ভরসা: যে বসিরহাট অশান্ত, তারই গোয়ালপোতার বর্মা কলোনিতে হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে খিচুড়ি রান্নার তোড়জোড় চলছে। নিজস্ব চিত্র
এক শতাব্দীরও আগের কথা। ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলমান যখন ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী, পরস্পরের সুখ-দুঃখ নানা সূত্রে বিজড়িত, একের গৃহে অগ্নি লাগিলে অন্যকে যখন জল আনিতে ছুটাছুটি করিতে হয়, তখন শিশুকাল হইতে সকল বিষয়েই পরস্পরের সম্পূর্ণ পরিচয় থাকা চাই। বাঙালি হিন্দুর ছেলে যদি তাহার প্রতিবেশী মুসলমানের শাস্ত্র ও ইতিহাস এবং মুসলমানের ছেলে তাহার প্রতিবেশী হিন্দু শাস্ত্র ও ইতিহাস অবিকৃতভাবে না জানে তবে সেই অসম্পূর্ণ শিক্ষার দ্বারা তাহারা কেহই আপন জীবনের কর্তব্য ভালো করিয়া পালন করিতে পারিবে না।”
রবীন্দ্রনাথ তো সেই কবেই আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাঁর সেই সতর্কবার্তায় ছিল আশু বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার দিশাও। তবু তাকে হৃদয়ের কর্তব্য করতে পারিনি আমরা। তাই এত দিনের সুখদুঃখের পড়শি আজও আমাদের কাছে এত অচেনা। আর তাই মা-মরা, দিনমজুর বাবার সেই সতেরো বছরের কিশোরের মন কবে, কারা এত সহজে এমন বিষিয়ে তুলল, তার খবরও আমরা রাখিনি। ধূলাগড় থেকে বাদুড়িয়া— আমাদের একটা মস্ত ফাঁকি সারা দুনিয়ার সামনে আজ উজাড় হয়ে গিয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি বিকৃত পোস্ট শেয়ার করে কিশোরটি একটি বিশেষ ধর্মের প্রতি, তার অনুসরণকারীদের প্রতি চরম অশ্রদ্ধা প্রকাশ করল। অমনি আপনিও পাল্টা লোকলশকর নিয়ে কিশোরটিকে উচিত শিক্ষা দিতে পথে নামলেন। পথে নামালেন আরও অনেক কিশোর, এমনকী শিশুকেও। তারই মতো। অথচ তার দু’দিন আগেই হয়তো তারা এক ঘরে ক্লাস করেছে। বঙ্কিম পড়েছে, জসীমউদ্দিন পড়েছে। একে অপরের উপরে রাগ-অভিমান-হিংসা করেছে। আর তাদেরই আপনারা এ কোন রক্তের খেলার সঙ্গী করে তুললেন?
বাদুড়িয়ার কিশোরের, তাকে পাল্টা দিতে গ্রাম ঘিরে ফেলা কিশোরের মনের আঁধার এখনও দূর করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু, আপনার? আপনারা, যাঁরা আদতে পরিকল্পনা করে ওই কিশোরদের মনে ঘৃণার বীজ বুনে চলেছেন, আপনাদের কথা ভেবেই কষ্ট হচ্ছে। আপনাদের তো সে সুযোগও নেই। আপনি ভাবেন ওরা গরুখোর, বাচ্চা পয়দা করার যন্ত্র। ওরা মরা ঠাকুরের পুজোয় মাতে, ওদের মেয়েগুলো সব বেহায়া। আপনি ওদের দাড়ি দেখলেই সিঁটিয়ে যান, বাংলাদেশি বলে গালি পাড়েন। রাস্তা জুড়ে নমাজ, সবুজ পতাকা দেখলেই পাকিস্তানের আতঙ্কে কাঁপেন। ওদের ছেলের প্রেমে পড়লে লজ্জা-ভয়ে মৌলবি ডেকে আত্মীয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে মেয়েকে পত্রপাঠ বিদায় দেন। আগে সিপিএম করতেন, এখন তৃণমূল করেন, সুযোগ পেলে বিজেপি— আসলে ভেতরে ভেতরে এটাই আপনি। আপনারাই কেউ ইসলামোফোবিক, কেউ হিন্দুফোবিক। আপনারা জুনেইদেও আছেন, শৌভিকেও।
অথচ গল্পটা আর এক রকমও হতে পারত। রবীন্দ্রনাথ তো তেমনটাই চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন, আমরা একে অপরের শাস্ত্র-ইতিহাসকে জানি, চিনি। দুঃখের কথা হল, আমরা নিজেদেরগুলোই আজও জেনে উঠতে পারলাম না। নইলে ওই কিশোরের ফেসবুক পোস্টের প্রতিবাদে যারা হাঙ্গামা পাকানো শুরু করল, তাদের কেউ কানে ধরে তায়েফ শহরে হজরত মহম্মদের ধর্ম প্রচারে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথাটা শুনিয়ে দিতে পারতেন। প্রাণের কাকা আবু তালিব ইবন আব্দ আল-মুত্তালিব এবং স্ত্রী হজরত খাদিজার মৃত্যুর পরে মক্কা শহরে একা হয়ে পড়েছিলেন নবি। সে সময় মক্কার অভিজাত শ্রেণির আক্রমণের মুখে পড়েন তিনি। এমনকী, শিশুরাও তাঁকে অপমান করত ছাড়েনি। মনের দুঃখে মক্কা ছেড়ে তায়েফ শহরে গেলেন। সেখানে ইসলামের প্রচার করতে গিয়ে শহরবাসীর (বিশেষ করে শিশুদের) কাছে চরম নির্যাতনের মুখে পড়লেন। শহরের নানা প্রান্তে তাঁকে হেনস্তা করা হল, পাথর ছুড়ে মারা হল। রক্তাক্ত হজরত মহম্মদকে তখন মালিকের নির্দেশে নিজের কুটিরে আশ্রয় দিয়ে সেবা করে সারিয়ে তুললেন এক খ্রিস্টান দাস। কই, নবি তো লোক জুটিয়ে তায়েফ ধ্বংস করেননি! তাঁর উপরে অত্যাচার চালানো মানুষগুলোকে কোনও কঠিন শাস্তিও দেননি। উল্টে, তায়েফবাসীকে অভিশাপ দিতে অস্বীকার করেছিলেন, তাঁদের জন্য প্রার্থনাও করেছিলেন।
তা হলে বসিরহাটে কোন ইসলাম, কোন নবিকে ‘রক্ষা’ করলেন আপনারা? নবির সম্মান এতই ঠুনকো যে, একটি কিশোরের ফেসবুক পোস্টে তা নষ্ট হয়ে যাবে?
একটা বড় বিপদ কড়া নাড়ছে। তার দাপটে বাংলার এত যুগের সংস্কৃতি ধুয়ে মুছে যাওয়ার আগে কড়া নাড়ুন শৌভিকদের বাড়িতে। অস্ত্র নয়, হাতে ফুল নিয়ে যান। যত নোংরা, ঘেন্না ভরা পোস্টই ওরা করুক না কেন, ওই শৌভিকেরাই আমাদের জোরের জায়গা হতে পারে। ওদের এত সহজে আমাদের দুর্বলতা করে তুলবেন না। ভোটে মুনাফা লোটা কারবারিদের এজেন্ট হতে দেবেন না। সোশ্যাল মিডিয়াই হোক বা শহর কিংবা গ্রামের রাস্তা— অযৌক্তিক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে বিভেদকামীদের খেলাটাকে আরও সহজ করে দেবেন না।
এখনও আশা আছে। আজও শৌভিক আর মহসিনদের ঘরের আগুন নেভাতে কারা ছুটে যায়, সে খবর কারও অজানা নয়। রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখ দুটো আলাদা পৃথিবীর মানুষ ছিলেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন, শৌভিক আর মহসিনদের আপনি কতটা চেনেন। তাদের চিনতে আপনি কী করেছেন। মুক্তির পথ কিন্তু কিশোরেই। নন্দিনীকে সে-ই রক্তকরবী এনে দেয়। রঞ্জনের নয়, কিশোরের মৃত্যুর খবর জানার পরেই রাজার বিরুদ্ধে সমস্ত শক্তি নিয়ে লড়ার কথা ঘোষণা করেছিল নন্দিনী। কিশোরের হত্যাকারী কে? প্রশ্ন করুন।
রাজনীতি আপনার মাথা খাওয়ার আগে রাজনীতির মাথাটাই আপনি ধরুন।
ফলতা সাধনচন্দ্র মহাবিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy