Advertisement
E-Paper

সেই ঐতিহ্য

ব্রিটিশ রাজের ঘটনাবহুল ইতিহাসেও জালিয়ানওয়ালা বাগের তুল্য ঘটনা বেশি খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অথচ নানা সময়ে নানা অজুহাতে ব্রিটিশ রাষ্ট্র কিংবা ব্রিটিশ সমাজ এই প্রসঙ্গটিকে প্রাপ্য গুরুত্ব না দিয়া এড়াইয়া গিয়াছে।

শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০১৯ ০০:১১
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। ছবি রয়টার্স।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। ছবি রয়টার্স।

আজ হইতে একশত বৎসর আগে, ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিলের উষ্ণ দ্বিপ্রহরে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালা বাগে যাহা ঘটিয়াছিল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে দিনদুয়েক আগে তাহার জন্য ‘দুঃখ প্রকাশ’ করিয়াছেন। অতি-আলোচিত ঐতিহাসিক ঘটনার শতবর্ষ, সুতরাং ‘দুঃখ’ একটু প্রকাশ করিতেই হইত। তবে ‘দুঃখ’ যে তত গভীর নহে, এমন একটি জল্পনার অবকাশ তিনি নিজেই করিয়া দিলেন। এমনকি দুঃখ ঠিক কিসের জন্য, তাহাও স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করিলেন না। দুর্ভাগ্য বলিতে হইবে। শতবর্ষ অপেক্ষা করিবার পরও যদি ব্রিটিশ রাষ্ট্রপ্রধান মুক্ত মনে দুঃখটুকুও প্রকাশ করিতে না পারেন, তাহা হইলে বলিতে হয়, প্রাক্তন ঔপনিবেশিক শক্তির ‘শাক্ত’ ভাবটি এত কাল পরেও ঘুচে নাই। তিনি ও তাঁহার বক্তৃতা-রচয়িতারা যদি সত্যই ‘লিবারাল’ চোখ দিয়া তাঁহাদের দেশের ইতিহাসের এই কলঙ্ক-অধ্যায়টি দেখিতেন, তবে চার দিক ঘেরা, সরু পথবিশিষ্ট বাগানপ্রাঙ্গণে পনেরো হইতে বিশ হাজার নিরস্ত্র মানুষের জড়ো-হওয়া সভায় ব্রিটিশ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার ও তাঁহার বাহিনী একটিমাত্র প্রবেশপথ বন্ধ করিয়া যে ভাবে মশামাছির মতো সহস্র মানুষকে পয়েন্ট-ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে নিধন করিয়াছিলেন— সেই ঘটনা স্মরণ করিবার সময়ে আর একটু আন্তরিক হইতেন। ক্ষমা চাওয়া তো দূরস্থান, দুঃখ প্রকাশও আন্তরিক না হইলে ভারতীয় উপমহাদেশের দিক হইতে অপমানিত বোধ করা খুবই সঙ্গত।

ব্রিটিশ রাজের ঘটনাবহুল ইতিহাসেও জালিয়ানওয়ালা বাগের তুল্য ঘটনা বেশি খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না। অথচ নানা সময়ে নানা অজুহাতে ব্রিটিশ রাষ্ট্র কিংবা ব্রিটিশ সমাজ এই প্রসঙ্গটিকে প্রাপ্য গুরুত্ব না দিয়া এড়াইয়া গিয়াছে। মনে রাখিতে হইবে, যখন ব্রিটিশ ভারতের একমাত্র সংবাদপত্র ‘বম্বে ক্রনিকল’-এ সংবাদটি প্রকাশিত হইয়াছিল, ‘স্পর্ধা’র অপরাধে সম্পাদক বি জি হর্নিম্যান শাস্তিস্বরূপ ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করিতে আদিষ্ট হন। কিংবা, যখন জেনারেল ডায়ারকে সরাইয়া দিবার সিদ্ধান্ত লওয়া হয়, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব লর্ডস ডায়ারকেই সমর্থন জানাইয়াছিল, এই অফিসারের প্রতি তাঁহার দেশ অন্যায় করিতেছে বলিয়া যুগপৎ হাউস অব কমনস ও ভারতের জন্য নিযুক্ত সেক্রেটারি অব স্টেট মন্টাগুকে ভর্ৎসনা করিয়াছিল। সামাজিক দিক দিয়াও ডায়ারের ঘৃণ্য কাজ যথেষ্ট সমর্থন, এমনকি সম্মান কুড়াইয়াছিল। বিশ্ববরেণ্য ব্রিটিশ সাহিত্যিকের উক্তিটি উল্লেখ করা যাইতে পারে। জেনারেল ডায়ারের সমাধিতে পুষ্পমাল্যের জন্য অর্থপ্রদান করিয়া রাডইয়ার্ড কিপলিং মন্তব্য করিয়াছিলেন, ‘‘ইনি যাহা কর্তব্য বলিয়া মনে করিয়াছিলেন, তাহা করিয়াছিলেন।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই ঘটনার প্রতিবাদে যে চিঠি দিয়া ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত নাইটহুড ত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহার ক্রুদ্ধ ও ব্যথিত মন্তব্যগুলিও বলিয়া দেয় যে, জেনারেল ডায়ার-এর সে দিনের কীর্তি ইংল্যান্ডের পত্রপত্রিকায় ‘দেশের প্রতি কর্তব্যসাধন’ হিসাবেই সমাদৃত হইয়াছিল।

টেরেসা মে-র অনতিদুঃখী দুঃখপ্রকাশ বুঝাইয়া দেয়— রাষ্ট্রের নামে যে ‘রেন অব টেরর’ বা হিংস্রতার শাসন চলে, তাহাকে অন্যায় হিসাবে স্বীকার করা রাষ্ট্রবাদী বা জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে কখনওই সহজ হয় না। হিংস্রতার হেতু হিসাবে তাঁহারা রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় আবেগকে দেখেন, এবং মনে করেন যে এই আবেগের স্থান অন্যান্য নৈতিকতা অপেক্ষা উচ্চে। এই নীতি-অতিক্রমী আবেগ প্রায় মানসিক বিকারের পর্যায়ে উন্নীত হইতে পারে, বহু আদর্শ ও ঔচিত্যবোধকে সদর্পে পদদলিত করিতে পারে। আজও সেই বিকার সমানে চলিতেছে। জালিয়ানওয়ালা বাগের শতবর্ষ তাই মনে করাইয়া দিক, কী ভাবে আজও রাষ্ট্রের নামে হিংসা পবিত্র বলিয়া বিবেচিত হয়— কেবল সাম্রাজ্যবাদের দেশে নহে, এক কালের উপনিবেশিত দেশেও।

Jallianwala Bagh Massacre Theresa May
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy