Advertisement
২৩ জানুয়ারি ২০২৫

নীল তিমি তো বলেকয়ে মারে

সব রোগ মিলিয়ে সারা বছরে যে পরিমাণ লোক মারা যায় তার সঙ্গে শুধু আত্মহত্যা করে মারা যাওয়ার পরিমাণ রীতিমত পাল্লা দিচ্ছে।

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৭ ০৬:১০
Share: Save:

সে সব দুপুরে যখন অপুর মতো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলতে খেলতে কর্ণের প্রতি ভালবাসায় চোখ জলে ভরে উঠত, যখন নিজের মনের ভিতর একের পর এক রাজত্বের গল্পের বুনোন চলত তখন নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ করা হত। সে চ্যালেঞ্জে হেরে গেলেও কেউ দুয়ো দেবে না। পয়েন্ট ইচ্ছেমতো নিজের ভাঁড়ারে জমা পড়ত। প্রতিদিন কাঠের বানানো তলোয়ারে একাই হয়ে যাওয়া যেত বাহুবলী অথবা মাঝসমুদ্রে ঝড়ের মাঝে হাঁ করে আসা নীল তিমিকে এক কোপেই সাবাড়। সেখানে কাউকে প্রমাণ দেওয়ার দায় ছিল না, ছিল না পঞ্চাশ দিন সময়ের মধ্যে বিভিন্ন কঠিন পর্যায় পার করে অবশেষে সুইসাইড। এ বার মৃত্যুতেও নতুন বৈচিত্র। জন্মের তো সব কিছু একই রকম। এই মরে যাওয়াতেই কিছু রহস্য আর পরীক্ষানিরীক্ষার সুযোগ থাকে। এক রকম ভাবে নিয়মিত ধুঁকে ধুঁকে মরা বা কারও হাতে মরার থেকে আত্মহত্যা কিছুটা স্বতন্ত্র তো বটেই। আর খেলার কারণে হলে তো কথাই নেই। দড়ি, বিষ, হাতকাটা আর মেট্রো সব কিছুর পর এ বার নীল তিমি। বেশ আন্তর্জাতিক আবহ। বনগাঁ আর বাগদাদে দু’জন ঘড়ি দেখবে। রোমানিয়া আর রায়চকে দু’জনের ঘুম ভাঙবে। ভোর চারটে কুড়িতে ওঠা, ছাদের কার্নিশে দাঁড়ানো, হাইওয়ে দিয়ে হেডলাইট আর আয়না খুলে গাড়ি চালিয়ে আসা, ছাদ থেকে ছাদে ঝাঁপ দেওয়া, নিজের শরীরে সূচ ফোটানো সবশেষে আত্মহত্যা।

সব রোগ মিলিয়ে সারা বছরে যে পরিমাণ লোক মারা যায় তার সঙ্গে শুধু আত্মহত্যা করে মারা যাওয়ার পরিমাণ রীতিমত পাল্লা দিচ্ছে। সারা পৃথিবীর আত্মহননের পথ বেছে নেওয়া ১০০ জনের মধ্যে ১৭ জনই ভারতীয়। আর ভারতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে ১১ জন আমার-আপনার পাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষ। আমাদের রাজ্যের। সব মৃত্যু সমান নয়। কিন্তু খেলার পরিণাম মৃত্যু জেনেও খেলা? সাইকোলজির রুশ ছাত্র ফিলিপ তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিতাড়িত হয়ে এই খেলা তৈরি করেছিল। সে স্পষ্ট বলেছে, যাদের কোনও মূল্য নেই তাদের আত্মহত্যা করিয়ে সে সমাজকে পরিষ্কার করতে চায়। তার মানে, যারা এই খেলায় অংশ নিয়ে শেষ পর্যায়ের দিকে এগোচ্ছে তারা কার্যত নিজেদের সমাজে মূল্যহীন জঞ্জাল বলে মেনে নিচ্ছে।

ভাবতে অবাক লাগে, রোমাঞ্চ বা কঠিন কাজ চার পাশে কি এতই কম পড়ে গেল? এই দুঃসাহসিকতার কিছুমাত্র থাকলে তো অসহায় মেয়েটিকে বাঁচাতে কেউ না কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ত, নিজের বাড়িতে ডাকাত পড়লে নিজেই রক্ষা করা যেত, বন্যাত্রাণ নিয়ে দুর্গম এলাকায় পৌঁছে দেওয়া কোনও ব্যাপারই ছিল না। ভোটের দিন সাহস করে নিজের ভোটটা দিতে যাওয়া তো হাত কেটে তিমি আঁকার থেকে সোজা। মাঝে মধ্যে মনে হচ্ছে আমরা নিজেরা একটা কল্পরাজত্ব বানিয়ে ফেললাম না তো? দেশ পার করে মহাদেশ, পৃথিবী জুড়েও? না হলে গরুর জন্য মানুষকে পিটিয়ে মারা হচ্ছে, তিমির নামে খেলায় মানুষ মরছে, কী করে?

ব্লু হোয়েল নামের সঙ্গে যুক্ত আছে বিচড হোয়েল। অর্থাৎ যে তিমিরা সমুদ্রের তীরে উঠে আসে, তার পর ক্রমে জলের অভাবে ডিহাইড্রেশনে মারা যায়। সেই প্রাকৃতিক মৃত্যু থেকে এই অপ্রাকৃতিক আত্মহনন! খেলার নাম করে মরে যাওয়া, কিংবা মরে যাওয়া নিয়ে খেলা। হ্যাঁ, অক্সিজেন না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যাওয়া ছোট্ট সাদা পুঁটুলিগুলোর কথা বলছি, বা ধরুন সাড়ে তিন বছরের শরীরে সূচগুলো? তিমি তো রূপক মাত্র। নীল তিমি তো তা-ও ভাল— বলেকয়ে মারে।

অন্য বিষয়গুলি:

Blue Whale Gamers নীল তিমি Game Challenge Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy