সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘কলঙ্ক-নাট্য’ (১৬-১১)-র পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। বাঙালি জাতিকে এক রকমের সাংস্কৃতিক সঙ্কটে ফেলার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে এক শ্রেণির লোকজন বাঙালির শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির দুই দিকপাল সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে একটা তরজার বাতাবরণ তৈরি করে চলেছে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বন্দে মাতরম্’-এর দেড়শো বছর পূর্তি সরকারি ব্যবস্থাপনায় সারা দেশ জুড়ে যথেষ্ট গুরুত্ব-সহ পালন করা হয়েছে। অন্য দিকে, অসমে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কালজয়ী সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র গায়কদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়া হয়েছে!
বোঝাই যাচ্ছে, হিন্দুত্ববাদীরা রবীন্দ্রনাথের প্রগতিশীল চিন্তা-ভাবনাকে প্রতিহত করার জন্য বঙ্কিমচন্দ্রকে প্রকৃত সনাতনী রূপে তুলে ধরতে চাইছে। ও-পার বাংলা আর এ-পার বাংলা দুই জায়গাতেই আজ রবীন্দ্রনাথ দুই ভিন্ন ধারার মৌলবাদীদের হাতে আক্রান্ত। কারণ, রবীন্দ্রনাথের দেশবীক্ষা এঁদের উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। বঙ্কিমচন্দ্রকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক হিসাবে উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দু’জনের জীবন অনুসরণ করলে বোঝা যায়, বঙ্কিম কত ভাবে রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরক, অগ্রপথিক, তাঁরা রাস্তা তৈরির অন্যতম কারিগর। যাঁরা এই বাংলায় বঙ্কিম বনাম রবীন্দ্রনাথ খেলা খেলতে চাইছেন তাঁদের জ্ঞাতার্থে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের এই বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই— “আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন।” প্রগতিশীল বাঙালির মননে বঙ্কিমচন্দ্র বনাম রবীন্দ্রনাথ এই তরজা কোনও দিন স্থান পায়নি এবং আগামী দিনেও পাবে না।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
অনুদানের ফল
‘স্থিতিশীলতার জয়’ (১৫-১১) সম্পাদকীয়টি প্রসঙ্গে কিছু কথা। মহিলাদের রোজগার যোজনায় এককালীন দশ হাজার টাকা প্রদানের ফলে মহিলাদের একচেটিয়া ভোট বিজেপি-নীতীশের ঘরে এসেছে বলে সম্পাদকীয়তে দাবি করা হয়েছে। খুবই যুক্তিসঙ্গত এই দাবি। কিন্তু ভোটারদের নগদ প্রাপ্তিই যদি সরকারের জয়ের চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়ায় তা হলে খুবই চিন্তার বিষয়। তবে প্রশাসন উন্নয়নের দিকে নজর না দিয়ে সেই অর্থে ভোটারদের মন পেতে নগদ দানের ব্যবস্থা করবে। এই ধারা অব্যাহত থাকলে উন্নয়নের যজ্ঞ থমকে যাবে। রাস্তাঘাট তৈরি হবে না। পুরনো রাস্তা সংস্কার করা যাবে না। নতুন স্কুল কলেজ তৈরি করা যাবে না। কর্মসংস্থান হবে না। তা হলে স্কুল-কলেজে শিক্ষক থাকবে না। হাসপাতালে ডাক্তারের অভাব হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ মিলবে না। তাই প্রশ্ন ওঠে, অনুদানের এই ধারাকে বহমান রাখা কতটা যুক্তিসঙ্গত? প্রশাসনের লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশ ও রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়ন। অনুদান তো সেই ধারাকে রুদ্ধ করবে।
ভোটারদের নগদ অর্থ জোগাতেই রাজকোষ শূন্য হয়ে গেলে বিভিন্ন পরিষেবাই বা সুষ্ঠু ভাবে চলবে কী করে? জনগণকে নগদ অর্থ দিয়ে সরকারে টিকে থাকা বা বার বার ফিরে আসা গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ নয়। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই অভ্যাস বন্ধ হওয়া উচিত।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
জয়ের কারণ
সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ‘স্থিতিশীলতার জয়’ প্রসঙ্গে এই চিঠি। বিজয়ী জোটের অংশীদার নরেন্দ্র মোদী এবং নীতীশ কুমারের প্রভাব গোটা বিহার জুড়েই স্পষ্ট। তবে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং উন্নয়নের মধ্যে একটিকে মানুষ বেছে নিয়েছেন বলেই নীতীশ জিতেছেন তা নয়, বরং মানুষকে একত্রিত করার গুণেই তিনি এই জয় হাসিল করেছেন। তিনি একটি সামাজিক জোট গঠন করেছেন ও মর্যাদার রাজনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। গুরুত্ব দিয়েছেন প্রান্তিক সম্প্রদায়কে, অত্যন্ত অনগ্রসর শ্রেণিকে এবং মহাদলিতদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সঙ্গে ছিল সামগ্রিক উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা এবং সুনির্দিষ্ট কল্যাণমূলক পরিকল্পনা।
এনডিএ সরকারের অধীনে বিহার দ্রুত উন্নয়নশীল হলেও, গড়পড়তা মানুষের নিম্ন-আয়ের সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য উন্নয়নে আরও গতি আসা জরুরি। এর জন্য শিল্প, নগরায়ণ এবং কর্মসংস্থান প্রয়োজন। ফলে নতুন সরকারকে পরিকাঠামোয় আরও বিনিয়োগ করতে হবে, প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগকে নির্ভরযোগ্য, দক্ষ এবং সক্রিয় করে তুলতে হবে।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর
মৌলিক অধিকার
সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘উপশম চিকিৎসা কোথায়’ (৭-১১) প্রবন্ধটি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার এক গভীর অন্তর্নিহিত সঙ্কটের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। উপশম চিকিৎসা কেবল একটি চিকিৎসা পদ্ধতি নয়— এটি এক মানবিক দর্শন, যার ভিত্তি এই বিশ্বাসে প্রতিষ্ঠিত যে জীবনাবসানের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত এক জন মানুষ মর্যাদাপূর্ণ ও যন্ত্রণামুক্ত জীবনযাপনের অধিকার রাখেন। যে চিকিৎসা রোগীর শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও মানবিক যন্ত্রণা লাঘব করে জীবনমান উন্নত করে, সেটিই প্রকৃত উপশম চিকিৎসা। কিন্তু আমাদের দেশে নীতিপত্রে তার উল্লেখ থাকলেও বাস্তবের পরিসরে তার উপস্থিতি সীমিত। নীতির এই কাগুজে প্রাসাদ থেকে বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে সেবার সেতু এখনও পৌঁছয়নি। সরকারি হাসপাতাল থেকে জেলাস্তর ও গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যন্ত উপশম সেবার পরিকাঠামো প্রায় অনুপস্থিত। এর ফলে রোগী ও তাঁর পরিবারকে চরম মানসিক ও আর্থিক যন্ত্রণার শিকার হতে হয়। একটি বড় বাধা ছিল ব্যথানাশক ওষুধ, বিশেষত মরফিনের মতো ‘এসেনশিয়াল নারকোটিক ড্রাগস’-এর জটিল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। এই ক্ষেত্রে ‘নারকোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস (এনডিপিএস)’ সংক্রান্ত আইনের ২০১৪ সালের সংশোধনী নীতিগত ভাবে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হলেও তার বাস্তবায়নের গতি হতাশাজনক। ফলে আজও বহু ক্যানসার রোগী তীব্র যন্ত্রণায় কাতর, অথচ মরফিনের মতো ওষুধের নাগাল পাচ্ছেন না।
নীতির ভাষা বদলেছে, কিন্তু ওষুধের দোকানের তাক ও রোগীর বেদনায় ব্যবধান রয়ে গিয়েছে। এই অন্ধকারে কেরলের গোষ্ঠী-ভিত্তিক মডেল এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। যথার্থ প্রশিক্ষণ, স্বেচ্ছাসেবকদের অংশগ্রহণ এবং সমাজের মধ্যে যোগাযোগ ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে উপশম সেবা কী ভাবে সবার কাছে সহজলভ্য ও মানবিক ভাবে পৌঁছে দেওয়া যায়— তার বাস্তব উদাহরণ সেখানে স্থাপিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও নাগরিক সমাজের ভিত্তি মজবুত, অতএব সহজেই এই মডেলটি অনুসরণ করতে পারে। কয়েকটি জেলা দিয়ে শুরু করে, ফলাফল দেখে সেই ভিত্তিতে কার্যবিধি পরিকল্পনা করে সমগ্র রাজ্যে এটি সম্প্রসারিত করা সম্ভব।
প্রয়োজনীয় ওষুধের দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসক, নার্স ও গোষ্ঠী-ভিত্তিক কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে; এনজিও ও স্থানীয় গোষ্ঠীগুলিকে প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। তথ্যনির্ভর নজরদারি ও স্বচ্ছতা; প্রতিটি জেলাকে উপশম চিকিৎসার আওতায় আনা, ওষুধ সরবরাহ ও কর্মীদের পেশ করা রিপোর্ট সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত। শেষ কথায়— উপশম চিকিৎসা কোনও বিলাসিতা নয়, বরং এটি মানুষের মৌলিক স্বাস্থ্য অধিকার। যদি রাষ্ট্র ও সমাজ এই ক্ষেত্রটিকে প্রান্তিক করে রাখে, তবে কেবল রোগীর কষ্ট নয়— আমাদের স্বাস্থ্যনীতির ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি হয়ে থাকবে। সহানুভূতিশীল ও ন্যায়ভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা তখনই গড়ে উঠবে, যখন জীবনাবসানের মুহূর্তেও মানুষ মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার অধিকার পাবেন।
অলোক কুমার মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৫
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)