Advertisement
E-Paper

প্রয়োজন দেখতে গিয়ে আয়োজন সীমাবদ্ধ হয়নি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে

যে হারে জেলার উচ্চশিক্ষায় শ্রীবৃদ্ধির কথা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। গরিব জেলায় অসংখ্য কৃতী ছাত্রছাত্রী ফুল হয়ে ফোটার আগেই কলিতেই ঝরে যায়। ফলে, যখন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন ঘটেছে, তখন তা এক রকম আবির্ভাবে পরিণত হয়েছে। লিখছেন স্বপনকুমার মণ্ডল যে হারে জেলার উচ্চশিক্ষায় শ্রীবৃদ্ধির কথা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। গরিব জেলায় অসংখ্য কৃতী ছাত্রছাত্রী ফুল হয়ে ফোটার আগেই কলিতেই ঝরে যায়। ফলে, যখন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন ঘটেছে, তখন তা এক রকম আবির্ভাবে পরিণত হয়েছে

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:২৭
সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র

সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়। নিজস্ব চিত্র

শিক্ষার স্বাধিকার, আত্মসম্মান, আত্মপ্রতিষ্ঠার ত্রিবেণী সঙ্গমের বৃহত্তম প্রয়াগক্ষেত্র হল বিশ্ববিদ্যালয়। কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বভারতীকে বাদ দিলে, সুদীর্ঘকাল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার অবিকল্প শিক্ষাতীর্থের সমীহ আদায় করেছে। স্বাধীনতা লাভের পরে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকে যে-কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, তার অর্ধেকই কলকাতার সান্নিধ্যে স্থাপিত হয়। সে দিক থেকে কলকাতার শিক্ষা-সংস্কৃতির বনেদি আলোতে রাজ্যের প্রান্তিক জেলাগুলির ব্রাত্য পরিসর আরও যেন প্রকট হয়ে ওঠে। সেখানে রাজধানীর গরিমার আলোয় রাজধানীর সঙ্গে প্রান্তিক জেলাগুলির সুদূর ব্যবধানও আলোকিত হয়ে পড়ে। অথচ, সেই আলোর অভাববোধ জনমানসে নিবিড় হয়ে তীব্রতা লাভ করেনি। সেই প্রত্যাশার তীব্রতাকে যেমন আবেদনমুখরতায় সক্রিয় রাখা সম্ভব হয়নি, তেমনই তা সময়ান্তরে উদাসীনতায় বিমুখ হয়ে ছিল।

দেশের মানোন্নয়নে শুধু নয়, দেশের পরিচয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ সম্পর্কে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছেন, ‘একটি দেশ ভাল হয় যদি সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভাল হয়।’ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুবচনের মাত্রাই সীমায়ত পরিসরে আবদ্ধ হয়ে ছিল, তার ভালমন্দের প্রশ্ন আপনাতেই আপেক্ষিক

হয়ে পড়ে।

১৯৫৬-তে ইউজিসি-তে (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। ২০১৮-র জুলাই-তে সেই সংখ্যা নশোয় পৌঁছয়। সেই ১৯৫৬-র ১ নভেম্বর বিহারের মানভূম থেকে পুরুলিয়া নাম নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের সর্বশেষ যে জেলাটি আত্মপ্রকাশ করেছিল, তার দেহে ছিল বিচ্ছেদের ক্ষত, মনে দীর্ঘ আন্দোলনের গরিমা, আত্মায় নতুন প্রাণের পরশ। সময়ান্তরে ক্ষত শুকিয়ে যায়, গরিমাবোধে শিথিলতা চলে আসে আর নতুন প্রাণ অভ্যাসে আত্মগোপন করে। শুধু তা-ই নয়, তার বাংলাভাষাকে নিয়ে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন দেশের মধ্যে প্রথম হলেও স্বদেশেই যেন ব্রাত্য হয়ে পড়ে। দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানাবাংলার এই জেলাটি প্রান্তিকায়নের শিকার সবচেয়ে বেশি হয়ে পড়ে। সেখানে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সঙ্গে স্থানিক দূরত্বের পরিসর স্বাভাবিক ভাবেই উপেক্ষার আধারকে আরও তীব্র করে তোলে। যদিও তার স্বপ্নকে বিতাড়ন করা যায় না, সদিচ্ছাও জেগে থাকে। সেই স্বপ্নই সদিচ্ছার মাধ্যমে ২০১০-এর ৬ জুলাই জেলার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের পথচলা শুরু হয়।

শিক্ষার নেতিবাচকতা নিয়ে চর্চার পরিসর সুদূরপ্রসারী। অথচ, অগ্রসরগামী মানবসভ্যতায় শুধু টিকে থাকা নয়, সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলেও উন্নত শিক্ষার একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার অভিমুখই মানবিক। সেই মানবিক অস্তিত্বে মানবসম্পদের শ্রীবৃদ্ধিতে শিক্ষার বিকল্প নেই। সেই শিক্ষার উচ্চ সোপানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুমুখী মানবকল্যাণের হাতছানি জেলার পরিসরে তীব্র আবেদনক্ষম হয়ে ওঠে।

সে দিক থেকে যে হারে জেলার উচ্চশিক্ষায় শ্রীবৃদ্ধির কথা ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাবে তা সম্ভব হয়নি। গরিব জেলায় অসংখ্য কৃতী ছাত্রছাত্রী ফুল হয়ে ফোটার আগেই কলিতেই ঝরে যায়। ফলে, যখন সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় আগমন ঘটেছে, তখন তা এক রকম আবির্ভাবে পরিণত হয়েছে।

এই সুবাদে জেলার টুসু-ভাদু-ঝুমুর-নাচনি-ছো-এর বনেদি লোকসংস্কৃতি আধুনিক শিক্ষাশোভন নাগরিক সংস্কৃতির আলোতে নতুন করে উজ্জীবিত হওয়ার অবকাশ পেল। প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির সোপানে তার অস্তিত্ব যেমন সুরক্ষা লাভ করল, তেমনই তার বিস্তার সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠল। প্রথাগত উচ্চশিক্ষার সোপানে গবেষণার উন্মুক্ত দ্বারে তার আন্তর্জাতিক বিস্তার শুধু সময়ের অপেক্ষা। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাগত শিক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠাই প্রশস্ত করে না, আত্মিক প্রতিষ্ঠাও সুগম করে তোলে। আর সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষমুখর প্রকৃতি সবুজ হয়ে ওঠে।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যাচর্চার সবচেয়ে বড় কেন্দ্র। সেখানে বিদ্যার তাপ নয়, আলোর দিকে তার সতৃষ্ণ দৃষ্টি। পড়ুয়ার জ্ঞান আহরণের ক্ষুধাকে বাড়িয়ে তোলার স্বার্থকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন আভিজাত্য লাভ করে। কলা-বাণিজ্য ও বিজ্ঞান-সহ পনেরোটি বিভাগ নিয়ে তার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

সময়ান্তরে আরও তিনটি বিভাগ চালু হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইতিমধ্যে ছো, ঝুমুর, ‘সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ়’ ও ‘উইমেন স্টাডিজ়’-এর উপরে ডিপ্লোমা কোর্স শুরু হয়েছে। চলছে নিত্যনতুন বিষয়ের সংযোজনের ভাবনা ও জেলার ঐতিহ্যকে সুরক্ষা প্রদানের নানা আয়োজন। প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে আয়োজন সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েনি। মননের দীপ্তিতে দিগন্তবিস্তারি আলোর পরশ প্রদানে তার অভিমুখ সক্রিয় রয়েছে।

সেখানে ‘আপন হতে বাহির’ হওয়ার আমন্ত্রণে ‘উপেক্ষিত’ জেলাটি সাড়া দিয়ে চলেছে। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির হাতছানিকে সর্বার্থেই আন্তরিকতার অকৃত্রিমতায় ধরে রাখা একান্ত কাম্য।

লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক

Education Sidho Kanho Birsha University সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy