আবারও এক বৃদ্ধার নিগ্রহ। স্মৃতিভ্রষ্টা শাশুড়িকে প্রকাশ্যে মারধর করিতেছেন পুত্রবধূ। বার্ধক্য মানুষকে নানা ভাবে বিপন্ন করিয়া ফেলে। বিশেষত অসুস্থ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার পরনির্ভরতা তাঁহাদের পারিবারিক নির্যাতনের সহজ লক্ষ্য করিয়া তোলে। নির্যাতনের অভিযোগে পুত্রবধূকে গ্রেফতার করিয়াছে বাঁশদ্রোণী থানার পুলিশ। বার্ধক্যপীড়িত মানুষের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন যে অপরাধ, সেই কথাটি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। মারধর, কটুবাক্যের বর্ষণ সাধারণত হয় অন্তরালে। সম্পত্তি থাকিলে নির্যাতনের ভয়, না থাকিলে গৃহহারা হইবার ভয়। স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড, মেলাপ্রাঙ্গণ কিংবা হাসপাতালে পরিত্যক্ত হইতেছেন বৃদ্ধরা। মনে রাখিতে হইবে, প্রশ্ন কেবল আশ্রয়, খাবার এবং ঔষধ জোগাইবার নহে। এখন স্বাস্থ্যের সহিত উত্তম জীবনযাপনকেও (ওয়েলবিয়িং) সমান গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। বাঁচিলেই হইবে না, জীবন উপভোগ্য হইতে হইবে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শারীরিক পরিচর্যা যথাযথ হইলেও তাঁহারা যদি উপেক্ষিত হন, নিঃসঙ্গ, কর্মহীন, বাক্যহীন দিন কাটাইতে বাধ্য হন, তাহাকে কোনও মতেই সুস্থ বার্ধক্য বলা চলিবে না।
বৃদ্ধের প্রতি অনাদর, অবহেলার নিরসন চাহিলে সন্তানের সমস্যাও বুঝিতে হইবে। বৃদ্ধ পিতামাতার দায়িত্ব সন্তানের, কিন্তু দায় বহন করিবার ক্ষমতাও বিচার্য। প্রায়ই দেখা যায়, শয্যাশায়ী বৃদ্ধ কিংবা স্মৃতিভ্রষ্টা বৃদ্ধার দেখাশোনার সম্পূর্ণ দায় আসিয়া পড়ে পরিবারের কোনও একটি সদস্যের উপর। সে বিষয়ে ওই ব্যক্তির ইচ্ছা, পারদর্শিতা, দৈহিক বা মানসিক ক্ষমতা, কিছুই বিচার করা হয় না। পরিচর্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তিটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মহিলা। ধনী পরিবারে যে কাজের জন্য দুই-তিন জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হয়, দরিদ্রের পরিবারে তাহার দায় বর্তায় এক জনের উপর। তৎসহ থাকে সংসারের অপরাপর কর্তব্য। অনেক সময়ে শুশ্রূষাদাত্রী নিজেও প্রৌঢ়া, অসুস্থ, নানা উদ্বেগ-অবসাদে আক্রান্ত। তাঁহারও চিকিৎসা ও সহায়তা প্রয়োজন। কিন্তু বৃদ্ধের সহিত তিনিও উপেক্ষিত রহিয়া যান। বিশেষত স্মৃতিভ্রংশ বা মনোরোগে আক্রান্ত বৃদ্ধদের নিরন্তর নজরদারি প্রয়োজন হয়। দীর্ঘ দিন এমন পরিচর্যা এতই চাপ সৃষ্টি করে, যে তাহার ফলে শুশ্রূষাকারীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হইতে পারে। পশ্চিমের দেশগুলিতে চিকিৎসকরা মনোরোগী ও বৃদ্ধদের চিকিৎসার সহিত পরিবারের সদস্যদেরও পরামর্শ দিয়া থাকেন।
অতএব বৃদ্ধদের পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ করিতে হইলে পরিবারকে কেবল শাস্তি দেওয়া যথেষ্ট নহে। পরিচর্যাকারীর প্রতিও নজর দিতে হইবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। আজ পরিবার ছোট, আয় অনিশ্চিত, কিন্তু আয়ু দীর্ঘ। ভারতে ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির সংখ্যা এখন দশ কোটিরও অধিক, তাঁহারা জনসংখ্যার আট শতাংশ। এই অনুপাত ক্রমে বাড়িবে। বৃদ্ধদের পরিচর্যা কেবল পরিবারের সদস্যদের, বিশেষত মহিলাদের বেতনহীন শ্রমের উপর ছাড়িয়া রাখিলে অন্যায় হইবে। সামাজিক সুরক্ষার নানা প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজকে তাহার আংশিক বা সম্পূর্ণ দায় লইতে হইবে। না পারিলে তাহা প্রকারান্তরে বৃদ্ধদের অবহেলা বা নির্যাতনের মৌন সাক্ষীর অবস্থানেই দাঁড় করাইবে রাষ্ট্রকে। পুত্রবধূর হাজতবাস বৃদ্ধা শাশুড়ির সমস্যা বাড়াইবে, কমাইতে পারিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy