Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
না হয় কিছু ট্রেন চলুক
Coronavirus

অভিবাসী শ্রমিকরা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমাপ্রার্থনা শুনতে পেলেন কি

এক দেশ থেকে বিদেশে এ ভাবে মানুষের চোরাচালান ঘটে জানতাম। কিন্তু স্বদেশের সীমানার মধ্যে ভারতবাসীদের এই দুর্দশা? এই চূড়ান্ত অপমান যদি না ভাবায়, আমাদের টগবগে জাতীয়তাবাদের কী মূল্য?আটকে-পড়া মানুষগুলোর রোখ আর ক্ষোভ বেশি দিন সামলে রাখা অসম্ভব— না স্তোকবাক্যে, না লাঠি উঁচিয়ে, না এমনকি সুষ্ঠু ত্রাণব্যবস্থা দিয়ে।

সুকান্ত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২০ ০১:০৬
Share: Save:

দেশ জুড়ে যে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী শ্রমিক উৎকণ্ঠায় দিন গুনছেন, বা পথে বেরিয়ে পড়েছেন বোঁচকা ঘাড়ে সন্তান কাঁখে, তাঁরা কি ‘মন কি বাত’ শোনেন? আশঙ্কা হয়, সেই ফুরসতটুকু তাঁদের জোটে না। নইলে চমৎকৃত হয়ে জানতেন, তাঁদের যন্ত্রণার জন্য প্রধানমন্ত্রী ক্ষমাপ্রার্থী! তবে তাঁরা না জানলেও ক্ষতি নেই, কারণ আসল শ্রোতাদের কানে বার্তা পৌঁছচ্ছে ঠিকই, রামভক্ত রাজভক্তেরা বিমোহিত হচ্ছেন। একই প্রচারের সুর নতুন ত্রাণ তহবিলের নামকরণে। তহবিল একটা চিরকালই আছে, আবার কেন? একটা লাভ অবশ্যই যে নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর থেকে শিক্ষিত শহুরে ভক্তবৃন্দ বুঝবেন ‘পিএম কেয়ারস’, প্রধানমন্ত্রী প্রজাদরদি।

একটা মস্ত সাধুবাদ সত্যিই তাঁর প্রাপ্য, সার্বিক লকডাউন ঘোষণার জন্য। যে যা-ই বলুক, এখনও যে আশা আছে ভারতে সংক্রমণটা ধরাছোঁয়ার মধ্যে থাকবে, লকডাউন ছাড়া তা অসম্ভব হত, হয়তো ইতিমধ্যেই নেমে আসত চরম বিপর্যয়। চিন্তার বিষয়, ঘোষণাটা ছিল কত অতর্কিত অপরিকল্পিত, ভারতবাসীদের সে জন্য কত অনাবশ্যক খেসারত দিতে হচ্ছে, তা প্রত্যক্ষ হচ্ছে। ব্যক্তিগত কোনও সমস্যা না থাকলে আমরা শহুরে বেতনভুক ঘরকুনো শ্রেণি নেহাত মন্দ নেই, নাভিশ্বাস উঠছে বাকিদের।

তা ‘ওদের’ দুর্দশায় আমাদের কী? সত্যি, এ নিয়ে বেশি ভাবলে খেয়ে-পরে বাঁচা মুশকিল। এই দুর্দশাটার কিন্তু একটা বিশেষ মাত্রা আছে, যা অন্য নানা দুর্দশা-বঞ্চনার স্বরূপটা প্রকট করে তুলেছে। বর্তমান বিপদটা হাতেনাতে ঘটিয়েছি আমরা সচ্ছল শিক্ষিত বিদেশগামীর দল। তাতে আমাদের সমবেত অনুশোচনার কারণ নেই, সেটা বাড়াবাড়ি হত। কিন্তু দেশের বঞ্চিত গোষ্ঠীরা ক্রমে সরব হচ্ছে, এক দিন হয়তো অভিযোগটা শ্রেণিগত বয়ানে উচ্চারিত হয়ে আমাদের দরজায় ঘা মারবে: সে দিন বড় সুখকর হবে না। অতএব যে উদ্বেগ ও সহমর্মিতা আমরা মানবিক কারণেই বোধ করছি, তাকে সক্রিয় রূপ দিলে আমাদেরও মঙ্গল।

একটা কথা বোধ হয় মানতে হবে। আটকে-পড়া মানুষগুলোর রোখ আর ক্ষোভ বেশি দিন সামলে রাখা অসম্ভব— না স্তোকবাক্যে, না লাঠি উঁচিয়ে, না এমনকি সুষ্ঠু ত্রাণব্যবস্থা দিয়ে। এটা যুক্তির ব্যাপার নয়, মৌলিক আবেগ ও মনুষ্যত্বের ব্যাপার। স্বভূমিতে না ফিরলে লোকগুলি শান্তি পাবে না। শাসকগোষ্ঠী বিষয়টা নিয়ে এক সপ্তাহ আগে অবগত ছিল কি না বোঝা দুষ্কর। সরেজমিনে অবস্থা সামলাবার দায় এখনও রাজ্য সরকারগুলির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ-সহ অনেক রাজ্য সত্যিই সদর্থক ভূমিকা নিয়েছে, কিন্তু ভিন রাজ্যের এই নিবাসীদের উপর তাদের প্রভাব স্বভাবতই সীমিত।

আরও ক’টা কেজো কথা ভাবতে হয়। গরিবদের সাহায্যে কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে। সে আলোচনা অর্থনীতিবিদরা করবেন; সাধারণ লোকে যেটুকু বুঝি, কিছু আপত্তি-অভিযোগ যদি ভিত্তিহীন হয় তবু তার নিরসন দরকার। আর মোদ্দা কথা, যেটুকু পাওয়ার সেটুকুও সচরাচর গ্রামে না ফিরলে মিলবে না। রোজগারের টানে যেখানেই আস্তানা পাতুন, গ্রামেই এই মানুষদের রেশন কার্ড, মফস্‌সলের ব্যাঙ্কে জনধনের খাতা— পরিবারের মহিলার নামে হলে তো কথাই নেই। উপরন্তু রাজ্য সরকার যে সাহায্য দিচ্ছে (প্রায়ই আরও বেশি পরিমাণে), সেটা রাজ্যের বাইরে মিলবে না। নারেগার কর্মকাণ্ড আপাতত বন্ধ, তবু ভবিষ্যতে যেটুকু আশা তাও গ্রামে থাকলেই। উপরন্তু একের পর এক রাজ্যে এখন ফসল তৈরি। এমনিতেই এ সময়ে অভিবাসীরা দেশে ফেরেন, ফসল কেটে দু’টো পয়সা জোটে। ফসল কী ভাবে ঘরে তোলা হবে, তা ভেবে এ বছর একাধিক রাজ্য সরকার জেরবার।

সবচেয়ে মোক্ষম চিন্তা: যে সংক্রমণ রোধের জন্য গরিবদের একতরফা ত্যাগ স্বীকার, তা নিয়েই ভয় ধরেছে। হাজার হাজার মানুষ যদি অবাধে রাস্তায় নামে, বাসস্ট্যান্ডে গায়ে-গায়ে দিনরাত কাটায়, এক-দেড়শো জন (বা আরও বেশি) একটা বাসে ঠাসাঠাসি করে ওঠে, লকডাউনের রইল কী? রাজ্য সরকারগুলি যে ভিন রাজ্য থেকে কাউকে ঢুকতে দিতে নারাজ, তা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত, কিন্তু বলবৎ হচ্ছে কই? বরং গড়ে উঠছে আন্তঃরাজ্য পাচারচক্র, যার মর্মান্তিক প্রমাণ মানুষ বোঝাই পণ্যবাহী কন্টেনার। এমন ঘটতে থাকলে আসন্ন গরমে প্রাণহানি অনিবার্য। এক দেশ থেকে বিদেশে এ ভাবে মানুষের চোরাচালান ঘটে জানতাম, ঘটে মৃত্যুও। কিন্তু স্বদেশের সীমানার মধ্যে ভারতবাসীদের এই দুর্দশা? ঝুঁকির কথা ছেড়ে দিলাম, নাগরিক মর্যাদার এই চূড়ান্ত অপমান যদি না ভাবায়, আমাদের টগবগে জাতীয়তাবাদের কী মূল্য?

অতএব একটা বিনীত প্রস্তাব, দেশবাসী ভেবে দেখবেন: সম্পূর্ণ লকডাউনের বদলে (যা পুরোপুরি কার্যকর হচ্ছে না) সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত ভাবে কিছু চলাচলের অনুমতি দিলে শুধু আর্থিক ও সামাজিক বিপর্যয় বাঁচবে না, করোনা প্রতিরোধও হয়তো আরও সুষ্ঠু ভাবে করা যাবে। এই কাজে লাগানো যেতে পারে থমকে-যাওয়া ভারতীয় রেলব্যবস্থা। স্মর্তব্য যে লকডাউনের ঠিক আগে, জনতার চাপে মহারাষ্ট্র সরকার বিহার পর্যন্ত পাঁচটি বিশেষ ট্রেন চালিয়েছিল। এ বার তেলঙ্গানা সরকার প্রস্তাব করেছে, ফসল কাটার জন্য অপরিহার্য শ্রমিকদের বিহার থেকে বিশেষ ট্রেনে নিয়ে আসার।

রেল পরিবহণের অনেক সুবিধা। রেলের উপর সরকারের একক নিয়ন্ত্রণ, আর কেউ হাত গলাতে পারে না। ন্যূনতম পাহারা থাকলে একটি ট্রেনকে পুরোপুরি সুরক্ষিত, কার্যত ‘সিল’ করে রাখা যায়, যাত্রাপথের সঙ্গে কোনও সংক্রমণের লেনদেন না ঘটিয়ে। নিয়ন্ত্রিত ভাবে, অল্পমূল্যে এক সঙ্গে প্রচুর লোককে এক জায়গায় এনে, যাত্রার উভয় প্রান্তে উপযুক্ত স্বাস্থ্যপরীক্ষা করা যায় (সম্প্রতি যে বাসগুলি দিল্লি থেকে উত্তরপ্রদেশ গিয়েছে, সেগুলি গন্তব্যে পৌঁছলে এমন ব্যবস্থাই করা হয়েছিল)। বড় বড় স্টেশনগুলি ফাঁকা পড়ে আছে, সেখানে বা কাছাকাছি রেলের ভবনে কোয়রান্টিন পর্যন্ত করা যায়।

সামাজিক দূরত্বের কী হবে? দিল্লির বাসস্ট্যান্ডে বা তিরুঅনন্তপুরমের রাস্তায় যে দৃশ্য দেখা গেছে, দেশের সর্বত্র বাজারহাটে যা অল্পাধিক ঘটছে, তার পর এই আলোচনা অবান্তর, তবু করতে হয়। ভারতীয় রেলের সবচেয়ে লম্বা ট্রেনে থাকে চব্বিশটি কামরা, যার এক-একটিতে কেবল আসনে বসে (মেঝেতে, বাঙ্কে বা ঝুলে নয়) যেতে পারে প্রায় একশো যাত্রী। অর্থাৎ একটি ট্রেনে অন্তত ২,০০০ যাত্রী মোটামুটি ফাঁকার মধ্যে যেতে পারে, তবে অবশ্যই করোনা-বিধি মেনে নয়। মুম্বই থেকে বিহারগামী বিশেষ ট্রেনগুলিতে গড়ে ২,০০০ যাত্রীই ছিল, সম্ভবত অনেক কম সংখ্যক কামরায়।

পুরোপুরি বিধি মানলে চব্বিশ কামরার ট্রেনে সংখ্যাটা হবে বারোশো বা তেরোশো। সেটাই কি অসম্ভব? ভারতীয় রেলের বিপুল ‘রোলিং স্টক’ কাজে লাগানোর অপেক্ষায়। সরকারের চিরাচরিত মানসিকতা পাল্টে ‘যথাসম্ভব কম’ নয়, ‘যথাসম্ভব বেশি’ নীতি গ্রহণ করতে বাধা কী?

লকডাউনের সব বিধি মানলে, আন্তঃরাজ্য সীমানা সিল করে দিলে অবশ্যই আদর্শ অবস্থা হত। কিন্তু নাছোড়বান্দা অভিবাসীদের কথা ছেড়ে দিলেও, ব্যব্যহারিক ও আর্থিক কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না। সড়ক পরিবহণ খুলে দিতে হয়েছে অত্যাবশ্যকসহ সব রকম পণ্যের জন্য। মানবসম্পদের সদ্ব্যবহারের জন্যও তেমন কিছু ভাবা দরকার, তবে অবশ্যই মারণরোগে সম্পদ ছারখার করে নয়।

ইমেরিটাস অধ্যাপক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Coronavirus Health Coronavirus Lockdown
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE