কাব্যপ্রেমী বঙ্গজনে হয়তো-বা এখন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের শাশ্বতী স্মরণ করিয়া আপনমনে বলিতেছেন: ‘একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে, থামিল কালের চিরচঞ্চল গতি’। গ্রহব্যাপী সংক্রমণের তাড়নায় ও আতঙ্কে ক্রমশ নিশ্চল, নীরব এবং গৃহবন্দি হইতেছে পৃথিবীর মানুষ। অদূর ভবিষ্যতে, কিংবা অচিরেই সেই নীরব নিশ্চল বন্দিত্ব আরও বহু দেশ, বহু শহর এবং বহু মানুষের অস্তিত্বকে দখল করিবে না, কোভিড-১৯ নামক অতিমারি আক্ষরিক অর্থে সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিবে না, এমন কোনও নিশ্চয়তা কেহ দিতে পারিবে না, দেবতারা তো পারিবেনই না— ধর্মনির্বিশেষে তাঁহাদের বড় ছোট মাঝারি আলয়গুলি বেমালুম ঝাঁপ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। ভালই করিয়াছে। এখন ঈশ্বর, ধর্মগুরু বা গোমাতার সময় নহে, এখন কাব্য চর্চারও সময় নহে, এখন যুদ্ধের সময়। তাহা মানুষের আত্মরক্ষার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধ মানুষকেই লড়িতে হইবে। লড়িতে হইবে বুদ্ধি, বিবেচনা এবং প্রত্যয়ের সঙ্গে। একযোগে।
নবাগত এবং (আপাতত) অ-নিবার্য ভাইরাসটির সহিত লড়াইয়ের জন্য রাষ্ট্র তথা বিভিন্ন ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব অপরিসীম। সেই দায়িত্ব পূরণে দুনিয়া জুড়িয়াই বিস্তর ঘাটতি রহিয়াছে, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধ্য এবং উদ্যোগের মধ্যে বিপুল দূরত্ব ডোনাল্ড ট্রাম্পের মাপকাঠিতেও বিস্ময়কর। কিন্তু তাহার পাশাপাশি ব্যক্তি-নাগরিকের দায়ও অনেক। সমস্ত দেশে। এই দেশেও। সেই দায়ের মূল কথাটি অতি সংক্ষিপ্ত। এক, নিজের শরীরকে, বিশেষত হাত দুইটিকে যথাসম্ভব পরিষ্কৃত ও মুখমণ্ডল হইতে বিযুক্ত রাখা; এবং দুই, সামাজিক মেলামেশা যথাসাধ্য কমানো বা সামাজিক দূরত্ব যথাসাধ্য বাড়ানো, যাহার পারিভাষিক নাম: সোশ্যাল ডিস্টান্সিং। এই দ্বিতীয় লক্ষ্যটি পূরণের জন্যই স্কুল-কলেজ হইতে শুরু করিয়া বহু প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখিবার এবং অফিস-কাছারি-সহ সমস্ত পরিসরে জনসমাগম যত দূর সম্ভব কমাইবার আয়োজন। ভারতের পক্ষে এই মুহূর্তে এই সামাজিক দূরত্ব লালন করিবার প্রয়োজন অস্বাভাবিক রকমের বেশি, কারণ আগামী দুই হইতে চার সপ্তাহ সংক্রমণের গতি রোধ করিয়া রাখিতে পারিলে বড় বিপদ এড়াইবার সম্ভাবনা অনেকটা বাড়িতে পারে। নিশ্চয়তা নহে, সম্ভাবনা। কিন্তু নিশ্চয়তা আপাতত অলীক স্বপ্ন, সম্ভাবনা যথাশক্তি বাড়াইবার চেষ্টাই একমাত্র করণীয়।
অনেকেই প্রশ্ন তুলিতেছেন: এত কড়াকড়ি কেন? ভারতের জনসংখ্যা এবং সংক্রমণের অনুপাত কষিয়া অনেকেই বলিতেছেন, এখনই এমন বাড়াবাড়ির প্রয়োজন ছিল না। প্রশ্ন, অঙ্ক এবং তর্ক— অতি উৎকৃষ্ট বস্তু। কিন্তু এখন এই সকল তর্কের সময় নহে। অন্তত কয়েক সপ্তাহ এই বিষয়ে তর্কের কোনও সময় নাই। বিপদ কাটিলে তর্ক করিবার, অনুপাত কষিবার বিস্তর অবকাশ মিলিবে। এখন প্রয়োজন শতকরা একশো ভাগ সতর্ক থাকা। যুদ্ধকালীন সতর্কতায় বাড়াবাড়ি বলিয়া কিছু হয় না। প্রশ্ন উঠিতে পারে: ইহার ফলে মানুষ অনর্থক আতঙ্কিত হইয়া পড়িবেন না তো? তাহার উত্তর: আতঙ্ক দূরে রাখিবার জন্যই চূড়ান্ত সতর্কতার প্রয়োজন। যাহাতে বাধ্য হইয়া জনজীবন অচল করিতে না হয়, সেই কারণেই জনসমাগম ও সামাজিক মেলামেশা যথাসম্ভব কমানো জরুরি। এখনও পর্যন্ত পরিস্থিতি মোটের উপর নিয়ন্ত্রণে রহিয়াছে। কেন্দ্রীয় এবং— রামনবমী উৎসব করিতে ব্যগ্র যোগীবরের উত্তরপ্রদেশ নামক উৎকট এবং বিপজ্জনক ব্যতিক্রম সাপেক্ষে— কিছু রাজ্যের সরকার এই বিষয়ে অনেক দূর অবধি তৎপর হইয়াছে। তাহা কেবল প্রশংসার দাবি রাখে না, ভরসা দেয়। রাষ্ট্র এবং সমাজ— সমাজের প্রতিটি সচেতন নাগরিক— কাণ্ডজ্ঞানের নির্দেশ মানিয়া চলিলে এই যুদ্ধে জয়ী না হইবার কোনও কারণ নাই। ইহা আতঙ্কের সময় নহে। ইহা অসতর্কতারও সময় নহে।