Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
Tebhaga movement

ভাঙেন চাষের কাজে নারী-পুরুষের বেড়া

মেয়েরা ধান কাটার কাজে এগিয়ে এলেন। সঙ্গে নিলেন কাটারি, বঁটি, ঝাঁটা। কাপড়ের আড়ালে নুন-লঙ্কা আর বালির মশলা।

আমেরিকার চিনে ভাষার বিশেষজ্ঞ জেমি প্রোক্টর খু-র সঙ্গে বিমলা।

আমেরিকার চিনে ভাষার বিশেষজ্ঞ জেমি প্রোক্টর খু-র সঙ্গে বিমলা।

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:৪৬
Share: Save:

তেভাগা আন্দোলনে মেযেদের সংগঠিত করার কাজে বিমলা মাজীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তিনি মেদিনীপুরে চাষের ক্ষেত্রে একটি সংস্কার করতে পেরেছিলেন। তা হল মেয়েদেরও ধান কাটার ও খামারে তোলার কাজ করায় উৎসাহ দেওয়া। নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা, মহিষাদলে পুরুষরাই চাষবাস করতেন। মেয়েরা ছিলেন সহায়কের ভূমিকায়। সেই ভূমিকা বদলে দিলেন বিমলা। অবশ্য তা আন্দোলনের সুবিধার জন্যই করেছিলেন। মেয়েরা ধান কাটার কাজে এগিয়ে এলেন। সঙ্গে নিলেন কাটারি, বঁটি, ঝাঁটা। কাপড়ের আড়ালে নুন-লঙ্কা আর বালির মশলা। ততদিনে চাষিরা দাবি তুলেছেন, ‘আধি নয়, তেভাগা চাই’।

বিমলাকে মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করতে পাঠানো হয়। বিভিন্ন গ্রামে সভা করে মহিলাদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। প্রথমে অসুবিধা হত। নন্দীগ্রামের রানিচকে মেয়েদের ঘরোয়া সভায় গিয়ে দেখেন বেশিরভাগ মেয়েই বড় করে ঘোমটা দিয়ে বসে। ঘোমটার আড়াল থেকে বলা কথা বুঝতে পারেন না বিমলা। বিমলা বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাঁদের এই বেঁচে থাকাটার কোনও মানে নেই। পরিশ্রম করেন তাঁরা। ফসলের বেশিটা যায় মালিকের গোলায়। তিন ভাগের দু’ভাগের দাবি জানাতেই হবে। পরের সভা কেন্দামারি-জলপাই গ্রামে। প্রথম সভায় মেয়েদের উপস্থিতি ছিল ৬০ জন। এই সভায় হল ১০০ জন। এই সময়ে পুলিশও তৎপর হয়। তেভাগা ঠেকাতে শুধু নন্দীগ্রামে সাতটি পুলিশের ক্যাম্প হয়েছিল। লুকিয়ে সভা করতে হত বিমলাদের। পুলিশকে ফাঁকি দিতে সঙ্গীদের সঙ্গে থাকতেন শ্মশানে। কুংস্কারের ফলে পুলিশ রাতে শ্মশানে যেত না।

একবার ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছিলেন। দিনের বেলা সভা করেন সেদিন। কিন্তু পুলিশ পাড়া ঘিরে ফেলে। একটি মেয়ে অন্ত:সত্ত্বার অভিনয় করেন। তাঁকে ঘিরে থাকে মেয়েরা। ঝাঁটা হাতে দুই বৃদ্ধা পুলিশের মহড়া নেয় প্রবল গালিগালাজে। সেই ফাঁকে বিমলা অন্য গ্রামে পালিয়ে যান। বিমলাকে শনাক্ত করা সহজ ছিল। তিনি ছিলেন খুব ফরসা। ফলে গ্রামের মেয়ে-বধূদের থেকে তাঁকে আলাদা করা যেত। আর তাঁর কপালে একটা দাগ ছিল। সেদিন পুলিশ ওই পাড়ায় প্রতিটি মেয়েকে ঘোমটা খুলে কপাল দেখাতে বাধ্য করে।

একসময় বিমলার মাথার দাম পাঁচ হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। ধরা পড়েন নীলকুণ্ঠা গ্রামে এক জেলের বাড়ি থেকে। সঙ্গে শিশু সন্তানও ছিল। গ্রেফতার হন তাঁর স্বামী অনন্ত মাজীও। দু’জনে মুক্তি পান ১৯৫১ সালে।

এক সময়ে সারা বিশ্ব বিমলা মাজীর লড়াইকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। কোপেনহাগেনে আন্তর্জাতিক মহিলা কংগ্রেসে প্রতিনিধি করা হয়েছিল বিমলকে। কিন্তু পাসপোর্ট পাননি। ডেনমার্কের শান্তি সংসদ থেকে পিটার কাস্টার সাক্ষাৎকার নিতে এসেছিলেন। তিনি ডেনমার্ক যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু বিমলা আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারেননি। পিটারের দুই বাংলার কৃষক আন্দোলন নিয়ে লেখা বইয়ের একটি অধ্যায় বিমলাকে নিয়ে লেখা। তার আগে ‘ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন’ থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ইতিহাসবিদ বিপান চন্দ্র ছাত্রী মৃদুলা মুখোপাধ্যায়কে পাঠিয়েছিলেন সাক্ষাৎকার নিতে। চেকোস্লোভাকিয়া থেকে মেদিনীপুর এসে সাক্ষাৎকার নেন দুশান ব্যবিতোল। লেখাটি মস্কো থেকেও প্রকাশিত হয়।

সাক্ষাৎকার নেওয়া ব্যক্তিরা পুরনো ছবি চাইলে বিমলা উত্তর দিতেন, ‘জীবনের তোয়াক্কা না করে আমরা গরিব মানুষের আন্দোলনে এসেছি। কখনও কি ভেবেছি কোনও একদিন আপনারা এসে ছবি-ছাপা চাইবেন’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Tebhaga Movement agriculture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE