মিতা সাঁতরা।—ফাইল চিত্র।
শুভবুদ্ধির অনুসারী হওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে কোনও পরিস্থিতিতেই অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তাই হৃদয় রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হওয়া সত্ত্বেও আজ স্বস্তি অনুভূত হচ্ছে। কারণ স্বজনবিয়োগে বিধ্বস্ত হয়েও শহিদ জওয়ানের স্ত্রী যে সংবেদনশীলতায় অবিচল ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তারই জয়সূচিত হওয়ার ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে।
ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমান পাকিস্তানের হেফাজত থেকে মুক্তি পাচ্ছেন— তার চেয়ে সুখের খবর এই মুহূর্তে আর কী হতে পারে? ভারতীয় বায়ুসেনার ওই পাইলটকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে এবং নিঃশর্তে মুক্তি দিতে হবে, কোনও দর কষাকষি চলবে না— দ্ব্যর্থহীন বার্তা ছিল ভারতের। পরিস্থিতির চাপেই হোক বা সদিচ্ছার উদ্রেকে, পাকিস্তান মেনে নিল ভারতের দাবি। নিজের দেশের আইনসভায় দাঁড়িয়ে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা করলেন সে কথা।
অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়ার বিষয়ে পাক ঘোষণার খবর ভারতে পৌঁছতেই উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে গোটা দেশে। আসমুদ্র হিমাচল করছিল প্রার্থনা, শুরু করেছে উৎসব এ বার। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, শান্তির বার্তা দিতেই অভিনন্দনকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত। ভারতেও কিন্তু ক্ষোভের আঁচ লহমায় প্রশমনের পথে। পুলওয়ামায় জঙ্গি হামলার পর থেকে যে ক্ষোভে-আক্রোশে-অসন্তোষে ফুঁসছিল গোটা দেশ। অভিনন্দনের মুক্তির ঘোষণা আচমকা পরিস্থিতিতে বদল এনেছে। যুদ্ধই একমাত্র প্রত্যুত্তর পাকিস্তানের জন্য, যুদ্ধই একমাত্র সমাধান এই মুহুর্তে— যাঁরা এ ভাবে ভাবছিলেন, তাঁরাও স্থিতধী হতে শুরু করেছেন। প্রতিবেশীর সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের প্রয়োজনীয়তাটা পাকিস্তান এত দিনে বুঝতে পেরেছে এবং যুদ্ধ ছাড়াই তা বোঝানো গিয়েছে বলে ভারতবাসী এ বার সম্ভবত বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন। সত্যের সবচেয়ে বড় সাফল্য এখানেই।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
সত্য কী? এ ক্ষেত্রে সত্য হল এই যে, যুদ্ধ শুরু হলে কোনও পক্ষই পূর্ণত লাভবান হত না। এ ক্ষেত্রে সত্য হল এই যে, পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ কখনও সুদিন বয়ে আনেনি। এ ক্ষেত্রে সত্য হল এই যে, শুভবুদ্ধির জয় হওয়া অত্যন্ত জরুরি ছিল।
আরও পড়ুন: যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের জেরে ট্রোলড নিহত বাঙালি জওয়ানের স্ত্রী!
পুলওয়ামা হামলায় শহিদ হওয়া সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার স্ত্রী মিতাদেবী কিন্তু এই শুভবুদ্ধির পরিচয়টাই দিয়েছিলেন। স্বজন-বিয়োগের হৃদয়বিদারী যন্ত্রণা সামলেও তিনি যুদ্ধের বিপদ সম্পর্কে সচেতন থেকেছেন, অন্যকেও সচেতন রাখার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আমরা সবাই বোধ হয় মানসিক ভাবে অতটা সক্ষম নই। তাই শুভবুদ্ধিতে অবিচল থাকতে পারনি। যুদ্ধের পক্ষে রৈ-রৈ সওয়াল না করার ‘অপরাধে’ শহিদ জওয়ানের স্ত্রীকে আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র হেনস্থার মুখে ফেলেছি, অবান্তর আক্রমণে বিদ্ধ করেছি, অশালীন কটাক্ষে মেতে উঠেছি। এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আচরণ আর কী হতে পারত! নিজেরা শুভবুদ্ধিতে পারলাম না, নিজেরা সত্যের সঙ্গ দিতে পারলাম না। ধ্বংসস্তূপের মাঝে দাঁড়িয়েও যিনি সে সব পারলেন, তাঁকে কুর্নিশ করতে পারলাম না। কুর্নিশ করা দূরের কথা, হীন অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম না। পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রণে আসার পথে, উত্তজেনা যখন প্রশমিত হওয়ার পথে, তখন কি আমরা বুঝতে পারছি, কতটা নিচতার সাধনায় মত্ত হয়ে উঠেছিলাম আমরা?
সত্যের শক্তি অমোঘ। পরিস্থিতি যত জটিলই হোক, যে কোনও ঘটনার বৃত্ত সত্যে পৌঁছেই সম্পূর্ণ হয়। সীমান্তের ও পার থেকে অভিনন্দন বর্তমানের মুক্তির যে ঘোষণা এ পারে শোনা গেল, তাতে ঘটনা প্রবাহের গতি সত্যের দিকে বাঁক নেওয়ার ইঙ্গিত দিল। পূর্ণ বৃত্তটা তৈরি হওয়া এখনও বাকি। কিন্তু শুভবুদ্ধির জয়ের ইঙ্গিত মিলতে শুরু করেছে। অভিনন্দন ভারত, অভিনন্দন পাকিস্তান, অভিনন্দন মিতা সাঁতরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy