Advertisement
E-Paper

মৃত্যুবন্ধুতা

এমন সংস্থার এক কর্ণধার এক বার বলিয়াছিলেন, নিজ ইচ্ছায় সসম্মানে মারা যাইবার অধিকার মানুষের ‘‘শেষ মানবাধিকার’’।

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৮ ০০:৫৩

বৈজ্ঞানিক ডেভিড গুডঅল ১০৪ বৎসরে তাঁহার জীবন শেষ করিবার সিদ্ধান্ত নিলেন। অস্ট্রেলিয়ায় তিনি সেই কাজ করিতে পারিলেন না, কারণ আত্মহত্যায় সহায়তা অস্ট্রেলিয়ায় একটি মাত্র রাজ্যে আইনসঙ্গত, কিন্তু তাহা কেবলমাত্র অনারোগ্য ব্যাধি-আক্রান্তদের জন্য। তাই তাঁহাকে যাইতে হইল সুইৎজারল্যান্ডে, যে দেশে ১৯৪২ হইতে ‘অ্যাসিস্টেড সুইসাইড’ বা আত্মহত্যা-সহায়তা আইনি, যত ক্ষণ তাহা নিঃস্বার্থ ভাবে করা হইতেছে, অর্থাৎ যে ব্যক্তি বা যে সংস্থা আত্মহত্যাকামীকে সাহায্য করিতেছে, তাহার কোনও আর্থিক লাভ তাহা হইতে হইতেছে না। ইহার সহিত নিষ্কৃতিমৃত্যুর পার্থক্য রহিয়াছে, নিষ্কৃতিমৃত্যুতে ডাক্তার বা অন্য কেহ মৃত্যুব্যবস্থা করেন, এই ক্ষেত্রে মানুষটিকে নিজেকে শেষ করিয়া দিতে সাহায্য করা হয়। যদিও তাহার পূর্বে এত পরিমাণে কাগজপত্রে সইসাবুদ করিবার ব্যাপার থাকে, ডেভিডবাবু বলিয়া ফেলিয়াছিলেন, ইহাতে তো বড্ড সময় লাগিতেছে! আত্মহত্যা-সহায়তা নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, লুক্সেমবুর্গেও বৈধ। আমেরিকায় বেশ কিছু রাজ্য অনারোগ্য ব্যাধি-আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মৃত্যুসহায়তার অনুমতি দেয়। কলম্বিয়াও নিষ্কৃতিমৃত্যুকে বৈধতা দিয়াছে। ইহার ঢালাও অনুমতি দিলে বহু হত্যাকাণ্ড সেই আইনের ফাঁক গলিয়া সম্পাদিত হইবে, এমন সন্দেহ ভিত্তিহীন নহে, কিন্তু যে প্রশ্ন জাগরূক: অন্য ভাবে ব্যবহৃত হইতে পারে বলিয়া কি একটি সহায়ক প্রক্রিয়াকে নিষিদ্ধ রাখা হইবে? তাহার পূর্বের প্রশ্ন, নিজ জীবনের অধিকারের সহিত কি নিজ মৃত্যুর অধিকারও ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়িবে?

সাধারণ মানুষ এই প্রশ্নের প্রতি সন্দেহাক্রান্ত ও অবিশ্বাসী দৃষ্টি লইয়া তাকাইয়া অাছে, কারণ সে বুঝিতে পারিতেছে না, মৃত্যুকে কেমন করিয়া কেহ ত্বরান্বিত করিবার সিদ্ধান্ত লইতে পারে, যে মৃত্যুকে মানুষ সর্বাধিক ভয় পায়, যে মৃত্যুকে এড়াইবার জন্য মানুষের এত কাণ্ড। ব্যথাময়, দুরারোগ্য ও অনারোগ্য ব্যাধির ক্ষেত্রে মানুষের এই মৃত্যু-আড়ষ্টতা কিছু কম। ক্যানসারের চতুর্থ পর্যায়ে প্রবল যন্ত্রণা সহিয়া বা প্যারালিসিস হইবার পর সব্জির ন্যায় জড় শয্যাযাপন করিয়া যিনি কাল কাটাইতেছেন, তাঁহার সম্পর্কে স্বজনও বলে, এই বার চলিয়া যাওয়াই ভাল। সমস্যা ঘটে, যখন মানুষটি কোনও প্রকট ব্যাধির শিকার নহেন, যখন কেহ বলিতেছেন, দূর, ভাল লাগিতেছে না, জীবনটি শেষ করিয়া দিই এই বার। ডিলান টমাস লিখিয়াছিলেন, ‘‘ডু নট গো জেন্টল ইনটু দ্যাট গুড নাইট/ রেজ, রেজ আগেনস্ট দ্য ডায়িং অব দ্য লাইট।’’ যাঁহারা প্রবল ভাবে এই মৃত্যুবিরোধিতা করিতেছেন না, মানুষ তাহাদের সুস্থ হিসাবে দেখে না। সহজে ও স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিবার প্রবণতাকে প্রশ্রয় দিলে, সমাজকে স্বীকার করিতে হইবে, কোনও বাইশ বা চৌত্রিশ বৎসর বয়স্ক সুস্থ ব্যক্তি, স্রেফ প্রেম বা যৌনতা পান নাই বলিয়া, বা এমনিই, জীবন হইতে প্রত্যাশিত আনন্দনিষ্কাশন করিতে পারিতেছেন না বলিয়া, আত্মহত্যা বাছিয়া লইতেই পারেন, অর্থের বিনিময়ে তাহার সহায়তা কিনিতে পারেন। বস্তুত আত্মহত্যা-সহায়ক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে যুক্তি, ইহারা পলায়নী মনোবৃত্তিকে উস্কাইয়া দেয়। মানুষ নিজের বিষাদকে, সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করিবার বদলে, নিজের জীবনকে মূল্যহীন হইতে তাৎপর্যপূর্ণ করিয়া তুলিবার সংগ্রামে রত হইবার পরিবর্তে, ইহাদের প্ররোচনায় পরাজয়ের গলিতে ঢুকিয়া পড়েন। কিন্তু অবসৃত হইবার মধ্যে পলায়নের লজ্জা বা ভীরুতা রহিবেই বা কেন? গুডঅল শান্ত ভাবে ‘জীবন’ নামক চাকুরি হইতে অবসর গ্রহণ করিয়াছেন। ক্ষতি কী?

এমন সংস্থার এক কর্ণধার এক বার বলিয়াছিলেন, নিজ ইচ্ছায় সসম্মানে মারা যাইবার অধিকার মানুষের ‘‘শেষ মানবাধিকার’’। এবং তাঁহার সংস্থা সেই অধিকার পূর্ণ মর্যাদায় প্রদান করিতে উৎসুক, যদি আত্মহত্যাকামী কমবয়স্ক ও ব্যাধিহীন হন, তাহা হইলেও। অর্থাৎ, জীবনের ক্ষেত্রে ক্লান্ত ও হতাশ হইবার অধিকার কেবল অসহায় রোগীর, এই মতকে তিনি কুসংস্কার বলিয়া মনে করেন। মানবাধিকারের মধ্যে মৃত্যু-অধিকারকে গণ্য করা হইবে কি না, তর্কের বিষয়। মানুষকে জীবনের প্রতি উজ্জীবিত করিয়া তুলিবার যে গদগদ উপদেশাবলি বা মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা প্রচলিত, তাহা মানুষকে জীবনের প্রতি অধিক বিরক্ত করিয়া তুলে কি না, তাহাও অনিশ্চিত। কিন্তু ডেভিড গুডঅল-এর ন্যায় মানুষেরা মূল্যবান, কারণ তাঁহারা নিজ জীবন ও মৃত্যু দিয়া এই গুরুতর প্রশ্নগুলিকে জন-আলোচনার পরিসরে লইয়া আসেন।

যৎকিঞ্চিৎ

ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বললেন, ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে রবীন্দ্রনাথ নোবেল বর্জন করেছিলেন। দেখেছ, আর আমরা কিনা এত দিন ভাবছি, নোবেল চুরি গিয়েছে! শুধু শুধু তুমুল হইহল্লা, দোষারোপ, হাহুতাশ, এমনকী সিনেমা! তবে রবিবাবুরও বলিহারি, এত বড় কাজ করে সেটা পুরোপুরি চেপে গেলেন! তাঁর এ লাজুকতায় আমাদের কত বছরের গর্ব ও আনন্দাশ্রু মার গেল! দারুণ কথাটি গোপনে রাখার জন্য ওঁর নাইট উপাধিটা কেড়ে নিলে হয় না?

Euthanasia Human Rights David Goodall
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy