Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

এই অর্থনীতি যেন কাক্কেশ্বর কুচকুচের হিসেবনিকেশ

মাত্র ২০টি কর্পোরেট সংস্থার জন্য যে সরকার দরাজ হস্তে ছয় লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে, সেই একই সরকার পরিযায়ী শ্রমিক ও মজুরদের খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্ত দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলির উপরে একতরফা ভাবে চাপিয়ে দিয়ে তাদের যাবতীয় আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলেছে। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৮০ কোটি রেশনকার্ড হোল্ডারকে আগামী তিন মাস মাথাপিছু বরাদ্দের অতিরিক্ত পাঁচ কেজি চাল অথবা গম দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

দেবোত্তম চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২০ ০৫:৪৩
Share: Save:

গত ২৬ মার্চ কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন করোনা মোকাবিলায় এক লক্ষ ৭০ হাজার কোটির প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। সেই প্যাকেজে তিনি যে সব ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ব্যয়-বরাদ্দের ঘোষণা করেছেন, সেই ক্ষেত্রগুলিতে অতিরিক্ত খরচের হিসাবটা আগে পর্যালোচনা করা যাক।

প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ প্রকল্পের আওতাভুক্ত ৮০ কোটি রেশনকার্ড হোল্ডারকে আগামী তিন মাস মাথাপিছু বরাদ্দের অতিরিক্ত পাঁচ কেজি চাল অথবা গম দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। পরিবারপিছু দেওয়া হবে অতিরিক্ত এক কেজি ডালও। করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে রেশনে যে চাল দেওয়া হত, খোলাবাজারে তার দাম ছিল ৩০ টাকা। একই সময়ে বাজারে মুসুর ডালের দাম ছিল ১০০ টাকা। পরিবার পিছু ৪ জন লোক ধরে নিলে এ বাবদ আগামী তিন মাসে সরকারের অতিরিক্ত খরচ হতে পারে (৮০ কোটিx ৫ কেজিx ৩ মাসx ৩০ + ২০ কোটিx ১ কেজিx ৩ মাসx ১০০) টাকা বা ৪২ হাজার কোটি টাকা। পণ্য পরিবহণের খরচ বাবদ আরও তিন হাজার কোটি টাকা ধরলেও কোনও ভাবেই এ বাবদ ব্যয় ৪৫ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।

২০.৫ কোটি মহিলার জনধন অ্যাকাউন্টে আগামী তিন মাসের জন্য ৫০০ টাকা করে দেওয়া হবে বলা হয়েছে। এ বাবদ খরচ হবে (২০.৫ কোটিx ৩ মাসx ৫০০ টাকা) ৩১ হাজার কোটি টাকা।

প্যাকেজে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী উজ্জ্বলা যোজনায় নথিভুক্ত আট কোটি পরিবারকে আগামী তিন মাসের জন্য বিনামূল্যে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার দেওয়া হবে। এই পরিবারগুলিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়া হয় পাঁচ কেজি ও ১৪.২ কেজি সিলিন্ডারে। আগামী তিন মাসে পরিবারগুলিতে সর্বোচ্চ দু’টি গ্যাস সিলিন্ডার লাগতে পারে ধরে নিলে এ বাবদ সর্বোচ্চ খরচ হতে পারে (৮ কোটিx ২টি সিলিন্ডারx ৫০০ টাকা) ৮ হাজার কোটি টাকা।

যে সমস্ত সংস্থার কর্মীসংখ্যা একশো জনের কম এবং সংস্থার ৯০ শতাংশ কর্মীর বেতন ১৫ হাজারের কম, তাঁদের হয়ে কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডে ২৪ শতাংশ টাকাই জমা দেবে কেন্দ্র। সে ক্ষেত্রে ৪.৮ কোটি কর্মচারীর জন্য সর্বোচ্চ খরচ হতে পারে ৫ হাজার কোটি টাকা।

দেশের ৩ কোটি ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তি, বিধবা এবং প্রতিবন্ধীদের অতিরিক্ত এককালীন ১০০০ টাকা তাঁদের জনধন অ্যাকাউন্টে পাঠানোর ক্ষেত্রে খরচ হবে তিন হাজার কোটি টাকা।

জরুরি পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য আগামী তিন মাস মাথাপিছু ৫০ লক্ষ টাকার বিমা ঘোষিত হয়েছে। আক্রান্ত হলে তবেই এই বিমা প্রযোজ্য হবে, অন্যথায় নয়। যদিও প্রিমিয়ামের সময়সীমা কিংবা খরচের উল্লেখ অর্থমন্ত্রী করেননি। তবুও ২২ লক্ষ সরকারি স্বাস্থ্যকর্মীর বিমা ও চিকিৎসার প্রিমিয়াম বাবদ সরকারের সর্বোচ্চ খরচ হতে পারে এক হাজার কোটি টাকা। কিন্তু উপরোক্ত ক্ষেত্রগুলিতে ৯৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলেও সরকার প্যাকেজে যে আরও অতিরিক্ত ৭৭ হাজার কোটি টাকা ব্যয়-বরাদ্দের ঘোষণা করেছে, তার কোনও হিসাবই মিলছে না।

প্যাকেজে ঘোষিত হয়েছে, ১০০ দিনের কাজের আওতায় শ্রমিকদের পারিশ্রমিক ১৮২ টাকা থেকে বাড়িয়ে আগামী এক এপ্রিল থেকে ২০২ টাকা করা হবে। অর্থমন্ত্রীর বয়ান অনুযায়ী এতে উপকৃত হবে পাঁচ কোটি পরিবার। অথচ এই টাকাটা বাজেটেই বরাদ্দ থাকার কারণে এ বাবদ সরকারের অতিরিক্ত কোনও খরচই নেই।

প্রধানমন্ত্রী কিসান সম্মান নিধি যোজনার অন্তর্ভুক্ত ৮.৭ কোটি কৃষক বছরে ছয় হাজার টাকা করে পান। বর্তমান পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই তা থেকে কৃষকদের অ্যাকাউন্টে দুই হাজার টাকা করে জমা পড়ার কথা বলা হয়েছে। আসলে তাঁরা বছরে যে ছয় হাজার টাকা পেতেন সেটাই পাবেন। কেবল তার মধ্যে দুই হাজার টাকা অগ্রিম দেওয়া হবে। কাজেই, এ বাবদেও সরকারের অতিরিক্ত খরচ নেই।

জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনে নথিভুক্ত ৬৩ লক্ষ মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে বন্ধকহীন ঋণের পরিমাণ ১০ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ লক্ষ টাকা করা হয়েছে। যেহেতু এই টাকা অনুদানের বদলে ঋণ হিসাবে দেওয়া হবে, তাই এ জন্যও সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় হবে না।

নির্মাণকর্মীদের জন্য কল্যাণ তহবিল থেকে ৩১ হাজার কোটি টাকা খরচের ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু নির্মাণ সংস্থার থেকে সেস বাবদ আদায় করা সেই টাকা তহবিলেই সঞ্চিত আছে। ফলে তার জন্যও কেন্দ্রের বাড়তি খরচ নেই।

জরুরি পরিস্থিতিতে কেউ চাইলে নিজের কর্মচারী প্রভিডেন্ট ফান্ডের ৭৫ শতাংশ অথবা তিন মাসের বেতন (যে অঙ্ক কম হবে), তা আগাম তুলতে পারবেন বলে ঘোষিত হয়েছে। যেহেতু এই টাকা কর্মচারীর নিজের টাকা, তাই এখানেও সরকারের নিজস্ব দেয় কিছুই নেই। বরং সে বাবদ সুদ না দেওয়ার কারণে সরকারের বেশ কিছু টাকা সাশ্রয় হওয়ারই কথা।

মাত্র ২০টি কর্পোরেট সংস্থার জন্য যে সরকার দরাজ হস্তে ছয় লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব করে, সেই একই সরকার পরিযায়ী শ্রমিক ও মজুরদের খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্ত দায়িত্ব রাজ্য সরকারগুলির উপরে একতরফা ভাবে চাপিয়ে দিয়ে তাদের যাবতীয় আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলেছে।

আসলে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী যতই কাক্কেশ্বর কুচকুচের মতো ‘ইয়াদি কির্দ অত্র কাকালতনামা লিখিতং শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে কার্যঞ্চাগে ইমারৎ খেসারৎ দলিল দস্তাবেজ’ বলে প্যাকেজ ঘোষণা করুন না কেন, বস্তুতপক্ষে এই কঠিন পরিস্থিতিতে এক বিরাট সংখ্যক ভারতবাসীর কাছে ‘হাতে রইল পেনসিল’-এর বেশি কিছু আর নেই!

এই প্যাকেজ ঘোষণার এক মাস পরে অবস্থাটা তা হলে ঠিক কী দাঁড়াল? পাঠক, নিজেই বুঝে নিন!

আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE