Advertisement
E-Paper

গুডনাইট নয়, ‘সুরজনী’ বলার নিদান রাজনারায়ণের

সুরাপান নিবারণী সভা চালু করে বেশ কয়েকজন সুরাসক্তের বুকে শেল হেনেছিলেন ঋষি রাজনারায়ণ বসু। আবার সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে মেদিনীপুরের সিপাহিদের নিয়ে সন্ত্রস্ত থাকতেন। লিখলেন নীলরতন সরকার।ভেঙে গেল মজলিশ। আর সেই মজলিশ ভাঙার জন্য সব দোষ গিয়ে পড়ল ঋষি রাজনারায়ণ বসুর উপরে। আসরটি যে ছিল মদ্যপানের। যথার্থই পানাহারের। সুরার সঙ্গে পোলাও-কালিয়ার স্বাদ।

শেষ আপডেট: ১১ মার্চ ২০১৯ ০২:৩২
তাঁর নামাঙ্কিত গ্রন্থাগারের সামনে রাজনারায়ণের মূর্তি। নিজস্ব চিত্র।

তাঁর নামাঙ্কিত গ্রন্থাগারের সামনে রাজনারায়ণের মূর্তি। নিজস্ব চিত্র।

ভেঙে গেল মজলিশ। আর সেই মজলিশ ভাঙার জন্য সব দোষ গিয়ে পড়ল ঋষি রাজনারায়ণ বসুর উপরে। আসরটি যে ছিল মদ্যপানের। যথার্থই পানাহারের। সুরার সঙ্গে পোলাও-কালিয়ার স্বাদ। আসর ভাঙল পৃষ্ঠপোষকের হঠাৎ বদলে। পান-ভোজনের জোগান দেওয়া ব্যক্তিটিই যে হঠাৎ সুরাপান নিবারণী সমিতির সভ্য হয়ে গেলেন। নিজের বৈঠকখানায় তিনি আর কী করে আসর বসাতে পারেন! ওই নিবারণী সমিতির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজনারায়ণ। ঘটনা মেদিনীপুর শহরের।

মেদিনীপুরে শিক্ষাবিস্তার, সমাজ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ঋষি রাজনারায়ণের। কিন্তু নানা কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়ে গিয়েছিল মজার কিছু ঘটনা। তারই একটি এই ভাঙা আসরের কাহিনি। সালটা ১৯৬০। মেদিনীপুর বাসকালে রাজনারায়ণের জীবনাচরণেও কিছু পরিবর্তন আসে। ওই বছর তিনি মদ্যপান ছেড়ে দেন। এবং পরের বছর মেদিনীপুরে সুরাপাননিবারণী সভা স্থাপন করেন। এটিই বাংলাদেশের প্রথম সুরাপাননিবারণীসভা। তার আগের বছরই প্রকাশিত হয়েছিল টেকচাঁদ ঠাকুরের ‘মদ খাওয়া বড় দায় জাত থাকার কি উপায়’। রাজনারায়ণ তখন মেদিনীপুর গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

রাজনারায়ণের স্কুলের হেডপণ্ডিত ভোলানাথ চক্রবর্তী মদ্যপান-বিরোধী কয়েকটি গান লেখেন। যা সুরাপাননিবারণী সভায় নিয়মিত পরিবেশিত হত। রাধাকান্ত দেবের পুত্র তৎকালীন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ব্রজেন্দ্রনারায়ণ দেব এই সভার সভ্য হওয়ার পর বাধল গোল। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের বৈঠকখানা ছিল স্থানীয় মদ্যপায়ীদের আড্ডা। উৎকৃষ্ট সুরা ছাড়াও পোলাও-কালিয়ার অফুরান জোগান বন্ধ হয়ে গেল। ফলত রাজনারায়ণের নামে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে নালিশ করা হল যে তিনি স্কুলে ব্রাহ্মধর্মের প্রচার চালাচ্ছেন। রাজনারায়ণ দমে যাননি। পরবর্তীকালে কলকাতার বিভিন্ন স্থানে সুরাপাননিবারণ আন্দোলন শুরু হয়।

আরেকটি ঘটনা। জাতীয় গৌরব সম্পাদনী সভার সূচনাও হয়েছিল মেদিনীপুরে। সভার মাধ্যমে দেশবাসীর মধ্যে জাতীয় ভাব জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেন তিনি। এই সভার অনুপ্রেরণাতেই নবগোপাল মিত্র কলকাতায় হিন্দুমেলার পরিকল্পনা করেন। স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ সভার সভ্যরা ‘গুডনাইট’-এর বদলে ‘সুরজনী’ বলা অভ্যেস করেন। পয়লা জানুয়ারির বদলে বৈশাখের প্রথম দিন নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ের রীতি চালুর চেষ্টা করেন। সভ্যদের পরস্পরের সঙ্গে ইংরেজি বলা ছিল কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। একটি ইংরেজি শব্দ বললে এক পয়সা করে জরিমানা হত। এ নিয়ে অবশ্য রাজনারায়ণকে অনেক রসিকতা সহ্য করতে হয়।

মেদিনীপুরের সঙ্গে রাজনারায়ণে যোগ কী ভাবে? ১৮৫১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে বদলি হয়ে পঁচিশ বছরের রাজনারায়ণ বসু যোগ দেন মেদিনীপুর গভর্নমেন্ট জিলা স্কুলে। এসেছিলেন হিন্দু কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র, প্রগতিশীল ব্রাহ্মনেতা পরিচয়ে। এই শহর তাঁকে ঋষি রাজনারায়ণে বদলে দিল। নিজেই লিখেছেন, জনসাধারণের কাছে তিনি ‘মেদিনীপুরের রাজনারায়ণ বসু’ নামে পরিচিত। আত্মকথার অনেকখানি জুড়ে শহর মেদিনীপুর। পূর্ববর্তী প্রধান শিক্ষক বৃদ্ধ সিনক্লেয়র সাহেবের অর্ধেক মাইনে, দেড়শো টাকায় স্কুলে যোগ দেন। অবশ্য সাহেবের জন্য বরাদ্দ বাংলোটি তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। বক্তৃতার মাধ্যমে শিক্ষাদানের বিরোধী রাজনারায়ণ চাইতেন ছাত্রের কণ্ঠস্বর বের করে আনতে। ছাত্রদের অনুসন্ধিৎসা জাগাতে বিতর্ক তথা বক্তৃতার আয়োজন করতেন। এই জেলা স্কুল থেকে প্রতি বছর দু’একজন ছাত্র বৃত্তি নিয়ে পাড়ি দিতেন কলকাতায়। বিদ্যালয়ে নানাবিধ শরীরচর্চার ব্যবস্থা করেন। ইরিগেশন অফিসারকে বলে একটি ব্যাডমিন্টন কোর্ট বানিয়ে দেন।

১৮৩৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলের জয়যাত্রার সূচনা তাঁর আমলেই। মেদিনীপুর শহরে কলকাতার নবজাগরণের বার্তা নিয়ে আসেন তিনিই। নিজের উদ্যোগে মেয়েদের শিক্ষার জন্য একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন। মেদিনীপুরে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই কলকাতায় বিধবাবিবাহ আন্দোলন শুরু হয়। ভাইকে বিধবার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সাময়িকভাবে মেদিনীপুরবাসীর কাছে বিরাগভাজন হয়েছিলেন। স্ত্রী-কন্যাদের অল্পদিনের জন্য কলকাতা পাঠাতে হয়েছিল। মেদিনীপুর বাসকালেই ঘটল সিপাহি বিদ্রোহ। অধিকাংশ বিশিষ্টজনের মতোই তিনিও সিপাহিদের পক্ষ নেননি। কিন্তু নিয়মিত খোঁজ রাখতেন। বিশেষত মেদিনীপুরের শেখাওয়াত ব্যাটেলিয়নে বিদ্রোহের আঁচ পড়েছে কিনা জানতে তাঁর আগ্রহ ছিল। দীর্ঘদিন পরেও তাঁর মনে ছিল, এই ব্যাটেলিয়নের বিদ্রোহী এক তিওয়ারি ব্রাহ্মণকে স্কুলের কাছে কেল্লার মাঠে ফাঁসি দেওয়া হয়। বিদ্রোহ চলাকালীন মেদিনীপুরের জনজীবনের সরস বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর রচনায়। ভারতীয় সিপাইদের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল ইংরেজি পোশাক। তাই স্কুলের শিক্ষকেরা ধুতির ওপর প্যান্ট পড়ে স্কুলের কাজ করতেন। যাতে শেখাওয়াত ব্যাটেলিয়নের কোনও সিপাইয়ের দেখা মেলা মাত্র প্যান্ট ছেড়ে ধুতিপরা বাঙালিবাবুটি সাজতে পারেন। ততক্ষণে সন্ত্রস্ত ছাত্ররা বেঞ্চের তলায়। জনসাধারণে ধারণা ছিল, এই বুঝি লাগল বিদ্রোহ! শেখাওয়াত ব্যাটেলিয়নকে মেদিনীপুর থেকে বর্ধমানে পাঠানো হলে হাঁফ ছাড়েন রাজনারায়ণেরা।

কলকাতার ব্রাহ্ম ধর্ম আন্দোলনকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুহৃদ রাজনারায়ণ মেদিনীপুরে জনপ্রিয় করে তোলেন। কলকাতার ব্রাহ্মনেতারা আমন্ত্রিত হতেন। ব্রাহ্মধর্ম বিষয়ক বক্তৃতার অধিকাংশই এই শহরে বিভিন্ন প্রার্থনাসভায় করা। এখানে বসেই শাস্ত্র ও পুরাণ ঘেঁটে ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ ও ‘ব্রহ্মসাধন’ নামে দু’টি বই লেখেন। ‘ধর্মতত্ত্বদীপিকা’ লিখতে প্রায় একযুগ সময় লেগেছিল। এই বই-ই তাঁর শরীর নষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পরে রসিকতা করে বলতেন, ‘ঐ বেটি আমাকে খেলে’।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত এবং রাজনারায়ণ হিন্দু কলেজের সহপাঠী এবং বন্ধু। মধুসূদন মেদিনীপুরে এসেছিলেন কি না জানা যায় না। রাজনারায়ণের আত্মজীবনী থেকে জানা যায়, ‘মেঘনাদবধকাব্য’-এর প্রথম তিনটি সর্গ মধুকবি ডাকযোগে রাজনারায়ণকে পাঠান। মধুসূদনের চিঠির বেশির ভাগই পান মেদিনীপুরে বসে। লেখেন ‘ইন্ডিয়ান ফিল্ড’ পত্রিকায় বন্ধুর ‘তিলোত্তমাসম্ভব’ কাব্যের আলোচনা।

১৮৬৬ সালে সহসাই প্রিয় মেদিনীপুর শহর ছেড়ে যান রাজনারায়ণ। শহরবাসী কোনও বিদায়-সংবর্ধনারও আয়োজন করতে পারেননি। পরে শহরবাসীর পক্ষে ১৬৫ জনের স্বাক্ষর করা বিদায়জ্ঞাপক অভিনন্দন বার্তা রাজনারায়ণকে পাঠানো হয়। সঙ্গে ছিল ৭০০ টাকা। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ মেদিনীপুরবাসী তাঁদের প্রিয় প্রধান শিক্ষকের জন্য একটি বসতবাড়ি নির্মাণ করে দেন। পরে তাঁর স্মৃতিতে মেদিনীপুরে গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়। রাজনারায়ণও কখনওই মেদিনীপুরকে ভুলে যাননি। আত্মকথায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যেখানেই তাঁর মৃত্যু হোক না কেন তাঁর দেহাবশেষ যেন মেদিনীপুরের গোপগড়ে সুরম্য বনবীথিতেই সমাধিস্থ করা হয়।

সম্মান পেয়েছিলেন মৃত্যুর পরেও। তাবলে কি সমালোচনার শিকার হননি ঋষি রাজনারায়ণ? তখন সুরাপাননিবারণী-সহ বেশ কিছু সভা স্থাপন করেছেন মেদিনীপুরে। তা দেখে জনৈক উকিল বলেছিলেন, এখন একটা সভানিবারণী সভার আশু প্রয়োজন!

লেখক কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজের বাংলার শিক্ষক

Rajnarayan Basu Midnapore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy