Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ১

অহং কঠিন বস্তু

পীযূষ গয়াল বলিয়াছেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে এখনও অনেক টাকা আছে, যাহার কোনও ব্যবহারই নাই। অস্যার্থ, সেই তহবিল হইতে টাকা লইয়াই তাঁহারা অর্থনীতির হাল ফিরাইবেন।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:৪৪
Share: Save:

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন সরকারের মূল চালিকাশক্তির নাম অহং। এবং, অহংয়ের সহিত ভুল স্বীকারের একেবারে গোড়ায় বিরোধ। ফলে, তাঁহারা যে ভারতীয় অর্থনীতিকে বগলদাবা করিয়া স্বখাতসলিলে ডুবিতেছেন, নির্মলা সীতারামনরা কিছুতেই তাহা স্বীকার করিবেন না। এমনকি, যাবতীয় পরিসংখ্যান চোখে আঙুল দিয়া ভুলটি দেখাইয়া দিলেও না। নোট বাতিলই যেমন। এই তুঘলকি সিদ্ধান্তের ফলে অর্থনীতির কী ক্ষতি হইয়াছে, হরেক সূচকে তাহা স্পষ্ট। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সম্প্রতি প্রকাশিত বার্ষিক রিপোর্ট বলিতেছে, সিদ্ধান্তটি তাহার ঘোষিত উদ্দেশ্যগুলিও পূরণ করিতে পারে নাই। অর্থনীতিতে নগদের ব্যবহার রীতিমতো বাড়িয়াছে। ৫০০ এবং ২০০০ টাকার নকল নোটের সংখ্যাও বাড়িতেছে। রিপোর্টটি প্রকাশিত হইয়াছে গত বৃহস্পতিবার। তাহার পর অর্থমন্ত্রী এক গঙ্গা-যমুনা কথা বলিয়া ফেলিয়াছেন। কিন্তু এক বারও বলেন নাই, সিদ্ধান্তটি ভুল— বস্তুত, আত্মঘাতী ছিল। অহং কঠিন বস্তু।

তাঁহারা বরং কুযুক্তির বান বহাইতেছেন। পীযূষ গয়াল বলিয়াছেন, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে এখনও অনেক টাকা আছে, যাহার কোনও ব্যবহারই নাই। অস্যার্থ, সেই তহবিল হইতে টাকা লইয়াই তাঁহারা অর্থনীতির হাল ফিরাইবেন। শ্রীগয়াল অর্থনীতিবিদ নহেন— সৌভাগ্যক্রমে দেশের অর্থমন্ত্রীও নহেন। কিন্তু, স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সগৌরবে বলিতেছেন, এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চিনের তুলনায় ভারতে আর্থিক বৃদ্ধির হার বেশি, ফলে চিন্তার বিন্দুমাত্র কারণ নাই। তিনি অর্থনীতির ছাত্রী ছিলেন। নিশ্চয় জানেন, বৃদ্ধির হার একটি সংখ্যামাত্র— মার্কিন বা চিনা অর্থনীতির আয়তনের সহিত ভারতের তুলনাই চলে না। এবং, মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও ভারত বহু, বহু পিছনে। বস্তুত, বৃদ্ধির হারের গর্বটিও আর নাই— এপ্রিল হইতে জুনের ত্রৈমাসিকে ভারতের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল পাঁচ শতাংশ, চিনের ৬.২ শতাংশ। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কর্তারা আর্থিক মন্দার কারণ হিসাবে ‘সাইক্লিক’ কারণ বা আর্থিক চক্রের কথা শুনাইয়াছেন— ‘চক্রবৎ পরিবর্তন্তে’র চক্র। বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী, বিজেপি নেতা সুশীল মোদী বলিয়াছেন শ্রাবণ মাসে স্বাভাবিক বাণিজ্যহ্রাসের কথা। এবং, নরেন্দ্র মোদী কিছুই বলেন নাই। এই জাতীয় সঙ্কট উপস্থিত হইলে তিনি মৌনীই থাকেন। কিন্তু, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, কেহ স্বীকার করেন নাই যে মূলত সরকারের ভুলেই আজ এই অবস্থা। মনমোহন সিংহ কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন— কিন্তু, যুক্তিতে না শানাইলে ‘ট্রোল’ করিবার অস্ত্র তো আছেই। অতএব, মা ভৈঃ।

অর্থনীতির এই অবস্থা আন্তর্জাতিক কারণে নহে। মার্কিন-চিন বাণিজ্য যুদ্ধে উভয় দেশ অপেক্ষা ভারত বেশি জখম হইয়াছে, বলিলে পরিহাসের পাত্র হইতে হয়। তেলের দাম এখনও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, রাজনৈতিক অস্থিরতাও তেমন নাই। এই বাজারেই ভিয়েতনামের আয় বৎসরে দশ শতাংশ হারে বাড়িতেছে। আর, ভারতে উৎপাদন ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ০.৬ শতাংশ, কৃষিতে দুই শতাংশ মাত্র। নমিনাল, অর্থাৎ টাকার অঙ্কে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে নামিয়া আসিয়াছে। নেহাত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে, নচেৎ আর্থিক বৃদ্ধির হার আরও শোচনীয় দেখাইত। তবুও তাঁহারা স্বীকার করিবেন না, কার্যত প্রতিটি আর্থিক সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। নোট বাতিল ভুল, জিএসটি-র প্রয়োগ ভুল, তাহার চতুর্মুখী করের হার ভুল, সংস্কারের অভাব ভুল, কৃষির দিকে নজর না দেওয়া ভুল, বাজেটে বিবিধ সিদ্ধান্তের জাঁতাকলে বাণিজ্যের পরিবেশ আরও নষ্ট করিয়া দেওয়া ভুল, সমানে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঘাড়ে বন্দুক রাখিয়া নিজেদের খামতি ঢাকিবার চেষ্টাটি ভুল। তাঁহাদের অহং এই ভুল স্বীকার করিতে দিবে না। সরকারের সব মতের সহিত সহমত নহেন, এমন কোনও বিশেষজ্ঞের সাহায্যও লইতে দিবে না। ফলে, সুরাহা হইবে, তেমন আশা করিতেও ভরসা হয় না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE