Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Coronavirus

তাঁহাদের কথা

এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের এতখানি দুর্গতির কি কোনও প্রয়োজন ছিল? অংশত অনিবার্য ভাবে, কিন্তু অনেকাংশেই যথেষ্ট সময় থাকিতে সতর্ক না হইবার পরিণামে, গোটা দেশকে ঘরবন্দি থাকিবার নির্দেশিকাটি জারি না করিয়া সরকারের উপায় ছিল না।

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০ ০১:২৪
Share: Save:

আতঙ্কিত অসহায় ছিন্নমূল শরণার্থীর স্রোত এই দেশ— এই দুনিয়ার বহু দেশের মতোই— বিস্তর দেখিয়াছে। মন্বন্তর হইতে দেশভাগ, অনাবৃষ্টি হইতে মহাপ্লাবন, নানা কারণে ঘরছাড়া মানুষ অন্ন ও আশ্রয়ের সন্ধানে পাড়ি দিয়াছেন গ্রাম হইতে শহরে, দেশ হইতে দেশান্তরে। কিন্তু গত কয়েক দিন ধরিয়া ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের রাজপথে যে অগণন মানুষের মিছিল, তাঁহারা ঘর ছাড়িয়া যাইতেছেন না, ঘরে ফিরিবার চেষ্টা করিতেছেন। তাঁহারা অন্য রাজ্যে কাজ করিতে গিয়াছিলেন, নোভেল করোনাভাইরাসের বিপদ তাঁহাদের কাজ কাড়িয়া লইয়াছে, কাড়িয়া লইয়াছে গ্রাসাচ্ছাদনের উপায়, অগত্যা স্বভূমিতে ফিরিবার পর্ব শুরু হইয়াছিল পক্ষকাল পূর্বেই। কিন্তু গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী গোটা দেশে তিন সপ্তাহের ‘লকডাউন’ বা ঘরবন্দি ঘোষণা করিবার পরে সেই স্রোত এক লহমায় হড়পা বানে রূপান্তরিত হইয়াছে, হাজার হাজার কর্মী পুরুষ, নারী, শিশু যে ভাবে সম্ভব (এবং যে ভাবে সম্ভব নহে) শত শত মাইল পাড়ি দিয়া ঘরে ফিরিবার চেষ্টা করিতেছেন। মধ্যপথে বেশ কিছু মানুষের প্রাণ গিয়াছে, ক্ষুধার্ত পথশ্রমে, অনিবার্য ব্যাধিতে অথবা অবধারিত দুর্ঘটনায়। প্রবাসী শ্রমিকের ঘরে ফিরিবার এমন মর্মন্তুদ দৃশ্য এই দুর্ভাগা দেশেও সুলভ নহে।

এমন বিপুলসংখ্যক মানুষের এতখানি দুর্গতির কি কোনও প্রয়োজন ছিল? অংশত অনিবার্য ভাবে, কিন্তু অনেকাংশেই যথেষ্ট সময় থাকিতে সতর্ক না হইবার পরিণামে, গোটা দেশকে ঘরবন্দি থাকিবার নির্দেশিকাটি জারি না করিয়া সরকারের উপায় ছিল না। কিন্তু অতর্কিতে এমন দীর্ঘমেয়াদি সার্বিক নিষেধাজ্ঞা ঘোষণার ফলে অভিবাসী শ্রমিকদের কোন অবস্থায় পড়িতে হইবে, তাহা লইয়া স্পষ্টতই সরকারি কর্তারা আগে ভাবেন নাই। ভাবেন নাই বলিয়াই তাঁহাদের পাশে দাঁড়াইবার, এই দুর্দিনে তাঁহাদের প্রয়োজনীয় সাহায্য করিবার কোনও সুচিন্তিত পরিকল্পনাও করেন নাই। পরিস্থিতির চাপে পড়িয়া বিচ্ছিন্ন ভাবে লঙ্গরখানা খোলা হইয়াছে, পরিস্থিতির চাপে পড়িয়া সহসা ঘরে ফিরিবার জন্য বাস বরাদ্দের ঘোষণা হইয়াছে। কিছু মানুষ আহার পাইয়াছেন, কিছু মানুষ বাসে চড়িয়া ঘরে ফিরিয়াছেন। কিন্তু তাহার ফলে জনস্রোত জনারণ্যে পরিণত হইয়াছে, যে সংক্রমণ নিবারণের জন্য এত উদ্যোগ, সেই সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়িয়া গিয়াছে। আবার, এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়া অবস্থা সামাল দিতে এক রাজ্য হইতে অন্য রাজ্যে যাতায়াত বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে। সরকারি নীতিকার এবং প্রশাসকদের বুদ্ধি ও বিবেচনার অভাব যে কোন অতলে পৌঁছাইতে পারে, এই সূত্রে তাহার এক অভূতপূর্ব নজির তৈয়ারি হইয়াছে। অত্যন্ত লজ্জাকর এবং উদ্বেগজনক নজির।

অভাব নিছক বুদ্ধি ও বিবেচনার নহে। অভাব স্বাভাবিক সহৃদয়তারও। সরকারি কর্তা ও প্রশাসকরা মানবদরদি হইবেন, এমন উচ্চাশা দেশের নাগরিকদের নাই। কিন্তু তাঁহাদের স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তি সচল থাকিলে তাঁহারা বুঝিতে পারিতেন, এই বিপদ এবং তাহার মোকাবিলায় দেশের মানুষকে চার ঘণ্টার নোটিসে ঘরবন্দি করিবার এই নীতি, দুইই দরিদ্র, বিশেষত অভিবাসী শ্রমজীবীদের জীবনে বিপুল সঙ্কট লইয়া আসিবে। কেরল বা পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য প্রশাসনের চালকরা এই সত্য বুঝিয়াছেন বলিয়াই সাধারণ মানুষের সহায় হইতে, আক্ষরিক অর্থেই, ঝাঁপাইয়া পড়িয়াছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের সর্বাধিনায়ক হইতে শুরু করিয়া বিভিন্ন কর্তা ও কর্ত্রীর গদাইলস্করি চাল এবং আলঙ্কারিক বক্তৃতার পাশাপাশি বুদ্ধি, বিবেচনা এবং সহৃদয় তৎপরতার অভাব— এখনও— প্রকট। অপটু এবং হৃদয়হীন নেতৃত্ব মানুষের যন্ত্রণা বাড়ায়, বিপদও। অভিবাসী শ্রমজীবী নাগরিকদের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতায় ইতিহাসের এক ভয়াবহ অধ্যায় রচিত হইতেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE