Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
corona virus

‘আগেই জানতাম’-পণ্ডিতি আর বিটকেল দাওয়াইয়ে থইথই করোনা-বাজার

এই সব ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আগেও হইচই হয়েছে, সুতরাং এখনও যে হবে, তা চোখ বুজেই বলা যায়। কিন্তু গোল বাধছে অন্য এক জায়গায়।

ছবি: পিটিআই

ছবি: পিটিআই

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ১০:২৭
Share: Save:

যখনই পৃথিবীতে কোনও গুরুতর বিপর্যয় দেখা দেয়, তখনই একটা প্রবণতা প্রায় সর্বত্রই দেখা দেয়। তা হল এই যে, এক শ্রেণির মানুষ সমস্বরে চেঁচাতে থাকেন— এই বিপর্যয়ের কথা আগে থেকেই জানা ছিল। কেন সাবধান হওনি! পৃথিবীর দিকে কোনও উল্কা ছুটে এলে, কোথাও কোনও যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে উঠলে, বিরাট কোনও ঝঞ্ঝা বা সুনামি-সুলভ দুর্যোগ দেখা দিলে, বড় আকারের অর্থনৈতিক ধস নামলে এবং কোথাও মহামারী মাথা তুললে এই জনতা বার বার বলতে থাকে যে, এই সব বিষয়ে চেতাবনি ছিলই। কেবল তোমরা কান করোনি বাপু। সাধারণত চেতাবনির উৎস হিসেবে তাঁরা তিনটি মুল সূত্র তুলে ধরেন, একটি বাইবেল আর একটি ইটালীয় মিস্টিক নস্ত্রাদামুসের ভবিষ্যদ্বাণী এবং তৃতীয়টি বুলগেরিয়ার বাবা ভাঙ্গা নাম্নী জনৈকা ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’র সাবধানবাণী। অন্যান্য বিপর্যয়ের মতো করোনাভাইরাস সংক্রান্ত বিপর্যয়ের বাজারেও ওই তিনটি সূত্রকে রেফার করা হচ্ছে এবং বলা হচ্ছে, এমনটা যে ঘটবে তা আগে থেকেই জানা ছিল।

বাইবেলের ‘বুক অব রেভেলেশন’-এ ‘এন্ড অব ডেজ’ বা মহাপ্রলয় সংক্রান্ত বক্তব্যকে আবার তুলে এনে বলা হয়েছে করোনা-প্যানডেমিকের কথা। বেশ কিছু খ্রিস্টীয় ওয়েবসাইট জানাচ্ছে, এই ‘প্লেগ’ (এমনটাই লেখা হচ্ছে) যে মহামারী আকারে দেখা দেবে— এমন কথা ‘ব্রেকিং অব দ্য সিলস’-এ বলা হয়েছে। অনেকে আবার এ কথাও বলছেন যে, পৃথিবীর অন্তিম লগ্নে যে চার অশ্বারোহীর আবির্ভাবের কথা বাইবেল জানায়, করোনাভাইরাস সেই চার জনেরই অন্যতম।

বিশ্বের অন্তিমলগ্ন সংক্রান্ত বাইবেল-বর্ণনা আদতে এমনই এক জটিল আর প্রতীকী ভাষায় লিখিত যে, তা যে কোনও বিপর্যয়েই ‘ফিট’ করে দেওয়া যায়। সুনামির ক্ষেত্রে এমনটা হয়েছে, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময়েও হয়েছে। ফলে এটা একটা ‘খোলা খাতা’, তাতে যা খুশি আঁকা-লেখা যায়। করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। তবে, এখানে বেশির ভাগ বক্তব্যই এসেছে টুইটার বা সোশ্যাল মিডিয়া মারফত। যাঁরা বক্তব্য পেশ করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই স্বঘোষিত বাইবেল বিশারদ।

ছবি: পিটিআই

করোনাভাইরাসের কথা নাকি বলে গিয়েছিলেন ষোড়শ শতকের ইটালীয় মিস্টিক নস্ত্রাদামুস। ১৫৫৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সংক্রান্ত গ্রন্থে নস্ত্রাদামুস নাকি ‘স্পষ্ট’ বলে গিয়েছিলেন এই মহামারীর কথা। নস্ত্রাদামুসের ভবিষদ্বাণীর কোনওটিই সোজাসাপ্টা ভাষায় কথিত নয়। অতি গোলমেলে প্রতীকী কবিতায় সেগুলি রচিত। সেই রকমই একটা পদ্য তুলে এনে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছাড়া হচ্ছে এবং নস্ত্রাদামুসের উপরে প্রায় দেবত্ব আরোপিত হচ্ছে। এই পদ্যটি করোনাভাইরাস কেন, কলেরার ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষেত্রেও হতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার এটাই যে, ইটালির সন্নিকটে এক রক্তাক্ত দেশের কথা এই পদ্যে জ্বলজ্বল করছে। অথচ করোনাভাইরাসের সাম্প্রতিক দাপাদাপি শুরু হয়েছে চিন থেকে। এই প্রশ্ন তুললে নস্ত্রাদামুসের একবিংশ শতকের চেলাকুল ‘ও সামান্য বিষয়, হিসেবের উনিশ-বিশ’ বলে পিছলে যাবেন।

এর পরের ভবিষ্যদ্বাণী বুলগেরিয়ার বিখ্যাত ভবিষৎদ্রষ্টা বাবা ভাঙ্গার। অন্ধ এই মহিলা নাকি ১৯৭০-এর দশকেই সাবধান করেছিলেন করোনাভাইরাস সম্পর্কে। তিনি নাকি ২০০৪-এর সুনামি, বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট হওয়া, টুইন টাওয়ারের ধ্বংস ইত্যাদিও বলে গিয়েছিলেন। করোনা-মহামারী সম্পর্কে বাবা ভাঙ্গার প্রেডিকশন ছিল এই যে, আফ্রিকায় এই মহামারী প্রথম দেখা দেবে এবং তা ক্রমে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়বে। বাবা ভাঙ্গার সমর্থকরা জানাচ্ছেন, চিনের বদলে তিনি আফ্রিকার কথা বলেছিলেন, তার বদলে ঝামেলাটা চিন থেকে ছড়িয়েছে। এটুকু ত্রুটি ধর্তব্যের মধ্যেই পড়ে না। সত্যি বলতে, বাবা ভাঙ্গার ভবিষ্যদ্বাণীও অতি গোলমেলে সাংকেতিক ভাষায় কৃত। সেখান থেকে এমন নিশ্চিত অর্থ নির্ণয় অতি সন্দেহজনক ব্যাপার।

এই সব ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে আগেও হইচই হয়েছে, সুতরাং এখনও যে হবে, তা চোখ বুজেই বলা যায়। কিন্তু গোল বাধছে অন্য এক জায়গায়। ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে নাকি স্পষ্ট ভাবেই বলা ছিল করোনা-প্যানডেমিকের কথা। সিলভিয়া ব্রাউন রচিত সেই বইটির নাম ‘এন্ড অব ডেজ: প্রেডিকশনস অ্যান্ড প্রফেসিজ’। এই বইতে লেখিকা জানিয়েছিলেন, “২০২০ নাগাদ নিউমোনিয়ার মতো এক অসুখ বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে, যা ফুসফুস ও শ্বাসনালিকে আক্রমণ করবে। পরিচিত কোনও চিকিৎসায় এর নিরাময় সম্ভব হবে না।’’ নেটাগরিকরা অতি দ্রুত ছড়িয়ে দেন এই বইয়ের মলাটের ছবি এবং সংশ্লিষ্ট পাতার ছবি। এই বইয়ের ‘প্রফেসি’ নিয়ে অবশ্য কেউ বিশেষ উচ্চবাচ্য করেননি।

ছবি: পিটিআই

এই ভাবেই উঠে এসেছে মার্কিন লেখক ডিন কুন্টজ লিখিত ১৯৮১ সালের থ্রিলার ‘দি আইজ অব ডার্কনেস’-এর কথাও। এই বইতে কুন্টজ লিখেছিলেন ২০১৯-২০২০ নাগাদ ‘ঊহান-৪০০’ নামের এক ভাইরাস মহামারী নিয়ে আসবে। নাম শুনেই বোঝা যায়, এই ভাইরাস চিন থেকে আগত। লেখকের মতে, এই ভাইরাসের উৎপত্তি নাকি বায়োলজিক্যাল গবেষণাগারে। কিন্তু বাস্তবের কোভিড-১৯ আর কাহিনির ঊহান-৪০০-র সংক্রমণের চরিত্র মোটেই এক রকম নয়। গল্পের ভাইরাসের মস্তিষ্ককে আক্রমণ করার কথা আর বাস্তবের ভাইরাস করছে শ্বাসযন্ত্রকে।

এ ভাবেই উঠে আসছে প্রাচীন ইহুদি ভবিষ্যদ্বাণী বা আরও সব প্রফেসির কথা। সোশ্যাল মিডিয়ার শেয়ারে শেয়ারে তা সংক্রমিত হচ্ছে করোনার চাইতেও দ্রুত। প্যানিক ও পাল্টা প্যানিকের প্রতিযোগিতায় নরক গুলজার অবস্থা। পুরো ব্যাপারটা অনেকটা বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়ির কারও পেট খারাপ হওয়ার মতো। চিকিৎসায় উদ্যোগী হওয়ার আগেই পরিবারসুদ্ধ বসে যান ‘আগেই বলেছিলাম ওইটা খাসনি’ অথবা ‘বিয়েবাড়িতে বুঝেশুনে খাবি তো’-মার্কা মন্তব্য করতে। যার পেট খারাপ, সে তখন খাবি খাচ্ছে।

আরও পড়ুন: করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর স্ত্রী

এখানেই ব্যাপারটা শেষ হলে বাঁচা যেত। চেতাবনি মানোনি বলে হ্যাপা পোহাচ্ছ— এ অনেক নিরীহ ব্যাপার। কিন্তু পাবলিক সেখানে থামে না। আরও কয়েক কদম এগিয়ে নিদান চলতে থাকে দাওয়াই বাতলানোর। সেটা আরও ভয়ঙ্কর ব্যাপার। আমাদের দেশে এই মুহূর্তে যে হাওয়া চলছে, তাতে গোমূত্রকে সর্বরোগহর বলে বর্ণনা করছেন এক বিশেষ রাজনৈতিক ইডিয়োলজির মানুষ। অসমের বিজেপি বিধায়ক সুমন হরিপ্রিয়া জানিয়েছেন, গোমূত্র এবং গোবরেই করোনা-মহামারী দূর করা যাবে। তবে সেই সঙ্গে একটা ‘হবন’ না যজ্ঞেরও প্রয়োজন রয়েছে। এক বিশেষ সংগঠনের কর্তা বলেছেন টি-পার্টির মতো ‘গোমূত্র পার্টি’-র আয়োজন করে করোনার সংক্রমণ রোখা যেতে পারে।

হিন্দুত্ববাদীরা যদি গোমূত্রের প্রেসক্রিপশন দিয়ে থাকেন, তবে পিছিয়ে নেই অন্য মতাবলম্বীরাও। এক মদ প্রস্তুতকারক সংস্থা জানিয়েছে, তাদের তৈরি ভদকা দিয়ে হাত ধুলে নাকি করোনার সংক্রমণ ঠেকানো যাবে। এর চাইতে আরও দশ কদম এগিয়ে কারা যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় দাবি করেছে, অ্যালকোহল পান ও তদ্বারা দেহ প্রক্ষালনই করোনা-মুক্তির প্রধান পন্থা। গুজবে গুজবে ছয়লাপ নেট-ভুবন। এরই মধ্যে সেয়ানা ও মহা ফিচেল কারা যেন রটিয়েছে পাঁঠার মাংসে করোনা। সেটা লিখে আবার তলায় পোস্ট দিয়েছে, যত পারেন এটা ছড়িয়ে দিন, মাংস ২০০ টাকা কিলো হল বলে। অলরেডি চিকেনের দামে ধস। এ বার তরিতরকারি নিয়েও গুজব লাগতে কত ক্ষণ! কে যেন বাজারে রসিকতা ছেড়েছে, পেঁয়াজের অগ্নিমূল্যের সময়ে কেন যে করোনা এল না!

আরও পড়ুন: ‘আতঙ্কিত হবেন না’, করোনাভাইরাস থেকে সুস্থ হয়েই নিজের কাহিনি পোস্ট মার্কিন তরুণীর

যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কালে এই লক্ষণগুলো কমন মানব সমাজে। মধ্যযুগে ইউরোপে যখন প্লেগ দেখা দিয়েছিল, তখন তার প্রতিরোধ মানুষের জানা ছিল না। কী প্রকারের গুজব আর দৈব-টোটকা আর মহাপ্রলয়ের ভবিষ্যদ্বাণী বাজারে ঘোরাফেরা করেছিল, তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে সেই সংক্রান্ত ইতিহাসগ্রন্থের পাতায় পাতায়, বার্গম্যানের অবিস্মরণীয় সিনেমা ‘দ্য সেভেন্থ সিল’-এ। দৈব বিপর্যয়ের সম্ভাবনা দেখা দিলে মানুষ নিজের অসহায়ত্ব লুকনোর জন্যই কি তুলে ধরে প্রফেসির কথা? সেমেটিক ধর্মে লালিত সংস্কৃতিতে মহাপ্রলয় একটা অনিবার্য সত্য হিসেবে বার বার উপস্থাপিত। তাই যে কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়েই টেনে আনা হয় বাইবেলকে বা কয়ামৎ-এর ভবিষ্য-কথনকে। উঠে আসতে থাকে এমন সব কথা— পাপের ভারা পূর্ণ হয়েছে, এ বার দেখ কেমন লাগে। মজার ব্যাপার, এ সবের কথক যেন এর প্রকোপ থেকে বাইরে থাকবেন। মুসোলিনি বা হিটলারের মতো শাসক যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন অনেকেই বলেছিলেন, এই বার ব্যাটারা বুঝবে মজা। কিন্তু এই ‘ব্যাটাসকল’-এর মধ্যে তিনিও যে প্রপঞ্চমায়ার ডোরেই আবদ্ধ, তা ভুলে গিয়েছিলেন। করোনার থাবা পাশের বাড়িতে হানা দিলেও আমি বেঁচে যাব— এমন একটা মনোভাব কি এখনও ঘুরুৎ ঘুরুৎ করছে না?

এই প্রসঙ্গে মনে পড়তেই পারে পরশুরামের বিখ্যাত গল্প ‘গগন চটি’-র কথা। আকাশে এক চপ্পল-সদৃশ ধূমকেতুর আগমনে বিশ্ব জুড়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল ‘শেষের সেদিন’-এর ভয়। যে যার মতো ব্যাখ্যা করে যখন থই পেলেন না, তখন শুরু হল হবন আর যজ্ঞ, পাপকবুল আর পারস্পরিক ভালবাসার মহান বাণীর ঢল। এ এক গণ-হিস্টিরিয়া। বিপর্যয় চলে গেলে আবার যে-কে সে-ই। কে আর ইয়াদ রাখে নস্ত্রাদামুস বা বাবা ভেঙ্গাকে? অ্যাপোক্যালিপ্স আর মানুষ-নির্মিত মারণ যজ্ঞ নিয়ে প্রতি বছরই বেশ কিছু থ্রিলার প্রকাশিত হয়। তার মধ্যে কে তখন আর ‘প্রফেসি’ খুঁজতে যান। গান পয়েন্টের সামনে দাঁড়ালে যেমন নিজের কৃতকর্মের জন্য আফসোস হয়, তেমনি কী করলে বেঁচে যেতাম-টাও মাথায় আসে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় প্রায় তেমনটাই। আর এটাও সত্য যে যুগে যুগে মহামারী বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কালে রাষ্ট্রশক্তি বা ধর্মাশ্রয় যে যার নিজের মতো করে ফায়দা তুলতে চেয়েছে। এ কথা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর থেকে করোনাভাইরাস পর্যন্ত সত্য। এখন সোশ্যাল মিডিয়ার ফাঁপিয়ে তোলা হাওয়ায় নিজেকে সঁপে দেব কি না, তা মানুষের নিজস্ব ব্যাপার। সন্দেহ নেই, এই বিপদ এক সময়ে কাটবেই। তখন এই সব ভবিষ্যদ্বাণী আর টোটকা-নিদানের কথা মনে পড়ে লজ্জিত হতে হবে আমাদেরই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Corona Virus Prediction Superstition Nostradamus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE