ভাঙচুরের সংস্কৃতি বাঙালির মধ্যে নূতন নহে। দীর্ঘ কাল ধরিয়াই তাহা স্বমহিমায় উজ্জ্বল। তবে কালক্রমে তাহাতে এক অন্য মাত্রা যোগ হইয়াছে। পূর্বে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ সচরাচর দেখা যাইত রাজনৈতিক কারণ ঘিরিয়া। কিন্তু এখন তাহা রাজনীতির গণ্ডি ছাড়াইয়া বৃহত্তর পরিসরেও বিস্তৃত। যে কোনও স্থানে যে কোনও উপলক্ষে ধ্বংসকাণ্ড এখন এ রাজ্যে অতি স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত। বুধবারের সোদপুর স্টেশন ইহার সাম্প্রতিকতম নিদর্শন। একটি ভুল ঘোষণাকে কেন্দ্র করিয়া ব্যস্ত সময়ে রেল অবরোধ তো বটেই, যথেচ্ছ ভাঙচুর, লুটপাটও চলিয়াছে। লুটের হাত হইতে হকাররাও রেহাই পায় নাই। তুচ্ছ কারণে রেল অবরোধ, বিক্ষোভ প্রদর্শন এই রাজ্য বহু বার দেখিয়াছে। কিন্তু তাহা এতটা ধ্বংসাত্মক রূপ লইত না। ইহা বিক্ষোভ নহে, গুন্ডামি। রাজ্যব্যাপী এমন গুন্ডামির নজির ক্রমবর্ধমান। যে কোনও কারণকে কেন্দ্র করিয়া আইন নিজ হস্তে লওয়া এবং অরাজক অবস্থা সৃষ্টি করাই এখন নিয়ম। পুলিশ-প্রশাসনকে অবিলম্বে গুন্ডামি বন্ধে পদক্ষেপ করিতে হইবে। তাহা না হইলে রাজ্য হইতে আইনশৃঙ্খলার বিদায় লইতে সময় লাগিবে না।
কিন্তু এই বিধ্বংসী বিক্ষোভকে অহেতুক বলিলে সত্যের অপলাপ হইবে। ট্রেনের চলাচল সম্পর্কিত ভুল ঘোষণার যে অভিযোগকে ঘিরিয়া অশান্তির সূত্রপাত, তাহা অত্যন্ত সঙ্গত। অথচ বিভিন্ন স্টেশনে প্রায় প্রতিনিয়তই এমন ঘটনা ঘটিতেছে। অফিসটাইমে, ব্যস্ত স্টেশন চত্বরে ঘোষণায় এমন ভুল হইলে পরিণাম কী হইতে পারে, তাহা রেলকর্তাদের অজানা নহে। তবুও বাড়তি সতর্কতা লওয়া হয় নাই। কখনও হয় না। যেমন মুম্বইয়ের এলফিনস্টোন স্টেশনে পদপিষ্ট হইবার মর্মান্তিক ঘটনার পরও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনও শেষ মুহূর্তে ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম বদল চলিতেছে। একেই ভারতীয় রেল সময়সূচির কদর করতে বহু কাল ভুলিয়াছে, অনুসন্ধান কক্ষ হইতে হামেশাই কোনও সন্ধান মিলে না। তাহার উপর বিনা ঘোষণায় ট্রেন বাতিল, স্টেশনে ট্রেন সংক্রান্ত দুঃশ্রব ও দুর্বোধ্য ঘোষণা যাত্রীদের নিত্যসঙ্গী। অথচ এই দেশে দূরদূরান্তে যাতায়াতের জন্য কোটি কোটি মানুষের নিকট ট্রেনই একমাত্র ভরসা। প্রসঙ্গত, এক কালের নিয়মনিষ্ঠ সুশৃঙ্খল কলিকাতা মেট্রোও ইদানীং অব্যবস্থাতেই গা ভাসাইয়াছে। ফলত যাত্রিবিক্ষোভ ‘কলিকাতার গর্ব’টিকেও ছাড়ে নাই।
এমন অব্যবস্থার মূল কারণ, ‘পরিষেবা’ নামক বিষয়টির মর্যাদা সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। প্রতি বৎসর বাজেটে পরিষেবা বৃদ্ধির দিকে নজর দিবার কথা ঘটা করিয়া ঘোষণা হইলেও কার্যত কিছুই হয় না। অথচ যাত্রী এবং ট্রেনের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাইতেছে। কিন্তু ভদ্র ভাবে সেই ট্রেনে চড়িয়া কিছু দূর যাইতে হইলে ন্যূনতম যে বিষয়গুলির প্রয়োজন, তাহার বন্দোবস্ত নাই। মান্ধাতার আমলের ব্যবস্থা এবং অলস দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া ধুঁকিতে ধুঁকিতে রেল চলিতেছে। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর যুগে তাহার চাকচিক্য কিছু বাড়িলেও পরিষেবার হাল বিপুল চাহিদার তুলনায় অতি অকিঞ্চিৎকর। ফলে, যাত্রীদের অসন্তোষ স্বাভাবিক। কিন্তু হাতে পাথর তুলিলেই তাহার সমাধান মিলিবে না। সমাধান খুঁজিবার দায়িত্বটি প্রাথমিক ভাবে অবশ্যই রেল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, দায়িত্ব যাত্রীদেরও বটে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy