Advertisement
E-Paper

বাংলার চাই ধ্রুপদী মর্যাদা

বাংলা ভাষার গর্ভগৃহে একটি ধাঁধা হাজির হয়েছে গত কুড়ি বছরে। সোনার পাথরবাটিতে ভাসমান একটি সার্টিফিকেট, যেখানে বলা হয়, পৃথিবীতে বাংলা ভাষা হল পঞ্চম ভাষা।

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৭ ১৩:৩০
ছবি: সুব্রত চৌধুরী

ছবি: সুব্রত চৌধুরী

বাংলা ভাষার গর্ভগৃহে একটি ধাঁধা হাজির হয়েছে গত কুড়ি বছরে। সোনার পাথরবাটিতে ভাসমান একটি সার্টিফিকেট, যেখানে বলা হয়, পৃথিবীতে বাংলা ভাষা হল পঞ্চম ভাষা। প্রথম ম্যান্ডারিন (চাইনিজ), দ্বিতীয় ইংরেজি, তৃতীয় স্প্যানিশ, চতুর্থ আরবি। বাংলা কখনও কখনও পঞ্চম, আবার হিন্দি কখনও কখনও পাঁচে চলে আসে। বাংলা বলতে পারে পঁচিশ কোটি লোক, কিন্তু বলে না। আর একটু ঝেড়ে কাশি। পঁচিশ কোটি লোক যদি বলত, লিখত এবং পড়ত, তা হলে বাংলা ভাষার পিঠ আজকে দেওয়ালে লেগে যেত না। শুধু বালিগঞ্জে নয়, সারা পশ্চিমবঙ্গের মায়েরা স্কুলের সামনে সিঁড়িতে সিঁড়িতে বসে আছেন ছেলে ইংরেজি শিখে বায়রন হয়ে বেরিয়ে আসবে বলে। অনেক বাবা-মা বলেন, বাংলা তো লাগে মুদিখানার দোকানে আর মাছ কিনতে, বিভূতিভূষণ কোন কাজে লাগবে?

যদি জার্মানি গিয়ে পড়তে চান, জার্মান জানতে হবে। যদি ফ্রান্সে গিয়ে পড়তে চান, ফরাসি জানতে হবে। কোনও মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান, আপনি ইংরেজিতে পিএইচ ডি করে থাকলেও আপনাকে ‘টেস্ট অব ইংলিশ অ্যান্ড ফরেন ল্যাংগোয়েজ’ পরীক্ষা দিতে হবে। তখন কই কাউকে গাঁইগুঁই করতে শুনি না তো! কেউ যদি বাংলায় থেকে বাংলার স্কুলে পড়াশুনো করতে চান, যদি তাঁকে বাংলা পড়তে হয়, তা হলেই বলতে হবে ‘চাপিয়ে দেওয়া হল’? সোশ্যাল মিডিয়াতে গত দু’দিন এই ভণ্ডামির চূড়ান্ত দেখা গেল।

আজ সবচেয়ে খুশি হতেন কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সব স্কুলে বাংলা চালু করতে হবে বলে তিনি রাস্তায় নেমেছিলেন। সব সাইনবোর্ডে, বিলবোর্ডে বাংলা রাখতে হবে বলে একাধিক বার মিছিল করেছেন। তদানীন্তন রাজ্য সরকারকে বার বার বলেছেন, হাতে-পায়ে ধরেছেন, ‘হবে হবে’ বলে আশ্বাস পেয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি। সুনীলের নেতৃত্বে বহু কবি-লেখক সেই ভাষা-মিছিলে অংশ নিয়েছেন। কার্জন পার্কে দাঁড়িয়ে দুটো টিভি চ্যানেলকে (তখন দুটোই ছিল) বাইট দিয়ে বলেছিলেন, ‘চার পাশে তাকিয়ে দেখুন, কোনও বাংলা নেই।’ মিছিল গিয়ে ঢুকল গ্র্যান্ড হোটেলে, অবাঙালি ম্যানেজার বেরিয়ে এলেন, সব শুনলেন, টাই ঠিক করে নিয়ে বললেন, ‘নো প্রবলেম, কাল থেকেই আমরা বাংলায় লিখে দেব গ্র্যান্ড হোটেল। আগে কেউ বলেনি, বললে আগেই লিখতাম।’ এই সাফল্যে শিশুর মতো উজ্জীবিত হয়ে এর পর আরও তিনটে দোকানে ঢুকলেন, এক জন বাঙালি মালিক ভ্রুপল্লবে বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘দেখি কী করা যায়, দোকান সামলাব না বাংলা লিখব? বাংলায় লিখলে কি আমার বিক্রি বেশি হবে?’

বাংলা ভাষা যে ভাবে গত দু’দশকে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সেখান থেকে ভাষাটিকে তুলে বসাতে হলে সব স্কুলে বাংলা চালু করাটা ছিল সবচেয়ে জরুরি। একটা বিমানকে আকাশে উঠতে গেলে যেমন রানওয়ে দিয়ে দৌড়তে হয়, এই স্কুলগুলো হল আসলে একটা ভাষার রানওয়ে। রানওয়েতে যা পড়বে, তা-ই উঠে দাঁড়াবে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, ত্রি-ভাষা চালু হলে বাচ্চাদের ওপর চাপ পড়ে যাবে না? কথা হচ্ছে এই যে, কোনও মানুষ ভাষা নিয়ে জন্মায় না। মাতৃভাষাও তাকে শিখতে হয়। যে কোনও ডাক্তার বলবেন যে, একটা তিন বছরের ছেলেকে তিব্বতে রাখুন কিংবা কোস্টারিকায় রাখুন, সে কান দিয়ে যা শুনবে, মাথার হার্ড ডিস্কে সেটা জমাবে, এবং মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসবে। হয় তিব্বতি, কিংবা স্প্যানিশ। বাচ্চারা আমাদের চাইতে অনেক দ্রুত ভাষা রপ্ত করতে পারে। যাঁরা ভাবছেন, ক্লাস ওয়ান থেকে চালু হলে চাপ পড়বে, তাঁরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলুন। ক্লাস ওয়ানেই তিনটে কেন, চারটে ভাষাও শেখা যায়। ক্লাস ওয়ানে পড়া ছেলেটির বাবাকে তিনটে কেন, একটা ভাষাও শেখানো রীতিমত কষ্টকর। চিনা আর জাপানি ভাষা এখন আমেরিকাতে একটা ‘ক্রেজ’-এ পরিণত। যে হারে আমেরিকান বাচ্চারা চিনা শিখছে, অচিরেই আমেরিকা চিন হয়ে যাবে। হাতের মুঠো, রাস্তার গাড়ি, রেস্তোরাঁর খাবার— সবই চিনা। ভাষা তো এগুলো ধরেই ঘরে ঢোকে। এগুলো ধরেই ইংরেজি ঢুকেছে আমাদের রক্তে। ইংরেজি বলতে পারলে আমরা যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করি, সেটা বাংলা বলে কখনওই পাই না, এটাকেই বলে আত্মাহুতি। নিজের কাটা ঘায়ে লেবু-নুন ফেলে লেহন করার মতো গরল আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি।

সব স্কুলে বাংলা পড়ানো হলে রাতারাতি বাংলা ভাষার গৌরব বেড়ে যাবে, এমন আমি বলছি না। বাংলা ভাষাকে যাঁরা অপমান করেন, তাঁরা অবাঙালি নন, তাঁরা বাঙালি। আমি বিহারে কিংবা বেঙ্গালুরুতে গিয়ে বাংলা ভাষা নিয়ে কোনও তাচ্ছিল্য শুনিনি। কিন্তু হাজার হাজার বাবা-মা’কে নাক বেঁকাতে দেখেছি বাংলা শুনে। আসলে একটা ভাষার মর্যাদা তৈরি হয় তার জিনিয়াসদের ওপর। ক’টা লোক ইংরেজি বলত এলিজাবেথের যুগে? শেক্সপিয়র তো একটা ছোট জনজাতির জন্য লিখেছিলেন, যার নাম ব্রিটিশ। তিনি তো সে দিন গ্লোবাল পৃথিবীর জন্য লেখেননি। তিনি তো আর এটা ভেবে লেখেননি যে তাঁর ম্যাকবেথ সাঁওতালিতে হবে, বোরো-তে হবে হ্যামলেট। কিন্তু আজ ইংরেজি থেকে শেক্সপিয়রকে সরিয়ে নিন, ফরাসি থেকে ব্যোদলেয়রকে সরিয়ে নিন, জার্মান থেকে কাফকাকে সরিয়ে নিন, ইতালিয়ান থেকে দান্তেকে সরিয়ে নিন এবং যদি বাংলা থেকে সরিয়ে নেন রবীন্দ্রনাথকে, তা হলে ভাষাগুলোর মর্যাদা তলানিতে এসে ঠেকবে।

একটা প্রজন্ম এসে গেছে, যারা সারা ক্ষণ খুটখুট করে চলেছে ফোন নিয়ে, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছে ইংরেজিতে, ই-মেল লিখছে ইংরেজিতে, বই পড়ছে ইংরেজিতে, গান শুনছে ইংরেজিতে, তারা তো এর পর বাংলা পড়বে ইংরেজিতে। তাদের জন্য বাংলা সাহিত্য লেখা হবে ইংরেজিতে। ইংরেজি, হিন্দি, গুরুমুখি, নেপালি, ভোজপুরি প্রতিটি ভাষা একটা অপার্থিব সৃষ্টি, চাইলেই কালকে একটা ভাষা তৈরি করা যায় না। রাঁচি থেকে কক্সবাজার, কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, ভাগলপুর থেকে করাচি— যে বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যে বাংলা ভাষা হাজার-অধিক বছর কালসীমা অতিক্রম করে আমাদের কাছে এল, তা আমরা দুটো-তিনটে দশকের ক্ষুদ্র সময় পরিধির হঠকারিতার সামনে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যাব?

আলোচনা করে, আইন করে, আইন বলবৎ করে যদি বাংলাকে সব স্কুলে আবশ্যিক করা যায়— তার একটা সুন্দর প্রভাব পড়বে বিহার, ঝাড়খণ্ড, অসম, ত্রিপুরা, মেঘালয় এবং বাংলাদেশে। বাংলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠবে নতুন ভাষা-মানচিত্র, যা এক দিন ইংরেজি করেছিল ইউরোপে। উল্লেখযোগ্য হল, ইউরোপের ভাষা-মানচিত্রের সঙ্গে ভারতের ভাষা-মানচিত্রের বিস্ময়কর মিল।

এ বার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে। বাংলা ভাষাকে ‘ধ্রুপদী’ ভাষার মর্যাদা দিতে হবে। দেশ-বিদেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘টেগোর চেয়ার’ স্থাপন করা যাবে। আমি সরেজমিনে দেখে এসেছি, আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্রনাথের একটা মূর্তি ছিল, সেটা এখন হাওয়া হয়ে গেছে। ক্লিন্টন বি সিলি, উইলিয়াম রাদিচে, নটকোয়াভা ব্লাঙ্কা, মার্টিন কেম্পসন, ক্যারোলিন রাইট, পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে বাংলাকে ভালবেসে, বাংলা ভাষাকে বুকে করে বেঁচে আছেন এমন অনেকে। এঁদের দেখে এগিয়ে আসবেন নতুন সময়ের সাহেব-মেমসাহেবরা, বাংলা ধ্রুপদী হলে আমরা তাঁদের আতিথ্য দিতে পারব। ভারত সরকার ইতিমধ্যে তামিল, তেলুগু, মরাঠি, ওড়িয়াকে ধ্রুপদী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে। সেই তালিকায় বাংলা থাকবে না? ওড়িয়া পেতে পারে, আর বাংলা পাবে না, এমন হয় নাকি? সব স্কুলে বাংলা চালু করে রাজ্য সরকার একটা আন্দোলন শুরু করে দিল। এ বার বাংলাকে ‘ধ্রুপদী’ মর্যাদা দেওয়ানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে বাঙালিকে। ভারত সরকার ওড়িয়াকে দেবে, দিক, কিন্তু দিনের পর দিন চুপ করে থাকবে বাংলা নিয়ে, এমন চলতে পারে না। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই আবার এগিয়ে আসতে হবে।

সিটি কলেজে ইংরেজির শিক্ষক

Language Bengali Language Mother Tounge Status
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy