বহু দিন যাবৎ প্রায় স্থগিত রহিয়াছে স্বাভাবিক লেখাপড়া, পরীক্ষা গ্রহণ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অপরাপর ক্রিয়াকলাপ। তন্মধ্যে কেবল সাড়ম্বরে আয়োজিত হইল জেইই ও নিট পরীক্ষা। জেইই-তে বসিতে পারিলেন না দুই লক্ষাধিক পরীক্ষার্থী, নিটে অনুপস্থিতির হার প্রায় ১৫ শতাংশ। উক্ত সঙ্কট অননুমেয় ছিল না। একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দল ও গণসংগঠন পরীক্ষা আয়োজনের বিরোধিতা করিয়াছিল, কেন্দ্রীয় সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতে আবেদন করিয়াছিল ছয়টি রাজ্য সরকার। শেষাবধি সরকার বা আদালত তাহা বিবেচনা করে নাই, পরীক্ষা হইতেই হইল। আদালতের রায় শিরোধার্য, কিন্তু প্রশ্ন হইল, এই সময়ে পরীক্ষা গ্রহণ ঠিক হইল কি? বর্তমানে দেশের সকল শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আংশিক ভাবে চলিতেছে। দেশে দৈনিক সংক্রমণের সংখ্যা যখন সর্বাধিক, তখন এত বড় পরীক্ষার আয়োজন বহু মানুষের অসুবিধা ঘটাইল। জীবনের ঝুঁকি লইয়া পথে নামিতে বাধ্য হইলেন পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা।
এই পরীক্ষার্থীরা গত ছয় মাস বহুলাংশে স্বাভাবিক জীবন হইতে বিচ্ছিন্ন। অনেকেই লেখাপড়ার কেন্দ্র ছাড়িয়া স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন, হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হইলে আবার আসিতেন। কিন্তু ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণের হার এবং গণপরিবহণের অপ্রতুলতার ভিতরেই পরীক্ষা আয়োজিত হওয়ায় তাঁহাদের উপর এক অনাবশ্যক চাপ সৃষ্টি হইল। বর্তমান ইন্টারনেট-নির্ভর শিক্ষায় যে ছাত্রছাত্রীরা ভৌগোলিক বা আর্থিক বা অন্য কোনও কারণে পিছাইয়া আছেন, এই মুহূর্তে পরীক্ষা কি তাঁহাদের জন্য অসম প্রতিযোগিতা নহে? সামগ্রিক চিত্র বলিবে, পরীক্ষা ন্যূনাধিক সুষ্ঠু ভাবে আয়োজিত হইয়াছে। কিন্তু পরিসংখ্যান শুধু একটি সমষ্টিগত চিত্র অঙ্কন করে— ব্যক্তির সমস্যা তাহাতে ধরা পড়ে না। যে ১৫% ছাত্রছাত্রী নিট দিতে পারিলেন না, তাঁহাদের জীবনপ্রবাহের পথপরিবর্তনের হিসাব রাখিবে কোন পরিসংখ্যান?
তামিলনাড়ুতে তিন নিট পরীক্ষার্থীর আত্মহনন বলিয়া দেয়, পরীক্ষার আয়োজন ছাত্রছাত্রীদের একাংশকে কী ভাবে বিপন্ন করিয়াছে। অভিযোগ, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পরীক্ষার চাপেই তাঁহারা আত্মহত্যা করিয়াছেন। যাঁহারা পরীক্ষায় বসিলেন, তাঁহাদেরও অভিজ্ঞতা সুখকর নহে। কেহ দশ হাজার টাকা খরচ করিয়া আট ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়াছেন, কেহ বা দুপুরে পরীক্ষা দিবার জন্য সারা রাত্রি যাত্রা করিয়াছেন, কেহ আবার এক দিন পূর্বেই পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাইয়া অপেক্ষার প্রহর গনিয়াছেন। বিহারের দারভাঙা হইতে কলিকাতায় আসিয়াছিলেন এক যুবক, সম্পূর্ণ একটি দিন সময় লাগিয়াছিল, মাত্র দশ মিনিট বিলম্ব হওয়ায় পরীক্ষাকেন্দ্রে ঢুকিবার অনুমতি পান নাই। বিস্মৃত হইবার পূর্বেই এই বিপদসমূহ বিবেচনা করা বিধেয়। কেননা, যাহা ঘটিল তাহা দুর্ভাগ্যজনক। পরীক্ষা এবং লেখাপড়ার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক করা জরুরি, কিন্তু জেইই-নিট পরীক্ষার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা অপেক্ষা গুরুত্ব পাইয়াছিল অনমনীয় রাজনৈতিক জেদ। আর পাঁচটি বিষয়ের ন্যায় এই পরীক্ষাও শেষ অবধি কেন্দ্র বনাম বিরোধী দল-শাসিত রাজ্যের দ্বৈরথে পরিণত হইয়াছিল। পরীক্ষা পিছাইয়া দেওয়ার প্রশ্নটি আর ছাত্রছাত্রীদের হিতাহিত বিবেচনার বিষয় থাকে নাই, কেন্দ্রের অহংয়ের প্রশ্ন হইয়া উঠিয়াছিল। অহংয়ের সেই যুদ্ধে কেন্দ্র জিতিল। হারিলেন পরীক্ষার্থীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy