Advertisement
E-Paper

অতিরাষ্ট্রের সংকট

রাষ্ট্রশক্তি স্বাতন্ত্র্যকামীদের পৃথক ভূখণ্ড ও স্বাধিকারের দাবি বরদাস্ত করিবে না, ইহা অস্বাভাবিক নহে। কারণ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তাহাতে বিপন্ন হইবে, বৃহত্ত্ব তাহাতে খর্ব হইবে।

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০১৭ ০০:১২

বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন গোষ্ঠী স্বাধিকারের দাবিতে সরব। স্পেনের ক্যাটালানরা এই মুহূর্তে শিরোনামে। তাঁহারা তাঁহারা গণভোটে স্বতন্ত্র ক্যাটালনিয়ার দাবি উত্থাপন করিয়াছেন। ক্যাটালান পার্লামেন্ট এই দাবিকে স্বীকৃতি দিয়াছে। কিন্তু স্পেনের আদালত ৬ সেপ্টেম্বর দাবি নাকচ করিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় বলিয়াছেন, স্বতন্ত্র ক্যাটালনিয়ার দাবি লইয়া যে গণভোট হইয়াছে তাহা অবৈধ, অসাংবিধানিক। ক্যাটালনিয়ার প্রাদেশিক সরকারের জবাব— তাঁহারা অচিরে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করিবেন। এই সংঘাত নূতন নহে, তবে এখন তাহার নূতন তেজ। তুরস্কের কুর্দরাও স্বতন্ত্র কুর্দিস্তানের পুরানো দাবি নূতন করিয়া তুলিয়াছেন। তুরস্ক সরকারও ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের দাবি মানিতে নারাজ।

রাষ্ট্রশক্তি স্বাতন্ত্র্যকামীদের পৃথক ভূখণ্ড ও স্বাধিকারের দাবি বরদাস্ত করিবে না, ইহা অস্বাভাবিক নহে। কারণ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব তাহাতে বিপন্ন হইবে, বৃহত্ত্ব তাহাতে খর্ব হইবে। বৃহৎ ক্ষুদ্র হইতে চাহে না। এই কারণেই বৃহৎ বিপজ্জনক। বিশেষত, বৃহৎ জাতীয়তাবাদ। রবীন্দ্রনাথ তাহা বিলক্ষণ জানিতেন। শতবর্ষ পূর্বে ‘ন্যাশনালিজম্‌’ নামক বক্তৃতানিবন্ধে তিনি রাষ্ট্রশক্তির সহিত জনশক্তির বিরোধের প্রসঙ্গটি উত্থাপন করিয়াছিলেন, এক রাষ্ট্রের সহিত অপর রাষ্ট্রের সংঘাতের বিষয়টি বিবেচনা করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে আধুনিক রাষ্ট্র একটি কৃত্রিম সংগঠন। ভূখণ্ডকেন্দ্রিক এই সংগঠনটি বিশেষ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক লাভের স্বার্থে তৎপর। সেই কথা ভাবিয়া সকলকে এক পথে কৃত্রিম ভাবে পরিচালিত করাই আধুনিক রাষ্ট্রের লক্ষ্য। ব্যক্তির বিভিন্ন গোষ্ঠীর ঐকান্তিক ইচ্ছাকে রাষ্ট্র গুরুত্ব প্রদানে নারাজ। রবীন্দ্রনাথ রাষ্ট্রের বিপরীতে ‘সমাজ’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছিলেন। তাঁহার মতে সমাজ বহুত্ববাদী, একত্বের নামে নানাত্বকে কণ্ঠরোধ করিতে সমাজ তৎপর নহে। তিনি মনে করিতেন, ভারতবর্ষ যদি ইউরোপের আদলে ‘রাষ্ট্র’ গড়িয়া তুলিতে চাহে তাহা হইলে স্বদেশের ক্ষতি হইবে। বহুত্বের বিচিত্র ধারাটি রুদ্ধ হইবে।

সমাজ বনাম রাষ্ট্র— এই ভাবে বিষয়টির বিচার না করিয়া আর এক দিক হইতে ভাবা যাইতে পারে। রবীন্দ্রনাথ নিজে রাষ্ট্রের বিশেষ একটি রূপের সমালোচক ছিলেন। তথাপি তিনি নিজে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বহু দেশ ঘুরিয়া দেখিয়াছিলেন। যে-স্থলে রাষ্ট্রব্যবস্থা সাংস্কৃতিক বহুত্বকে স্বীকার করে, জনমতকে গুরুত্ব দেয়, সে-স্থলে রাষ্ট্রব্যবস্থা কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আনুকূল্য পাইয়াছে। রাষ্ট্রের একতার নামে বিশেষ সংস্কৃতিকে সকলের মাথার উপরে প্রবল ভাবে চাপাইয়া দেওয়ার উৎপাত শুরু হইলেই স্বাতন্ত্র্যের দাবি প্রবল হইয়া উঠে। সমকালীন পৃথিবীতে তাহাই ঘটিতেছে। রাষ্ট্র যত প্রবল হইতেছে, অতিজাতীয়তাবাদ যত প্রকট, তাহার প্রতিক্রিয়াও তত জোরদার। এই বাস্তবের সম্মুখে রাষ্ট্রনায়কদের নমনীয় হইতে হইবে। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রেই নানা জনগোষ্ঠীর অধিষ্ঠান। বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের সহিত রাষ্ট্রের সম্বন্ধ ভয়ের বা কলহের যেন না হয়। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর মানুষ যেন সমভাবে বুঝিতে পারেন, ইহা তাঁহাদেরই দেশ। এই বোধ সহজ হইলে স্বাতন্ত্র্যের দাবি আর প্রবল হইবে না। রাষ্ট্রকে বাতিল করা সম্ভব নহে, তাহার প্রয়োজনও নাই, রাষ্ট্র নামক সংগঠনটির রূপগত ও গুণগত বদল কাম্য।

Catalonia Freedom State
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy