Advertisement
E-Paper

বই পড়ার অভ্যাস হোক ছোট থেকে

একটা সময় ছিল যখন হাতে কোনও নতুন বই এলে তার পাতার অদ্ভুত গন্ধে শেষ লাইন না পড়া পর্যন্ত নেশা কাটত না। সে যুগ এখন অতীত। বই পড়ার অভ্যাস থেকে মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন যে, বই পড়ার প্রবণতা কমে যাওয়া সমাজের পক্ষে সুলক্ষণ নয়। লিখছেন সুমন্ত চৌধুরী। এখন বই পড়ার ঝোঁক কমছে বলে অনুযোগ শোনা যায় হামেশাই। সাধারণ মানুষের এই ‘বই বিমুখতা’র কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তার নানা দিক আমাদের সামনে ধরা দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ।

শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:০৬
বই-সই: বইমেলায় বই দেখতে ব্যস্ত খুদেরা। ফাইল চিত্র

বই-সই: বইমেলায় বই দেখতে ব্যস্ত খুদেরা। ফাইল চিত্র

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার যে চিরন্তন আগ্রহ মানুষের আছে, সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণের সবচেয়ে সহজ রাস্তা হল বই পড়া। এ প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক লিও তলস্তয়ের একটি উক্তি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন ‘তিনটি জিনিস মানুষের জীবনে বিশেষ ভাবে প্রয়োজন, বই, বই এবং বই’।

এখন বই পড়ার ঝোঁক কমছে বলে অনুযোগ শোনা যায় হামেশাই। সাধারণ মানুষের এই ‘বই বিমুখতা’র কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে তার নানা দিক আমাদের সামনে ধরা দেয়। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তি- নির্ভরতা বেড়ে যাওয়াই এর অন্যতম প্রধান কারণ। বিজ্ঞানের আশীর্বাদে তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে, তারই হাত ধরে আজ সবার কাছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুলভ সুযোগ এসে পৌঁছেছে। সেই সূত্রেই বর্তমান তরুণ সমাজ সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের বিভিন্ন মাধ্যমকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ডুব দিয়েছে। টেলিভিশনও অবশ্য কম দায়ী নয়। যাই হোক, এ সবের ফলস্বরূপ পাঠকের সঙ্গে বইয়ের সম্পর্ক ধীরে ধীরে আলগা হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটে গেম খেলার সর্বনেশে নেশা।

এখন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে পড়া ব্যাপারটা শুধুই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ আর অনলাইনের কিছু পত্র-পত্রিকায় সীমায়িত। ‘ই –বুক’-এর প্রচলন হলেও তা কি হাতে বই নিয়ে পড়ার স্বাদ দিতে পারে? প্রযুক্তির প্রতি মানুষের এই যে এত বেশি ঝোঁক, তার পরিণতি কিন্তু সুখকর নয়। মানুষের আচার-আচরণেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘পাগলা গণেশ’ শীর্ষক কল্পবিজ্ঞানের গল্পে মজার ছলে তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞেরাও বলছেন, সুস্থ মানসিকতার জন্য বই পড়া খুবই জরুরি। সৃজনশীলতা, মননশীলতা—এই সব গুণাবলির বিকাশে বই খুব ভাল বন্ধু। বই থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই যন্ত্র-নির্ভর সভ্যতায় আজ আমরা বড় আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর হয়ে উঠছি। অথচ এটা ঘটনা যে, বই পড়ে যে নির্মল আনন্দ পাওয়া যায়, তা অন্য কিছুতে অসম্ভব। সুভাষচন্দ্র বসু যখন মান্দালয়ের জেলে বন্দি ছিলেন, তখন বই কী ভাবে তাঁকে নিঃসঙ্গতা কাটাতে সাহায্য করেছিল, তা তিনি ‘তরুণের স্বপ্ন’ গ্রন্থে খুব সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন। আসলে বই আমাদের নিঃস্বার্থ ও শ্রেষ্ঠ বন্ধু। কবিগুরুর কথায়, ‘‘ভালো বই আত্মশুদ্ধির শ্রেষ্ঠ উপায়।’’

তাই বই পড়ার অভ্যাস হওয়া উচিত শৈশব থেকেই। কারণ, শৈশবই ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রথম পর্ব। বছর তিরিশ পিছিয়ে গেলেই অন্য ছবি ধরা পড়ে। তখন ছেলেবেলা ছিল বড্ড মজার। ছোটরা লেখাপড়ার ফাঁকে মাঠেঘাটে দাপিয়ে বেড়াত। বর্যার কাদামাঠে ফুটবল কিংবা শীতের দুপুরের ক্রিকেটের মজাই ছিল আলাদা। দল বেঁধে স্কুল যাওয়ার মধ্যেও ছিল এক অন্য রকম আনন্দ। সে সময় যৌথ পরিবার ছিল। অফুরন্ত আদর ভালবাসা ও আত্মিক বন্ধন ছিল। ঠাকুমার ঝুলি, আবোলতাবোল, বুড়ো আংলা, হযবরল-র আশ্চর্যময় কল্পনার জগৎ ছিল। পাড়ার লাইব্রেরিতে ছুটির দুপুরে গল্পের বই পড়া ছিল। কমিকস বইয়ে অরণ্যদেব, জাদুকর ম্যানড্রেক, বাহাদুর, রিপ কার্বির এক রোমাঞ্চকর দুনিয়া ছিল ছিল। বড় বড় খেলার মাঠ ছিল। সাঁতার কাটার জন্য পুকুর ছিল। আম বাগান ছিল।

এখন আগের মতো ক্লাব ও শিশু-কিশোর সংগঠন নেই পাড়ায় পাড়ায়। এখন ব্যাগভর্তি বইখাতা নিয়ে সকালে ঘুমচোখে স্কুলে যাওয়া। স্কুল থেকে ফিরেও এক শিক্ষকের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে ছোটা। এ ভাবেই কেটে যাচ্ছে শৈশব। পাঠ্যবইয়ের বাইরে জগৎটাই ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। তরুণ বয়সে তাদেরই মনোযোগ চলে যাচ্ছে ইন্টারনেট ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া বা বিনোদন মাধ্যমগুলির প্রতি। এ ভাবেই তারা গতবাঁধা পড়াশোনায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। আসলে বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণের কাণ্ডারী হয়ে ছুটতে ছুটতেই তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই ছেলেবেলায় যখন পাঠক হিসেবে এক জনের হাতেখড়ি হওয়ার কথা, তখনই নানা পারিপার্শ্বিক কারণে বইয়ের প্রতি তাদের বিরূপ মনোভাব তৈরি হচ্ছে। তা হলে নতুন পাঠক তৈরি হবে কী ভাবে? আগে অভিভাবকেরা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সন্তানের হাতে উপহার হিসাবে বই তুলে দিতেন। আর নিজেরাও অবসরের অনেকটা সময় বই পড়ে কাটাতেন। ফলে পারিবারিক ভাবেই বই পড়ার সুঅভ্যাস গড়ে উঠত। এখন যে সেই রীতি নেই, তা বললে ভুল হবে। তবে সেই চল কমে এসেছে অনেকটাই।

প্রথম ধাপে এক জন শিশুকে ছবিওয়ালা বই দেখাতে হবে। ছবির আকর্ষণে সে নিজেই ওই বইয়ের পাতা ওল্টাতে শুরু করবে। ধীরে ধীরে ছবি সম্পর্কিত কথার সঙ্গে তার পরিচয় করাতে হবে। সেই সঙ্গেই তাকে তার বয়সপোযোগী বই পড়ে শোনাতে হবে। এ রকম করে তার শোনার ক্ষমতা যেমন বাড়বে, ঠিক তেমনই নিজে পড়ার আগ্রহও জন্মাবে। এ ভাবেই তৈরি হয় এক জন নতুন পাঠক। উল্লেখ্য যে, দু -তিন দশক আগেও স্কুল, কলেজ বা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে নিজেদের পড়া কোনও বই নিয়ে তর্ক- বিতর্ক, আলোচনা সভা, সাহিত্যসভার জমজমাট আসর বসত। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনের হাত ধরে সে দৃশ্য আজ বিরল। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় এই যে, বর্তমান সময়ে দেশের নানা প্রান্তে প্রচুর পাঠাগার ছড়িয়ে রয়েছে, যেখানে বইয়ের সংখ্যাও অগুনতি, টেবিল চেয়ারও রয়েছে। কিন্তু তেমন ভাবে পাঠক নেই। এ বড় দুশ্চিন্তার ব্যাপার! আসল কথা হল, আজকের এই ‘ডিজিটাল যুগে’ হাত বাড়ালেই তথ্যের ভাণ্ডার, যেখানে জ্ঞানের দ্বার উন্মুক্ত। কিন্তু সেখানে মননশীলতার প্রকাশ নেই, মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ নেই। এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে সবার সদর্থক ভূমিকা প্রয়োজন।

ইউনেস্কো থেকে এ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২৩ এপ্রিল তারিখটিকে আন্তর্জাতিক বই দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎকে সুন্দর ও সুস্থ ভাবে গড়ে তুলতে সবাইকে বইয়ের আশ্রয়ে ফিরতেই হবে। কারণ, বই পড়ার কোনও বিকল্প নেই।

লেখক লাঙ্গুলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক (মতামত ব্যক্তিগত)

Habit Reading Book Childhood
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy