Advertisement
E-Paper

ইতিহাসের ধূসর পাতায় ভালাসের ঘোষ পরিবার

এই বংশের এক সন্তান অসমসাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী। আন্দামানে দ্বীপান্তর কাটানো সেই প্রভাতকুসুম ঘোষের একমাত্র চিহ্ন তাঁর নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভটি। প্রভাতকুসুম নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের পারিবারিক তথ্যাবলিও নিঃশেষিত। বহু সন্ধানে এই পরিবারের এক কন্যার সন্ধান পাওয়া গেল, যিনি নিজেই এখন অশীতিপর এবং শয্যাশায়ী। তাঁর কাছ থেকেই গল্প শুনলেন পাপিয়া বর্মন।এই বংশের এক সন্তান অসমসাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী। আন্দামানে দ্বীপান্তর কাটানো সেই প্রভাতকুসুম ঘোষের একমাত্র চিহ্ন তাঁর নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভটি। প্রভাতকুসুম নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের পারিবারিক তথ্যাবলিও নিঃশেষিত। বহু সন্ধানে এই পরিবারের এক কন্যার সন্ধান পাওয়া গেল, যিনি নিজেই এখন অশীতিপর এবং শয্যাশায়ী।

শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৯ ০১:২৬
প্রভাতকুসুম ঘোষের (ডানদিকে) বাড়ি। ছবি: লেখক

প্রভাতকুসুম ঘোষের (ডানদিকে) বাড়ি। ছবি: লেখক

গ্রামটির নাম ভালাস, বীরভূমের পূর্ব দিকে এর অবস্থান। বীরভূমের ভূমিপুত্র তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় আমোদপুর থেকে যে ছোট লাইনের ট্রেনে চড়ে লাভপুর যেতেন, তার আগের এক অখ্যাত হল্ট স্টেশন গোপালপুর। সেই গোপালপুর গ্রামটি রেললাইনের ডান দিকে, আর বাঁ দিকে প্রায় কিলোমিটার দু-এক হাঁটাপথে গেলেই ভালাস। এখন অবশ্য সেই মেঠো রাস্তায় পিচের আস্তরণ আর শতাব্দী প্রাচীন স্মৃতিবিজড়িত সেই ছোট লাইনও নেই। লাভপুরের এই ভালাস গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের অতীত ঐতিহ্য সন্ধানের একটা চেষ্টা করলাম।

কিন্তু যাত্রাটা নেহাত সহজ নয়।

প্রবীণ দু-একজন মনে করতে পারলেও বর্তমান ভালাস গ্রাম ওই পরিবারকে ভুলতে বসেছে। এই বংশের এক সন্তান অসমসাহসী স্বাধীনতা সংগ্রামী। আন্দামানে দ্বীপান্তর কাটানো সেই প্রভাতকুসুম ঘোষের একমাত্র চিহ্ন তাঁর নামাঙ্কিত স্মৃতিস্তম্ভটি। প্রভাতকুসুম নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁদের পারিবারিক তথ্যাবলিও নিঃশেষিত। বহু সন্ধানে এই পরিবারের এক কন্যার সন্ধান পাওয়া গেল, যিনি নিজেই এখন অশীতিপর এবং শয্যাশায়ী। তবু স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে বীরভূমের ভালাস গ্রামের অতুল ছবিখানি। বৃদ্ধা জানালেন, তাঁর প্রপিতামহের নাম মহাতাব ঘোষ। যাঁর দোর্দণ্ডপ্রতাপের কথা ভালাস গ্রামের লোকের মুখে মুখে ফিরত। তাঁদের বাড়িকে লোকে বলত নাজিরবাড়ি। সম্ভবত মহাতাব ঘোষ আদালতের চাকুরে ছিলেন। ফলে অর্থ কৌলিন্য এবং আইনি বন্দোবস্তের সঙ্গে যুক্ত পরিবারটি গ্রামের রীতিমতো সম্ভ্রান্ত ছিল মহাতাব ও মঞ্জুলালী ঘোষের দুই পুত্র ও এক কন্যা।

জমিজমার ফসল পুকুরের মাছ আশ্রিত পরিজনদের পরিচালনার দায়িত্ব সামলান মহাতাব ঘোষের স্ত্রী। সামলান বাৎসরিক দুর্গোৎসবের বিরাট দায়িত্ব। অর্থাৎ এক কথায় বনেদি একটি পরিবার। কিন্তু বনেদিয়ানার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলে শিক্ষাও। জ্যেষ্ঠপুত্র জগদীশ ছিলেন সিউড়ি জেলা আদালতের প্রতিষ্ঠিত উকিল। কনিষ্ঠ শরৎচন্দ্র ছিলেন বর্ধমান রাজ কলেজের শিক্ষক এবং মহাতাব ঘোষের একমাত্র কন্যা সুনীতি ঘোষ ছিলেন যথেষ্ট শিক্ষিতা। ভালাসের ঘোষ বাড়ির দুর্গাপুজো ছিল আশপাশের চার-পাঁচখানা গ্রামের মধ্যে বেশ জাঁকের। তবে তা নবপত্রিকা। নবপত্রিকার পুজো বলে কিন্তু আয়োজনের ত্রুটি থাকত না। কলাবউ স্নান থেকে অষ্টমী-নবমীর বলিদান বা বিজয়ার মিষ্টি মুখের বিরাট আয়োজন ছিল। অষ্টমীর বলিদানের এক অদ্ভুত রীতি ছিল। মহাতাব ঘোষের বাড়ি উপেন্দ্র কবিরাজের বাড়ি ও আর এক কায়স্থ বাড়িতে দুর্গাপূজা হতো। সেই তিন বাড়ির বলি দিতেন একজন ব্যক্তি বংশ পরম্পরায়।

যাই হোক মহাতাব ঘোষের মৃত্যুর পর বংশের মাথা হয়ে ওঠেন বড় ছেলে জগদীশ চন্দ্র ঘোষ। উল্লেখ্য, ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’য় অভিযুক্ত জগদীশ ঘোষ আর ইনি এক ব্যক্তি নন। জগদীশচন্দ্র বিবাহ করেন, সম্ভবত স্ত্রীর নাম আশালতা। সম্ভবত বলার কারণ আশালতা প্রথম সন্তান প্রভাতকুসুমের জন্ম দিয়ে মারা যান। জগদীশ দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন বীণাপানি ঘোষকে। এদের পাঁচটি কন্যা সন্তান। বর্তমানে একমাত্র মুক্তিরানী জীবিত। যাঁর কথা গোড়াতেই বলেছি।

অন্য দিকে শরৎচন্দ্র বিবাহ করেন সরযুবালা ঘোষকে এদের দুই কন্যা ও এক পুত্র অশোক ঘোষ। এ বার মহাতাবের ছোট ছেলে আসি শরৎচন্দ্রের কথায়। অসাধারণ মেধাবী শরৎচন্দ্র ছিলেন বর্ধমান রাজ কলেজের অধ্যাপক। বৃদ্ধা মুক্তিরানী মনে করতে পারেন, তাঁদের কাকা কর্ণার্জুন নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয়ে গবেষণা করার পরেও সেই গবেষণা অন্য কেউ নিজের নামে প্রকাশ করায় মনে জোর ধাক্কা খেয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। লুম্বিনী মানসিক হাসপাতালে দীর্ঘদিন ভর্তি থাকেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র প্রভাতকুসুম তাঁকে ভালাসের বাড়িতে নিয়ে আসেন। সেখানে তিনি মারা যান।

প্রভাতকুসুম—ভালাসের ঘোষ পরিবারের এক উজ্জ্বলতম অধ্যায় রচনাকারী। ছাত্রাবস্থাতেই জড়িয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। সেখানে গড়ে ওঠা সাবিত্রী ক্লাবের সদস্য ছিলেন। তাঁর বাবা জগদীশচন্দ্রের প্রতিষ্ঠিত বীরভূম জেলা যুবসমিতিতেও যোগ দেন। পরে যা এনএসআরএ-তে পরিবর্তিত হয়। ইতিহাস বলছে, সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী এই ছাত্রদল অস্ত্র ও অর্থ সংগ্রহে ব্রতী হন। স্বদেশি ডাকাত নামে পরিচিত ছিল এই দলটি। তিরিশের দশকের একেবারে শুরুর দিকে কিছু ডাকাতির ঘটনায় এই দলের নাম জড়ায়। পরে পুলিশ তাদের গোপন আস্তানার সন্ধান পায়। বেশ কিছু অস্ত্র, কাগজপত্র, বোমার মশলা ওই ডেরা থেকে উদ্ধার হয়। পুলিশ যে ৪২ জনের নামে অভিযোগ আনে, প্রভাতকুসুম তাঁদের অন্যতম। ১৯৩৪ সালে ২১ জনের নামে রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা আনা হয় যা ‘বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। বিপ্লবীদের পক্ষে যাঁরা মামলা লড়ার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং জগদীশ চন্দ্র ঘোষ, প্রভাতকুসুমের বাবা। ১৯৩৪-এর সেপ্টেম্বরে মামলার রায়ে ১৭ জনের সশ্রম কারাদণ্ড ঘোষিত হয়। এঁদের মধ্যে ১০ জনকে ‘বিপজ্জনক বিপ্লবী’ আখ্যা দিয়ে আন্দামান সেলুলার জেলে নির্বাসিত করা হয়। দ্বীপান্তরিত প্রভাতকুসুমের সাজার মেয়াদ ছিল সাত বছর। আশি ছোঁয়া মুক্তিরানীর তখন জন্মই হয়নি!

পরে গল্প শুনেছেন তাঁর দাদা প্রভাতকে পুলিশের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাবা জগদীশ সস্নেহে বলেছিলেন, ‘‘ঘুরে এসো। আন্দামান তো আগে দেখোনি। আর চিন্তা করো না। আমি ভালো থাকব, অপেক্ষায় থাকব।’’ শুনতে শুনতে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। এমন পিতা না হলে এমন পুত্র হত কি?

দ্বীপান্তরের অত্যাচারের মধ্য থেকেই জন্ম হয় এক নতুন প্রভাতকুসুমের। জেলে বসেই মার্কসবাদে দীক্ষিত হন প্রভাত। নারায়ণ রায়ের কাছে। দ্বীপান্তর থেকে ফিরে আসেন যে প্রভাত, তিনি এক অন্য মানুষ। স্থিতিশীল প্রাজ্ঞ সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখা প্রভাতই তাঁর ছোট বোনের নামকরণ করেন। মুক্তিরানী।

প্রভাতকুসুম আন্দামান থেকে ফিরে নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। ভর্তি হন বর্ধমান রাজ কলেজে এবং এখানেই পরিচিত হন হরেকৃষ্ণ কোঙারের সঙ্গে। যিনি নিজেও সেলুলার জেলে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন এবং সেখানে তাঁরও মার্ক্সবাদে দীক্ষা। হরেকৃষ্ণবাবুর প্রভাবে প্রভাতকুসুম তৎকালে ‘বেআইনি’ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কলেজ পাশ করে সরকারি চাকরিও পান। ইতিমধ্যে প্রভাত বিয়ে করেছেন ভালবেসে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার স্ত্রী স্বর্ণপ্রভা ছিলেন প্রকৃতার্থে তার সহধর্মিণী। নিঃসন্তান প্রভাতকুসুম চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করে পাকাপাকি ভাবে বাস করতে শুরু করেন ভালাস গ্রামে। আজীবন শহুরে স্বাচ্ছন্দ ভোগ করা স্বর্ণপ্রভাও স্বামীর সঙ্গে হয়ে ওঠেন ভালাসের ঘোষ পরিবারের ঐতিহ্য বহনকারী বধূ। প্রভাতকুসুম ভারত সরকারের কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের মানপত্র পান। আন্দামানের সেলুলার জেলে আজও জ্বলজ্বল করছে তাঁর নাম। কিন্তু মাটির সঙ্গে তাঁর যে নিবিড় সখ্য। তাই তো পারিবারিক ঐতিহ্য আর মানবপ্রীতি একই সঙ্গে বহন করেছেন তিনি। ভালাস গ্রামের উন্নতিতে যে প্রভাত নিরলস, পারিবারিক নবপত্রিকার বোধন তাঁরই উদ্যোগ। মা বীণাপানি আর পাঁচ বোনের অভিভাবক হয়ে আজীবন কাটিয়েছেন ভালাস গ্রামে। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৮৪ সালে। স্বর্ণপ্রভার উদ্যোগে তাঁর স্মৃতিস্তম্ভটি গড়ে ওঠে।

প্রভাতকুসুমের কাকিমা, শরৎচন্দ্রের স্ত্রী আজ গত হয়েছেন। কন্যারা বিবাহ সূত্রে অন্যত্র। ঘোষ বংশের একমাত্র জীবিত পুত্র সন্তান শ্রী অশোক ঘোষ অসুস্থ। কোনও এক বৃদ্ধাশ্রমে কাটাচ্ছেন জীবনের বাকি দিনগুলো। একমাত্র বৃদ্ধা মুক্তিরানী কোনও এক জাদুমন্ত্রে তাঁর পিত্রালয়ের অমূল্য তথ্য আজও ধরে রেখেছেন নিজের স্মৃতির মণিকোঠায়।

(লেখক শিক্ষিকা এবং সাহিত্যকর্মী)

History Freedom Fighter Family
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy