Advertisement
E-Paper

একটি মৃত্যুর ধারাবিবরণী

জামলোর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। গোটা জীবনে এটাই জামলো মকদমের একমাত্র পজিটিভ।

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২০ ০০:০১
জামলোর মতো আরও অজস্র ছেলেমেয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশে অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকারি আমলা, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ ব্যাপারে কোনও খবর নেই!

জামলোর মতো আরও অজস্র ছেলেমেয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশে অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকারি আমলা, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ ব্যাপারে কোনও খবর নেই!

ইন্দ্রাবতীর তীরে তাকে দেখেছিলাম। তার সঙ্গে আরও কয়েকটি ছেলেমেয়ে। তারই বন্ধু হবে গ্রামের। তার পরনের ইজের ছেঁড়া, খালি পা, রুখু চুল। চুলে আবার একটা লাল ফিতে বাঁধা। চোখে-মুখে দুষ্টুমি আলো হয়ে ফুটে উঠছে। কতই বা বয়স? দশ-এগারো হবে। সে মেয়ে খেলা করছে ইন্দ্রাবতীর জলে পা ডুবিয়ে। এই চেহারাটা চেনা। ওই ইন্দ্রাবতীর উৎপত্তি যেখানে, সেই ওডিশার কালাহান্ডি থেকে ছত্তীসগঢ়ের বস্তারের মাটি ছুঁয়ে তেলঙ্গানা পর্যন্ত এই চেহারাই চোখে পড়ে যত্রতত্র।

ভুমিপুত্র ও কন্যার দলটা খেলা করতে লাগল সে অরণ্যভূমিতে। আমি চললাম তাদের ছেড়ে। কিন্তু কী জানি কেন, সেই বালিকার মুখটা রয়ে গেল সঙ্গে, হয়তো বা বহু দূরে নাগরিক ঘেরাটোপের সুরক্ষায় থাকা আর কোনও কন্যের মুখ মনে পড়ে গিয়েছিল।

কয়েক দিন আগে ও রকমই আর এক মেয়ের ছবি দেখে চমকে উঠলাম। ওই মেয়ে নাকি সুদূর তেলঙ্গানার এক লঙ্কাখেতে কাজ করত। বয়স কত? ১২। বাড়ি ছত্তীসগঢ়ের বিজাপুর জেলায়। তার গ্রামেরই আরও কয়েক জনের সঙ্গে সে গিয়েছিল রোজগারের আশায়, দেড়শো কিলোমিটার দূরে তেলঙ্গানার কান্নাইগুড়াতে।

আরও পড়ুন: কে বলবে, খাদ্যের অধিকার নামে একটা আইন আছে এই দেশে

দেশে লকডাউন হল। সেই মেয়ে আটকে পড়ল লঙ্কাখেতে। তার মেয়েবেলা, তার আবাল্যের জঙ্গল-নদী-লাল মাটির দেশ ছেড়ে যে বালিকা গিয়েছিল কাজের খোঁজে তেলঙ্গানায়, সে আটকে পড়ল সেখানেই। প্রথন দফার লকডাউনের সময় সে ধৈর্য ধরেছে, আধপেটা খেয়েও অপেক্ষায় থেকেছে লকডাউন কবে উঠবে, তার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের মেয়াদ বাড়ার ঘোষণার পরে জামলো মকদম নামে সেই বালিকা আর তার গ্রামের সঙ্গীরা ঠিক করল, হেঁটেই তারা তেলঙ্গানা থেকে বিজাপুর ফিরবে।

সে রাস্তার দূরত্ব কতটা? দেড়শো কিলোমিটার।

তাতে কী? এ পরবাসে রবে কে? বাড়ির টান, বাবা-মাকে দেখার আকুতি তাকে, তাদেরকে টেনে নিয়ে চলে পথের বাঁকে। চেনা দুঃখ-চেনা সুখের গ্রাম, হাজার অভাবের সংসারও এই আকালের দিনে বড় প্রিয় হয়ে ওঠে। অতএব, দলের বাকিদের সঙ্গে পা মেলায় জামলো। কিন্তু এই দীর্ঘ পথ সে পাড়ি দেবে কী ভাবে? জাতীয় সড়ক ধরে গেলে চলবে না, সেখানে আইনের রক্ষকেরা আছে।

তাই জঙ্গলের পথই ভরসা। জঙ্গলের রহস্যে ঘেরা বাঁক, হিংস্র পশু বা সরীসৃপ, পর্যাপ্ত খাবার ও জল না-থাকা— কোনও কিছুই তাদের দমাতে পারেনি। ছোট্ট জামলো মকদম, তার ছোট্ট ছোট্ট পা নিয়ে এগোতে থাকে। তাকে যে বাড়ি ফিরতেই হবে! কয়েক ঘণ্টার পথ নয়, টানা তিন দিন নাগাড়ে হাঁটার পরে সে মেয়ে আর পারেনি। পড়ে গিয়েছে রাস্তায়, পেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে, আর ওঠেনি সে।

আরও পড়ুন: করোনা-উত্তর পৃথিবীকে সারিয়ে তোলা যাবে তো?

চিকিৎসকেরা তার একরত্তি দেহ পরীক্ষার পরে জানিয়েছেন, নির্জলা হয়ে গিয়েছিল তার শরীর। দেহের ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস মরেছিল মেয়েটা! না হলে এত সব পরীক্ষা হত? শুধু কি তাই, ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেল ঘোষণা করেছেন, জামলোর পরিবার এক লক্ষ টাকা পাবে। এক লক্ষ টাকা! এত টাকা জীবনে দেখেছেন জামলোর মা-বাবা! একমাত্র মেয়ে ছিল তো, সে জানত তার মা-বাবা জঙ্গলের কাঠ-পাতা কুড়িয়ে দিন চালায়, বস্তারের আরও অনেক মা-বাবার মতো। অভাবের সেই সংসারে ১২ বছরের মেয়ের রোজগারের সামান্য টাকাও যে কত মূল্যবান, তা সেই হা-হা করা দারিদ্র যে না দেখেছে, তার পক্ষে আন্দাজ করাটাও মুশকিল।

যথারীতি এ সব ক্ষেত্রে যা হয়, সেটাই হয়েছে। তদন্তের নির্দেশ এসেছে। কে বা কারা জামলোর মতো একরত্তিকে ভিন্‌ রাজ্যে কাজের জন্য নিয়ে গিয়েছিল, খোঁজ চলছে তাদেরও। শিশুশ্রম আইনে রুজু হয়েছে মামলা, আরও কত কী!

এমন সব পদক্ষেপ দেখতে বেশ লাগে। শুনতেও। জামলোই কি একমাত্র মেয়ে যে অভিবাসী শ্রমিক হয়ে গেল? তার মতো আরও অজস্র ছেলেমেয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, মধ্যপ্রদেশে অত্যন্ত কম মজুরিতে কাজ করছে, করতে বাধ্য হচ্ছে, সরকারি আমলা, রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে এ ব্যাপারে কোনও খবর নেই! সবাই সব কিছু নতুন করে জানছেন!

এরা তো অভিবাসী শ্রমিক। বাড়ি পৌঁছনোর মরিয়া প্রয়াসে কে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার হাঁটল, কে হাঁটতে গিয়ে ট্রেন বা বাসের ধাক্কায় চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেল, সে সব নিয়ে মাথা ঘামাতে গেলে আমাদের লকডাউনের বাজার করা ‘মিস’ হয়ে যাবে না!

জামলো মকদমের বাড়ি আমি জানি। জামলোদের বাড়ি একই রকমের হয়। সেখানে দুর্বল তক্তপোষের নীচে জামলোর খেলনার ভাঙা বাক্স থাকে। বাবা-মা জঙ্গলে গেলে জামলো সেই বাক্স বার করে ঘরের সামনের উঠোনে এসে বসে, ভাঙা বিবর্ণ হয়ে যাওয়া কাঠপুতলিটা বার করে সে আপন মনে কথা বলে। জামলো জানে, বস্তারের গ্রামের হাট থেকে তার বাবা-মা তার জন্য এই কাঠপুতলিটা এনেছিল। তার বাড়ির বিশাল তেঁতুলগাছটা তাকে ছায়া দেয়। বলে, তিন দিন হেঁটেছ, এ বার এসো, চিরবিশ্রামে যাও।

জামলোর করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। গোটা জীবনে এটাই জামলো মকদমের একমাত্র পজিটিভ।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

Coronavirus Lockdown Migrant Workers
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy