বিষায়িত। ‘‘ভারত যদি ব্যর্থ হয়, এশিয়ারও মৃত্যু হবে’’, বললেন গাঁধী।

কিছু দিনের মধ্যে শুরু হল কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের লড়াই। গাঁধী বার্তা পাঠালেন, কাশ্মীরিদের উপর কোনও ভাবে জোর করা চলবে না। তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত যেন নিতে পারে। গুজব শোনা গেল, কাশ্মীরও নাকি ধর্মের ভিত্তিতে দুই ভাগে ভাগ হবে, গাঁধীর কানেও এল সে কথা। ‘‘আর কত ভাগ হবে এ দেশ’’ ভাবলেন তিনি। এমন এক বিপর্যস্ত পরিস্থিতিতে স্বাধীন ভারতের প্রথম সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অধিবেশন বসল নভেম্বরের ১৫ থেকে ১৭। গাঁধী মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘ভারতীয় ইউনিয়নের কোনও মুসলিম যেন নিজেকে বিপন্ন না মনে করেন।’’ সে সময়ে কংগ্রেসের মধ্যেও মুসলিমদের অভ্যর্থনা বা স্বাগত জানানোর ব্যাপারে রীতিমতো শীতলতা। এই অবস্থায় হয়তো মুসলিমদের বাইরে থেকে কংগ্রেসকে সমর্থন করাই ভাল, ভাবলেন তিনি। তিনি নিজে যেমন করছেন।

জানুয়ারির ১২। মহাত্মা আবার অনশনের সিদ্ধান্ত নিলেন, দেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষ যাতে অন্তরের সম্প্রীতি বোধ করতে পারেন। ভারতের ধ্বস্ত সম্মান ও এশিয়ায় ভারতের উচ্চ মর্যাদা যাতে আবার ফিরে আসে। অনশনের সময় পাশ থেকে পড়া হল কোরান, গুরু গ্রন্থ। গাওয়া হল হিন্দুদের ভক্তিমূলক গান। এ তো কোনও সাধারণ অনশন নয়। এ তো সুবিশাল ধ্বংস এড়ানোর আকুল প্রার্থনা। আর তার সঙ্গে অনুনয়, যাতে ভারতের কোনও মানুষ না বলতে পারেন তিনি সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অংশ। সংখ্যালঘু মানুষকে যেন কেউ কখনও ছোট করে না দেখতে পারেন। অর্থাৎ এই অনশন হল ভারতের হিন্দু ও শিখ এবং পাকিস্তানের মুসলমানদের প্রতি সতর্কবাণী। আর ভারতের মুসলিমদের পক্ষ নিয়ে প্রার্থনা।

নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পদ ভাগাভাগির ক্ষেত্রেও নতুন ভারত যাতে সঙ্কীর্ণ হিসেব করতে না বসে, অনুরোধ করলেন গাঁধী। সর্দার পটেল আর তাঁর ‘ইয়েস-ম্যান’ নন, কিন্তু তাও গাঁধী তাঁকে আলাদা করে সতর্ক করেননি, বলেছিলেন— এ হল ভারতীয় মন্ত্রিসভার সম্মেলক দায়। যে ৫৫ কোটি টাকা ভারত সরকার কাশ্মীর যুদ্ধের কারণে পাকিস্তানের থেকে আটকে রেখেছিল, ১৯৪৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তা ছেড়ে দেওয়া হল। ‘‘এ শুধু কাশ্মীরের ব্যাপার নয়, দুই পক্ষের মধ্যে একটা সম্মানজনক শান্তিপূর্ণ বোঝাপড়া হতে হবে’’, বলেছিলেন গাঁধী: ‘‘ফ্রেন্ডশিপ শুড রিপ্লেস দ্য প্রেজ়েন্ট এনমিটি।’’ সব বড় রাজনৈতিক গোষ্ঠীর নেতারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফেরানোর অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করলে তবেই তিনি অনশন ভঙ্গ করলেন। সে দিন ১৮ জানুয়ারি। দেশের নানা জায়গায় আরএসএস বিক্ষোভ শুরু করেেছ, মহাত্মার দেশ গুজরাতের কাথিয়াবাড়, রাজকোটেও— খবর আসে। হিন্দু মহাসভা ও আরএসএস প্রতিনিধিদের তিনি মনে করিয়ে দেন, হিংসা থামানোর চেষ্টা না করলে ঈশ্বর কিন্তু ক্ষমা করবেন না। অনেক দূরে তখন পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রী জাফরুল্লা খান রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদকে জানাচ্ছেন যে, গাঁধীর অনশনের ফলে গোটা উপমহাদেশে নতুন মৈত্রীর বাতাস বইতে আরম্ভ করেছে। গাঁধী নিজেও অনশন শেষ করে খুশি বোধ করছিলেন। এ বার তিনি দিল্লি থেকে ছুটি নিয়ে পাকিস্তানের মাটিতে পা রাখতে পারবেন! অনশন ভঙ্গের সময় চার পাশে ধ্বনিত হল জাপানি, মুসলিম, পার্সি, খ্রিস্টান ও হিন্দু প্রার্থনা, প্রার্থনাসঙ্গীত, আর সব ছাপিয়ে মন্ত্রপাঠ: ওঁ অসতো মা সদ্‌গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময়!

—ত্রিশে জানুয়ারি সন্ধের কলকাতা। সতেরো বছরের এক কিশোরী গিয়েছিল বিবাহ অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণে। জাতের বাধা ভাষার বাধা পেরোনো সে অনুষ্ঠানে বাঙালি বধূ ও মালয়ালি বরের মিলন। হঠাৎ শোনা গেল স্তব্ধ করে দেওয়া সেই সংবাদ। না, এ হতেই পারে না, নিশ্চয়ই ভুল খবর, নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল কিশোরী। কিন্তু কত ক্ষণ আর— সমস্ত অনুষ্ঠান বাড়িতে তত ক্ষণে নেমে এসেছে গভীর শোকের যবনিকা। অতিথিরা একে একে নতমুখে প্রস্থান করছেন। সেও পা বাড়াল বাড়ির দিকে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কানে এল পথের দু’পাশে নানা বাড়ির রেডিয়োতে বাজছে ‘সমুখে শান্তি পারাবার’। মহাত্মা, অবশেষে, পার হচ্ছেন শান্তির পারাবার— যে শান্তির প্রার্থনা মুখে নিয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন।

Mohandas Karamchand Gandhi Mahtma Gandhi Article
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy