Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

নামসর্বস্ব

কবি বলিতে পারেন, নামে কী-ই বা আসে যায়। কিন্তু রাজনীতিক তাহা বলিতে পারেন না। রাজনীতি নামসর্বস্ব। প্রকল্পের সুবিধা কত জন নাগরিকের মিলিল, কতটুকু উন্নয়ন হইল, সে প্রশ্নগুলি রাজনীতির বিচারে গৌণ হইয়া যায়।

শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

কর্তব্যের ভাগ অপরে নিলে আপত্তি নাই, কৃতিত্বের ভাগ দাবি করিলে সংঘাত বাধে। এই কারণেই কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প লইয়া গোল বাধিতেছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলিয়াছেন, স্বাস্থ্য বিমার যে কার্ড গ্রাহকেরা পাচ্ছেন তাহাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি এবং তাঁহার দল, ভারতীয় জনতা পার্টির দলীয় চিহ্ন পদ্ম অঙ্কিত রহিয়াছে। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প হইতে পশ্চিমবঙ্গকেই বিযুক্ত করিবার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিয়াছেন। একই আপত্তি অতীতে জাতীয় কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তুলিয়াছে বিজেপি। ইন্দিরা গাঁধী কিংবা রাজীব গাঁধীর নামাঙ্কিত অজস্র সরকারি প্রকল্প দেখিয়া বিজেপি নেতারা আক্রমণ করিতেন, ইহা কি রাজনৈতিক প্রচার নহে? অথচ নরেন্দ্র মোদীর সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসিয়া সেই একই পথ ধরিয়াছেন। যে যায় লঙ্কায় ইত্যাদি মনে রাখিয়াও বলিতে হইবে, ‘দীনদয়াল উপাধ্যায় গ্রামীণ কৌশল্য যোজনা’ কিংবা ‘অটল পেনশন যোজনা’ একই ভ্রান্তির সাক্ষ্য বহন করিতেছে। আবার ব্যক্তির নাম না দিয়া পদের নামও ব্যবহৃত হইতেছে একই উদ্দেশ্যে। ‘ইন্দিরা আবাস যোজনা’ হইয়াছে ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’, তৎসহ ফসল বিমা, স্বাস্থ্য বিমা, দুর্ঘটনা হইতে সুরক্ষার বিমাগুলি সবই প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত। রাজ্যগুলির আপত্তি, এই সকল প্রকল্পে রাজ্যের ব্যয়ভার অধিক। তাহা হইলে প্রকল্পগুলি প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত হইবে কেন? কেন কেন্দ্রের বদান্যতার ইঙ্গিত করিবে?

কবি বলিতে পারেন, নামে কী-ই বা আসে যায়। কিন্তু রাজনীতিক তাহা বলিতে পারেন না। রাজনীতি নামসর্বস্ব। প্রকল্পের সুবিধা কত জন নাগরিকের মিলিল, কতটুকু উন্নয়ন হইল, সে প্রশ্নগুলি রাজনীতির বিচারে গৌণ হইয়া যায়। প্রকল্পের প্রচারে কাহার নাম প্রচার হইল, কাহার সহাস্য মুখের ছবি নগর-গ্রামের রাস্তা-ঘাটে শোভা পাইল, তাহাই কার্যক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য হইয়া ওঠে। ইহা অনৈতিক। উন্নয়ন লইয়া প্রতিযোগিতা চলিবে, অধিক কাজ করিয়া অধিক ভোট দাবি করিবেন নেতারা, গণতন্ত্রে ইহা প্রত্যাশিত। কিন্তু প্রতিযোগিতার সবটুকুই প্রচারে সীমাবদ্ধ থাকিবে, কাজে নহে, ইহা অগ্রহণযোগ্য। দরিদ্রের উন্নয়ন হইল কি না, সে প্রশ্নের অপেক্ষা কেন অনেক বড় প্রশ্ন হইয়া দাঁড়াইবে, বিরোধী ফাঁকতালে অধিক প্রচার করিল কি না? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে নামবদলের নীতি লইয়াছিলেন। ‘স্বচ্ছ ভারত প্রকল্প’ হইল ‘মিশন নির্মল বাংলা’। ‘জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশন’ এ রাজ্যে ‘আনন্দধারা’। কিন্তু তাহাও আর যথেষ্ট নহে। মমতা এক মাসের মধ্যে কেন্দ্রের দুইটি প্রকল্প হইতে রাজ্যকে বিযুক্ত করিলেন। প্রথমটি ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’, দ্বিতীয়টি ‘প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা’।

কেন্দ্রীয় প্রকল্প হইতে রাজ্যকে বিযুক্ত করিবার নানা যুক্তি থাকিতে পারে। মোদী সরকারের ফসল বিমা এবং স্বাস্থ্য বিমা, উভয়েরই কার্যকারিতা লইয়া বিশেষজ্ঞরা সংশয় প্রকাশ করিয়াছেন। মুখ্যমন্ত্রী যদি তেমন কোনও যুক্তিতে কেন্দ্রীয় প্রকল্প বাতিল করিতেন, তাহার অর্থ হইত। কিন্তু প্রকল্পের প্রচারে বিরোধীরা গুরুত্ব পাইবে, এই আশঙ্কা কি কেন্দ্রের সহায়তা প্রত্যাখ্যানের যুক্তি হইতে পারে? রাজ্যের বরাদ্দ অধিক অতএব প্রকল্পের প্রচারে রাজ্যের নেতারাই গুরুত্ব পাইবার কথা, এই ধারণাও তো সমান আপত্তিকর। করদাতার অর্থে উন্নয়নের প্রকল্প হয়, নেতার বদান্যতায় নহে। অবিলম্বে ভারতের সকল সরকারি প্রকল্প হইতে ব্যক্তির নাম, সরকারি পদের উল্লেখ, দলীয় চিহ্ন প্রভৃতি লুপ্ত করিবার বিধি প্রয়োজন। প্রকল্পের প্রচারে মৃত বা জীবিত, সকল ব্যক্তির ছবি ব্যবহার নিষিদ্ধ হউক। ২০১৫ সালের একটি রায়ে সরকারি বিজ্ঞাপনে নেতাদের ছবি ব্যবহারে রাশ টানিয়াছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই বিধি আরও কঠিন করা হউক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE