Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
টুইটারর ২৮০ অক্ষরে নরেন্দ্র মোদীকে হারানো যাবে না
Indira Gandhi

রাহুল পারবেন ইন্দিরা হতে?

ইন্দিরা নিজেও রায়বরেলী থেকে পঞ্চান্ন হাজারের বেশি ভোটে হেরে যান। কংগ্রেসের ব্যর্থতার পুরো দায় ইন্দিরা নিজে নিয়েছিলেন।

নেতৃত্ব: রাজীব গাঁধীর মৃত্যুবার্ষিকীতে উপস্থিত সনিয়া গাঁধী, প্রণব মুখোপাধ্যায় ও রাহুল গাঁধী

নেতৃত্ব: রাজীব গাঁধীর মৃত্যুবার্ষিকীতে উপস্থিত সনিয়া গাঁধী, প্রণব মুখোপাধ্যায় ও রাহুল গাঁধী

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

বছর চারেক আগের নভেম্বর মাসের কথা। প্রণব মুখোপাধ্যায় ইন্দিরা গাঁধী শতবার্ষিকী বক্তৃতা করছেন। মঞ্চে মনমোহন সিংহ, সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে রাহুল গাঁধীও। প্রণববাবু জরুরি অবস্থার পরে ১৯৭৭-এর নির্বাচনে হেরে গিয়েও ইন্দিরার তিন বছরের মধ্যে ফের ক্ষমতায় ফেরার গল্প শুনিয়েছিলেন সে দিন।

কী সেই গল্প? ১৯৭৭-এর ভোটে কংগ্রেস মাত্র ১৫৪টি আসনে জিতেছিল। ইন্দিরা নিজেও রায়বরেলী থেকে পঞ্চান্ন হাজারের বেশি ভোটে হেরে যান। কংগ্রেসের ব্যর্থতার পুরো দায় ইন্দিরা নিজে নিয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র দু’মাস পরেই গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে দেশ জুড়ে সফর শুরু করেন। সে সময় তাঁর দিন শুরু হত সকাল ৬টায়। শেষ হত রাত তিনটেয়। বিহারের নালন্দায় দলিত-হত্যার পরে কী ভাবে তিনি সাড়ে তিন ঘণ্টা কাদাভর্তি রাস্তায় হেঁটে, কিছুটা হাতির পিঠে চেপে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলেন, তারও বিশদ বর্ণনা দিয়েছিলেন প্রণববাবু, “১৯৮০-র ইন্দিরা ছিলেন লড়াকু নেত্রী, যিনি সমস্ত অপমান, কটাক্ষ পেরিয়ে ক্ষমতায় ফিরছেন। তাঁর পদবি বা নেহরুর উত্তরাধিকারের জোরে নয়। মানুষের সমস্যা তুলে ধরা ও তাঁদের নিজের সঙ্গে জড়ো করার দৃঢ়সঙ্কল্প তাঁকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিল।”

রাহুল গাঁধীর কি প্রণববাবুর সেই বক্তৃতার কথা মনে রয়েছে? মনে পড়লে হয়তো বুঝতে পারতেন, তাঁর কোথায় খামতি হচ্ছে। তাঁর দলের নেতারা কোথায় তাঁর ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।

ইন্দিরার মতোই রাহুলও ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের ভরাডুবির দায়িত্ব নিয়েছেন। ফারাক হল, ইন্দিরা দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাননি। রাহুল কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে পদত্যাগ করেছেন। আরও ফারাক রয়েছে। ১৯৭৭-এর হারের দায়িত্ব নিয়ে ইন্দিরা বলেছিলেন, “আমি ১১ বছর ধরে পার্টির নেতৃত্বে। ব্যর্থতার দায় আমার। মানুষের রায়কে সম্মান জানাতেই হবে। আমি খোলাখুলি ভাবে এই রায় মাথা পেতে নিচ্ছি।” রাহুল হয়তো ইন্দিরার মতো ১১ বছর পার্টির শীর্ষপদে ছিলেন না। কিন্তু তিনি মন থেকে ব্যর্থতার দায় পুরোপুরি নিজেই নিয়েছেন, তা বলা যায় না। ইস্তফার চিঠিতে রাহুল লিখেছিলেন, “বহু মানুষকে ২০১৯-এর হারের জন্য দায়ী করতে হবে। সভাপতি হিসেবে নিজের দায়িত্ব অবজ্ঞা করে অন্যদের দায়ী করা অনুচিত হবে।” রাহুলের চিঠিতেই স্পষ্ট, পদত্যাগ করলেও তিনি আসলে একা হারের দায়িত্ব নিতে নারাজ ছিলেন।

গত সপ্তাহ দেড়েক ধরে কংগ্রেস ফের খবরের শিরোনামে। বহু দিন পর। গত সওয়া এক বছরে মনে হচ্ছিল, কংগ্রেস নেতারা বোধ হয় নিজেরাই কংগ্রেস সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ২৩ জন কংগ্রেস নেতার সনিয়া গাঁধীকে লেখা চিঠি দেখে বোঝা গেল, না, সকলে উৎসাহ হারাননি।

‘বিক্ষুব্ধ কংগ্রেসি’-র তকমা পাওয়া কংগ্রেস নেতারা সনিয়াকে পাঠানো চিঠিতে কী কী লিখেছেন, তা এত দিনে বহু আলোচিত। তাঁরা দলের অধঃপতনের বস্তুনিষ্ঠ ময়নাতদন্ত চেয়েছেন। শীর্ষনেতৃত্বে শূন্যতার অভিযোগ তুলেছেন। এ সবের বাইরে কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে ঝড় তোলা সেই পাঁচ পৃষ্ঠার চিঠি খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, চিঠির নিশানা আসলে রাহুল গাঁধী। এমন নয় যে, এই নেতারা কংগ্রেস সভাপতি পদে রাহুলের প্রত্যাবর্তন আটকাতে চাইছিলেন। তাঁদের মূল দাবি, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে একা না লড়ে রাহুল সকলের সঙ্গে আলোচনা করে রণনীতি তৈরি করুন। লড়াইয়ের জন্য সংগঠন তৈরি করুন।

আসলে হতাশ নেতারা যেটা বলেননি, কিন্তু বোঝাতে চেয়েছেন, তা হল, রাহুল গাঁধী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে পেরে উঠবেন না। তাঁকে কংগ্রেসের গোটা নেতৃত্বকে, গোটা বিজেপি-বিরোধী শিবিরকে সঙ্গে নিতে হবে। রাহুল একা নিজেকে মোদীর বিরুদ্ধে তুলে ধরলে, ভোটারদের চোখে তুল্যমূল্য বিচারে রাহুল পিছিয়েই থাকবেন। অন্তত এখনও ছবিটা তা-ই।

রাহুল কি সেটা বুঝেও মানতে নারাজ? সদ্য প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে রাহুল তাঁর হঠাৎ হঠাৎ বিদেশে উধাও হয়ে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন, দেশে দিনরাত নিরাপত্তাকর্মীদের ঘেরাটোপে থাকতে হয় বলে তাঁর জীবনে ব্যক্তিগত পরিসর বলে কিছু নেই। তাই বিদেশে একটু খোলা বাতাসে শ্বাস নিতে যান। বিজেপি-আরএসএস নামক রাজনৈতিক যন্ত্র তাঁকে উদাসীন, অনিচ্ছুক রাজনীতিক হিসেবে তুলে ধরতে চায়। প্রশ্ন হল, রাহুল কেন বিজেপি-আরএসএসের এই চেনা ফাঁদে পা দেন? কেন তিনি ইন্দিরার মতো ভারত সফরে বেরিয়ে পড়েন না বা তাঁর মতো দিবারাত্র পরিশ্রম করেন না? বিজেপি-আরএসএস নামক রাজনৈতিক যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়বার মতো যন্ত্র বা সংগঠন কি তাঁর সঙ্গে রয়েছে? তা তৈরি না করে কেন তিনি শুধুই ঘরে বসে সকাল-বিকেল টুইট করবেন?

হতাশ কংগ্রেস নেতারা এইখানেই ঘা দিয়েছেন। তাঁরা দলের শীর্ষপদে সক্রিয়তা দেখতে চাইছেন। ২৩ জন ‘বিক্ষুব্ধ’ নেতার মধ্যে অধিকাংশই প্রবীণ। চিঠিতে তাঁরা সবচেয়ে বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কংগ্রেসের থেকে তরুণ প্রজন্মের ভোট সরে যাওয়া নিয়ে। ছাত্র ও যুব সংগঠন থেকে তরুণ নেতাদের তুলে আনা নিয়ে। গত দুই লোকসভা নির্বাচনে দেশে ১৮.৭ কোটি নতুন ভোটার যোগ হয়েছে। তাঁদের সিংহভাগ ভোট গিয়েছে মোদী ও বিজেপির দিকে। এই অধোগতি আটকানো না গেলে কংগ্রেস জাতীয় স্তরেও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে।

রাহুলের অনুগামীরা বলতে পারেন, বিক্ষুব্ধরা ব্যক্তিগত স্বার্থে, দলে ক্ষমতা পেতে বিদ্রোহ করছেন। রাহুল তো ইন্দিরার মতো ১১ বছর দলের শীর্ষপদে ছিলেন না। মাত্র আড়াই বছর সভাপতির পদে থেকে তিনি কেন ভরাডুবির যাবতীয় দায়িত্ব নেবেন?

দায়িত্ব না নিলেও গত সওয়া এক বছরে কংগ্রেসের নিষ্ক্রিয়তার জন্য রাহুল গাঁধীই দায়ী, এতে কোনও ভুল নেই। তিনি সভাপতির দায়িত্ব ছেড়েছেন। কিন্তু ক্ষমতা ছাড়তে চাননি। আবার সংগঠনে রদবদলের চেষ্টাও করেননি। রাহুল ও প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা দু’জনেই গাঁধী পরিবারের বাইরের কারও কংগ্রেস সভাপতি হওয়া উচিত বলে জানিয়েছেন। কিন্তু অসুস্থ সনিয়া গাঁধীকে অন্তর্বর্তী সভানেত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিতে পরিবারের বাইরের কারও সভাপতি পদে নির্বাচনে সক্রিয় হননি। উল্টে রাহুল শিবির তাঁকেই মোদীর একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে।

রাহুল বুঝতে চাননি, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের বিজেপির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত স্তরে লড়াই চলে না। বিজেপি-আরএসএসের দেশ জুড়ে সংগঠন, ডিজিটাল প্রচারবাহিনীর সঙ্গে তিনি একা পেরে উঠবেন না। সমানে সমানে লড়তে হলে তাঁকে কোমর ভাঙা কংগ্রেসের সংগঠন মজবুত করতে হবে। আমজনতার সমর্থন জোগাড় করতে হবে। শুধু নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারের নিন্দা, সমালোচনা করে গেলে চলবে না। ২০১৯-এর ভোটের আগে রাহুলের প্রধান লক্ষ্য ছিল, নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিতে ধাক্কা দেওয়া। রাফাল দুর্নীতি নিয়ে সরব হওয়ার পিছনে সেটাই ছিল মূল রণকৌশল। কংগ্রেসের অনেক নেতাই রাহুলের সঙ্গে সে দিন একমত ছিলেন না। এখনও রাহুলের এই রণকৌশলের সঙ্গে তাঁরা একমত নন।

১৯৭৭-এ কংগ্রেসের হারের পরে ইন্দিরার সঙ্গে কংগ্রেসের পার্টির নেতারা একমত হননি। ইন্দিরা তখন জনতা পার্টির সরকারের বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন। কিন্তু ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি, ওয়াই বি চহ্বাণের মতো বাকি কংগ্রেস নেতাদের মত ছিল, মানুষ জরুরি অবস্থার জন্য কংগ্রেসকে শাস্তি দিয়েছে। এর পরে যদি কংগ্রেস জনতা পার্টির সঙ্গে সহযোগিতা না করে, তা হলে মানুষ ক্ষমা করবে না। ১৯৭৮-এ কংগ্রেস দ্বিতীয় বার দু’টুকরো হয়। তৈরি হয় ইন্দিরা কংগ্রেস।

ইন্দিরা শতবার্ষিকী বক্তৃতায় প্রণববাবু মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ইন্দিরা-বিরোধী অধিকাংশ কংগ্রেস নেতাই ১৯৮০-র ভোটে হেরে যান। একে একে তাঁরা ইন্দিরার দলেই ফিরে আসেন। সনিয়া-রাহুলকে সাক্ষী রেখে সে দিন প্রণববাবু বলেছিলেন, গাঁধী পদবি বা নেহরুর উত্তরাধিকারে এই সাফল্য আসেনি। সাফল্য এসেছিল ইন্দিরার মানুষের সমর্থন জোগাড়ের লড়াইয়ের মাধ্যমে।

ইন্দিরার প্রিয় পৌত্রকে বুঝতে হবে, শুধুমাত্র টুইটারের ২৮০ অক্ষরে মোদী-নিন্দা করে দেশের মানুষের সমর্থন জোগাড় সম্ভব নয়। শুধু তা করলে, কালের নিয়মে কবে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা কমবে, সে আশাতেই বসে থাকতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE