শিশুদের লইয়া বিস্তর চিন্তা। ইদানীং একটি বড় চিন্তা— শিশুরা যেন অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক, মোবাইল ও ইন্টারনেট জগতে আচ্ছন্ন থাকিয়া বাস্তব পৃথিবী হইতে বিচ্ছিন্ন। অন্য মানুষের সহিত তাহাদের যোগাযোগ নাই, যোগাযোগের তাগিদও নাই। এবং হয়তো সেই কারণেই সহানুভূতি বা সমানুভূতির মতো মানবিক বৃত্তিগুলি আর তাহাদের মধ্যে যথেষ্ট বিকশিত নহে। ইহাতে তাহাদের মানসিক বিকাশ সঙ্কীর্ণ হইয়া পড়িতেছে এবং বৃহত্তর অর্থে সমাজের উপরও প্রভাব পড়িতেছে। এই অবস্থা বিচার ও বিশ্লেষণ করিয়া একটি সংস্থা সম্প্রতি শিশুদের পাঠ্যক্রমে এমন কিছু সংশোধনের প্রস্তাব দিয়াছে, যাহা অনুসরণ করিলে তাহাদের মানবিক গুণগুলির প্রকাশ উৎসাহিত হইতে পারে। উদ্দেশ্য সাধু। মানবিকতার স্ফুরণ ঘটাইবার উদ্যোগ সফল হইলে সমাজের পরম কল্যাণ।
তবে কেবল পাঠ্যক্রম বা পদ্ধতি সংশোধন করিয়া সহমর্মিতা বা সহানুভূতির উন্মেষ ঘটানো কঠিন। সে জন্য সর্বাগ্রে শিক্ষকদের এই মনোবৃত্তিগুলির চর্চা করিতে হইবে। যে শিক্ষকরা মানবিকতার পাঠ দিবেন, তাঁহাদের মানবিক বোধ অত্যাবশ্যক। তবে তাহার পরেও প্রশ্ন থাকিয়া যায়। মৌলিক প্রশ্ন। বাহির হইতে শিক্ষা দিয়া মানবিক গুণ কতটা জাগ্রত করা যায়? কোনও শিশুর মধ্যে যদি স্বাভাবিক সহানুভূতি বা সমানুভূতির আবেগ উপস্থিত না থাকে, তাহা হইলে কেবল শিক্ষার প্রেরণায় সে অপরের দুঃখে উদ্বেল হইবে কি? সমানুভূতি অনুভব করিতে হইলে আপন অন্তরে অন্যের দুর্দশা, যন্ত্রণার শরিক হইয়া উঠিতে হয়। তাহা সহজ কাজ নহে। আত্মীয়-পরিজন বা বন্ধুর প্রতি এই অনুভূতি সচরাচর থাকে বটে, কিন্তু অচেনা মানুষের প্রতি অনেক সময়েই তাহা থাকে না। ইহার জন্য শিশুশিক্ষার পদ্ধতি বা পরিবেশকে পুরোপুরি দোষারোপ করা যায় না। কাহার মধ্যে এমন আবেগ কতটা পরিমাণে উপস্থিত থাকিবে, তাহা সম্ভবত অনেকাংশেই আপেক্ষিক, ব্যক্তিনির্ভর।
বরং এই কথাগুলি মাথায় রাখিয়া অন্য একটি গুণ শিশুমনে প্রোথিত করিয়া দিবার কথা ভাবা যাইতে পারে। তাহা হৃদয়বৃত্তি নহে, বৌদ্ধিক গুণ। তাহার নাম নীতিনিষ্ঠতা। কিংবা, ঔচিত্যবোধ। যেমন, অপরকে সাহায্য করা কর্তব্য, কেহ বিপদে পড়িলে তাহার পাশে দাঁড়ানো উচিত, কাহাকেও অযথা দুঃখ দেওয়া বা আঘাত করা অন্যায়— ইত্যাদি মৌলিক নীতি যদি, নীতি হিসাবে, শিশুর মনে গাঁথিয়া দেওয়া যায়, তাহা হইলে তাহাদের আচরণে সেই শিক্ষার প্রভাব পড়িতে পারে। তাহার অর্থ এমন নহে যে, মানবিকতার পাঠ দিবার প্রয়োজন নাই। নীতি এবং মানবিকতা, দুইয়ের কোনও বিরোধ নাই। বস্তুত, একে অপরের পরিপূরক। ঔচিত্যবোধ প্রবল হইলে তাহার ভিত্তিতে সহানুভূতিও অনেক বেশি জোরদার হইতে পারে। সুতরাং, দুই ধরনের শিক্ষাই চলুক। তবে, নীতি বস্তুটি চরিত্রে অঙ্কের ন্যায়। যে কোনও পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে তাহার মূল শর্তগুলি অভিন্ন। তাহার প্রথম ও প্রধান আবেদন হৃদয়ের নিকট নহে, মস্তিষ্কের নিকট। সেই কারণেই যে কোনও শিশুকে, অন্তত অধিকাংশ শিশুকে তাহার শর্তগুলি শেখানো তুলনায় সহজ। সেই শিক্ষা সম্পন্ন হইলে শিশু হয়তো সমাজের প্রতি আপন কর্তব্যগুলি পালন করিবে। অন্তর হইতে না করিলেও, অঙ্ক দিয়া করিবে। তাহাই বা কম কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy