Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

স্বাধীনতার অমর্যাদা

স্বাধীনতা বস্তুটি অমূল্য। কিন্তু সেই অমূল্য স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই কখনও কখনও কিছু মূল্য ধরিয়া দিতে হয়। বিশেষত স্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রবণতা প্রবল হইয়া উঠিলে। প্রসঙ্গটি আসিতেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সিসিটিভি বসাইবার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে।

শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

স্বাধীনতা বস্তুটি অমূল্য। কিন্তু সেই অমূল্য স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই কখনও কখনও কিছু মূল্য ধরিয়া দিতে হয়। বিশেষত স্বাধীনতার অপব্যবহারের প্রবণতা প্রবল হইয়া উঠিলে। প্রসঙ্গটি আসিতেছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সিসিটিভি বসাইবার প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে। কলিকাতার বহু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যেই ক্যামেরার ব্যবস্থা হইলেও যাদবপুরে তাহা এখনও ঘটে নাই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যামেরা বসাইবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হইয়াছিল— প্রত্যাখ্যান করিয়াছিলেন স্বয়ং উপাচার্য। দৃষ্টান্তযোগ্য দৃঢ়তার সহিত বলিয়াছিলেন, তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘মুক্ত পরিবেশ’-এর পক্ষে, ক্যামেরার নজরদারির পক্ষে নহেন। ইহা কয়েক বৎসর আগেকার কথা। তখনও তিনি মুক্ত পরিবেশের ‘মুক্তি’তে আস্থা রাখিতে পারিয়াছিলেন। ‘পরিবেশ’ তাঁহার সেই আস্থাকে সম্মান দেয় নাই, উত্তরোত্তর যাদবপুর ক্যাম্পাস যথেচ্ছাচার ও অনাচারের আড্ডা হইয়া উঠিয়াছে, বুঝাইয়া দিয়াছে, যে ছাত্রছাত্রীদের স্বাধীন বিচরণের অধিকারকে মর্যাদা দিয়া কর্তৃপক্ষ ক্যামেরা বসাইতে নারাজ ছিলেন, সেই তরুণরা এই অধিকারের যোগ্য নহেন। নতুবা নেশা ও নৈরাজ্যের সাগরে প্রিয় প্রতিষ্ঠানের সুনাম তাঁহারা ডুবাইতেন না। স্বাধীনতার দুর্ভাগ্য— যে উপাচার্য ক্যামেরার বিরোধিতা করিয়াছিলেন, আজ তিনিই মত পরিবর্তন করিয়া সিসিটিভির বিষয়টি পুনর্বিচার করিতেছেন। মদ-মাদক প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তাই তাঁহাকে আপসে বাধ্য করিতেছে।

এই রাজ্যের শিক্ষাজগতের পক্ষে ইহা একটি বিরাট দুর্ভাগ্য। মদ-মাদকের অধিকার নিশ্চয়ই গণতান্ত্রিক অধিকার, অতীতে প্রগতিশীলরাই দেশে দেশে এই অধিকার সমর্থন করিয়াছেন। কিন্তু তাই বলিয়া মদ-মাদকই সর্বব্যাপী বাস্তব হইয়া দাঁড়াইলে প্রগতিশীল অবস্থানটিও পুনর্বার ভাবিতে হইবে। অধিকারের সহিত দায়িত্ববোধের কথাও তুলিতে হইবে। অধিকারের প্রথম পাঠটিতেই অধিকার ও দায়িত্বের এই মেলবন্ধনের কথা আছে। নিশ্চয় ছাত্ররা ভাল ভাবেই তাহা জানেন। তৎসত্ত্বেও আজ যাদবপুর ক্যাম্পাসে ঢুকিলে যে চিত্র চোখে পড়ে, দুনিয়ার কোনও উৎকর্ষমুখী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাহা পাওয়া যাইবে না, উৎকৃষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলির কথা না-হয় বাদই থাকুক। বস্টন বা লন্ডন শহরে মদ-মাদকের প্রসার ও প্রচার কিছু কম নয়, তৎসত্ত্বেও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকিলেই ছেলেমেয়েদের নির্বিচার নেশাগ্রস্ততা দেখা যায় না, ভাঙা বোতল ও দগ্ধ মাদকের চিহ্ন চোখে পড়ে না। সম্ভবত সেখানকার সমাজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিতে শিখিয়াছে, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অধিকারের মধ্যে পার্থক্য করিতে জানিয়াছে। এই রাজ্যের ছাত্রসমাজ তাহা শিখে নাই— যাদবপুর উদাহরণ।

সুতরাং আপসটি জরুরি। যে কোনও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য শিক্ষার উৎকর্ষ এবং সাধনা— সেই উৎকর্ষের উপযুক্ত পরিবেশ বজায় রাখা। ছাত্রছাত্রীরা যদি বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও অবোধের মতো আচরণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের শাসন করিয়াই সদাচরণ শিখাইতে হইবে। দিবারাত্রি মদ-মাদকের অধিকার যাঁহারা দাবি করিবেন, তাঁহারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরে অন্যত্র স্থান খুঁজিয়া লউন। নেশার অধিকার কোনও মতেই বিদ্যাচর্চার উপযোগী পরিবেশ পাইবার অধিকারটির উপরে স্থান পাইতে পারে না। এবং দ্বিতীয় অধিকারটি প্রতিষ্ঠার জন্য যদি অন্যান্য ‘অধিকার’ খর্ব করিতে হয়, স্বাধীনতার মূল্য বুঝাইবার জন্য যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার ঠেকাইতে হয়, ক্যামেরা বসাইলে যদি অন্যায়ের প্রতিরোধ সম্ভব হয়, কর্তৃপক্ষ তাহা করুন। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাজগতের প্রায় সবটুকুই দিনান্তবেলার শেষরশ্মির ন্যায়। যে দু’একটি প্রতিষ্ঠানে এখনও কিছু আশার আলো, তাহাদের খড়কুটা ধরিয়াই এই ডুবন্ত রাজ্য আবার এক দিন ভাসিয়া উঠিবে— এমন নাছোড় প্রত্যাশার জন্যই এই আর্জি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE