Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

বুঝি না, বুঝতে পারি না, চাইও না

বহু দিন যাবত্ রবীন্দ্রনাথকে আমরা এক দেবতা করে রেখেছি। আর এখন আবার তাঁকে তৃতীয় শ্রেণির মেলোড্রামার নায়ক প্রতিপন্ন করছি। বাঙালির কোনও তুলনা নেই।রবীন্দ্রনাথের লেখালিখি বাঙালি মন দিয়ে পড়ুন আর নাই পড়ুন, ইদানীং ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৌতূহল নতুন করে ‘উসকে’ উঠেছে। তাঁর প্রতি আগ্রহের বিশেষ এক অভিমুখ সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। তাকে বলা চলে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রণয়জীবন’।

বিশ্বজিৎ রায়
শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

রবীন্দ্রনাথের লেখালিখি বাঙালি মন দিয়ে পড়ুন আর নাই পড়ুন, ইদানীং ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের প্রতি কৌতূহল নতুন করে ‘উসকে’ উঠেছে। তাঁর প্রতি আগ্রহের বিশেষ এক অভিমুখ সম্প্রতি তৈরি হয়েছে। তাকে বলা চলে রবীন্দ্রনাথের ‘প্রণয়জীবন’। এই নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা, লেখালিখি, সিরিয়াল, সিনেমা চোখে পড়ছে। এই আগ্রহ ও ঔৎসুক্য নিয়ে ‘গেল গেল’ রব তোলার মানে হয় না। রবীন্দ্রনাথ নিজেকে কখনও ‘সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী’ বলে ঘোষণাও করেননি। কিন্তু হঠাৎ করে বাঙালি কেন রবীন্দ্রনাথের ‘প্রণয়জীবন’ সম্বন্ধে এমন অতি-আগ্রহী হয়ে উঠল তা একটু বিচার করা দরকার। সেই দশচক্রে রবীন্দ্রনাথের দশাই বা কী হল, তা-ও কিন্তু ভাবার সময় এসেছে।

হালের বাঙালির রবীন্দ্রপ্রণয় বিষয়ক এই সরবতাকে একটা ‘বিপরীত প্রতিক্রিয়া’ বলা চলে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আশ্রম বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, আলখাল্লা পরা দাড়িওয়ালা গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের ছবি বাঙালির চোখে ও মনে ভাসে। এই মানুষটিকে প্রায় অপার্থিব ভাববাদী ঠাকুর হিসেবে ভাবতে অনেক বাঙালিই ভালবাসেন। মনে করেন, তাঁর প্রেম-ভালবাসা নিয়ে ভাবাও ঘোরতর পাপ। তাঁর প্রেমের কবিতাকে, অদেহী রূপকের মাধ্যমে সীমা-অসীমের তত্ত্বে বিচার করে তাঁরা রবীন্দ্রনাথকে নিরাপদে রক্ষা করেন। এই শুচিবায়ু একদা বাঙালি সমাজে প্রবল ছিল বলেই হয়তো ইদানীং তারই বিপরীত প্রতিক্রিয়া চোখে পড়ছে। এখানে বাজারের একটা বিরাট ভূমিকা আছে। কবি রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন এ বাজারের উপাদেয় খাদ্য।

রবীন্দ্রজীবন নারীশূন্য নয়। প্রতিভাবান সুরসিক সুদর্শন মানুষটির সঙ্গসুখ লাভে দেশবিদেশের বহু মানুষই আগ্রহী ছিলেন, আগ্রহী ছিলেন গুণমুগ্ধ রমণীরা। রবীন্দ্রনাথও জীবনবিমুখ ছিলেন না। পৃথিবীর বিচিত্র জীবনধারাকে উপভোগ করতে চান যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথের জীবনকে হাল আমলের বঙ্গজ শিল্প-সংস্কৃতির উৎপাদকরা অদেহী প্রেমের বিপরীত প্রতিক্রিয়ার সূত্রে ফুলে-ফেঁপে ওঠা সংস্কৃতির বাংলা বাজারে দেহীপ্রেমের গল্পগাছার বিষয় তো করতে চাইবেনই। কাদম্বরী, ওকাম্পো, রাণু— এই তিন জনের নাম বিশেষ ভাবে ফিরে ফিরে আসছে। বিশেষ করে কাদম্বরী দেবীর। কারণ তাঁর আত্মহত্যা। বড় মাপের ট্র্যাজেডিতে অংশ নেওয়ার মতো মানসিক দৃঢ়তা বাঙালির নেই, কিন্তু তরল মেলোড্রামার প্রতি আমবাঙালির আগ্রহ ও আকর্ষণ অতিমাত্রায় প্রবল। রবীন্দ্রনাথ ও কাদম্বরী দেবীর সম্পর্কটিকে নিয়ে বাঙালি নিজের সেই চাহিদা পূরণ করে নিয়েছে।

লক্ষণগুলি বাঙালির দুটি পরিপূরক প্রবণতার প্রকাশক। এক, বাঙালি স্থান-কাল-পাত্র সচেতন নয়, আর তাই, দুই, তার ‘এমপ্যাথি’ নেই। এমপ্যাথি মানে সমানুভূতি। অপরকে জানতে ও বুঝতে গেলে চাই সমানুভূতি, আর সে জন্য যাঁকে বুঝতে চাইছি তাঁর স্থান-কাল-পাত্রত্ব সম্বন্ধে ধারণা থাকা চাই। সে জন্য পড়তে হয়, জানতে হয়। পাশ্চাত্যে বিশিষ্ট চিন্তকদের একান্ত ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নানা কাজকর্ম হয়েছে, কিন্তু তার পিছনে যে শ্রম-মেধা-কল্পনাশক্তি থাকে, এই নব্যবঙ্গে তার কানাকড়িও নেই। কল্পনা শব্দটিকে রবীন্দ্রনাথ এমপ্যাথির সমগোত্রীয় করে তুলতে চেয়েছিলেন। এই কল্পনা মানে অপর হওয়ার ইচ্ছা বা ক্ষমতা। অপরকে তো আগে বোঝা চাই।

একটু মন দিয়ে রবীন্দ্রনাথের সময়-জীবনকে অনুসরণ করলে ও তাঁর লেখা মন দিয়ে পড়লে বোঝা যাবে, নরনারীর ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমীকরণকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়াই রবীন্দ্রনাথের সারাজীবনের প্রচেষ্টা। নরনারীর সম্পর্কের মধ্যে ও মানবমনে যে স্বাভাবিক ‘রতিবোধ’ থাকে রবীন্দ্রনাথ তা কখনও অস্বীকার করেননি। স্বামী মারা গেলে বিধবাদের শরীর পাথর হয়ে যায় না, এই স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান বিদ্যাসাগরের ছিল বলে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পূর্বজের বিশেষ প্রশংসা করেন। মানুষের এই স্বাভাবিক রতিবোধ ও প্রণয়বাসনা যাঁরা দেশ ও সমাজের জন্য ‘প্রশমিত’ করতে বলতেন , উনিশ-বিশ শতকীয় সেই ‘আত্মবলিদানপন্থী’ ভাবুকদের থেকেও রবীন্দ্রনাথ আলাদা। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘মৃণালিনী’ উপন্যাসে ও পরে ‘আনন্দমঠ’-এ দেশের কাজের জন্য ব্যক্তিগত প্রণয়কে ‘আটকে’ রাখার নিদান দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ কিন্তু ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসে দেশের জন্য এলা-অন্তুর প্রণয়কে বলি দিতে নারাজ। দাম্পত্য সম্পর্কে নারীর আত্মমর্যাদাবোধের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এই আত্মমর্যাদাবোধ যে কেবল শহুরে শিক্ষিত নারীর থাকে না, যে কোনও অর্থনৈতিক শ্রেণি থেকে উঠে আসা আত্মসচেতন নারীরই থাকে, রবীন্দ্রনাথ তা বিশ্বাস করতেন। গ্রামের কোরফা প্রজা কুরিদের বাড়ির বউ চন্দরা এই আত্মমর্যাদাবোধ থেকেই তার ওপরে হত্যার অভিযোগ চাপানো স্বামী ছিদামের মুখ ফাঁসির আগে দেখতে চায়নি ‘শাস্তি’ গল্পে। আত্মমর্যাদাবোধ ছিল বলেই গ্রাম থেকে আসা মেয়ে মৃণাল তার স্বামীগৃহ ত্যাগ করার সাহস দেখিয়েছিল।

শুধু ‘নারীত্ব’কে নতুন ভাষা ও ভাবে নির্মাণ করতে চাননি রবীন্দ্রনাথ, ‘পৌরুষ’কেও নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আদর্শ পুরুষেরা নারীকে দখল করে না, নিজেদের নমনীয় মানবিকতা দিয়ে তারা নারীকে বুঝতে চেষ্টা করে। ‘ঘরে বাইরে’র নিখিলেশ বা ‘যোগাযোগ’-এর মধুসূদন স্মরণীয়।

নরনারী সম্পর্কের মধ্যে ব্যক্তিগত মানবিক বোঝাপড়াকে যিনি এতটাই গুরুত্ব দেন, ব্যক্তিগত জীবনে, নারীমনকে-বুঝতে-না-চাওয়া তাঁর সেই সমকালে তিনি যে নারীর ভরসাস্থল হয়ে উঠবেন, তা তো স্বাভাবিক। কাদম্বরী, রাণু, ওকাম্পো, নানা জনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক। সেই সম্পর্কের নানা মাত্রা ও মানে। কাদম্বরীর মৃত্যু লেখক রবীন্দ্রনাথকে গড়ে তুলেছে, সেই মৃত্যুস্মৃতি নানা ভাবে ফিরে এসেছে তাঁর অজস্র লেখায়। আবার স্ত্রী মৃণালিনীর প্রতি তিনি প্রণয়পরায়ণ ও কর্তব্যনিষ্ঠ। মৃণালিনীর প্রয়াণের পর কবিজীবনে গুণমুগ্ধ নারীর আবির্ভাব হয়েছে। এই সব মানব সম্পর্কের সংরাগে পরিপূর্ণ তাঁর জীবন। আমাদের মন বিচিত্রসন্ধানী। সম্পর্কের নানাত্বে কবি যেন সেই বিচিত্রকে উপভোগ করেছেন। কারও আত্মমর্যাদার হানি করেননি।

নিজেদের মাপে টেনে নামিয়ে বড়কে ছোট করে আমবাঙালি দিব্যি আছেন। কিন্তু অপরকে বুঝতে না চেয়ে সবাইকে নিজের মাপে নামিয়ে আনা আসলে এক রকম সন্ত্রাস। এই ছোট ও খাটো করার সন্ত্রাস চলতে থাকলে বাঙালির জাতিগত উচ্চতা কমতে কমতে ক্রমে এক সময় ফুটপাতে বসে পা দোলাবার সামর্থ্য লাভ করবে।

বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE