Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
ব্রিগেড সমাবেশ ডাকার ‘হিম্মত’ দেখাল সিপিএম

নও গো ঋণী কারও কাছে...

ব্রিগেড নিয়ে সিপিএমের অভিজ্ঞতা অন্য যে কোনও দলের চেয়ে বেশি। সাড়ে তিন দশক টানা ক্ষমতায় থাকার সময়ে এটা তাদের প্রায় বাৎসরিক কর্মসূচি ছিল। সব আমলেই সরকারি দল হওয়ার বাড়তি কিছু সুবিধা থাকে। বলা চলে, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’!

অতীত: বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী, সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসু। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৩

অতীত: বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী, সিপিআইএম নেতা জ্যোতি বসু। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড, কলকাতা, জানুয়ারি ২০০৩

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

এবার সিপিএমের ব্রিগেড। সভার আনুষ্ঠানিক উদ্যোক্তা বামফ্রন্ট হলেও সিপিএম-ই এই সমাবেশের কর্ণধার। এই রকম সমাবেশ, সবাই জানেন, যে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে এক তাৎপর্যপূর্ণ কর্মসূচি। অর্থবল, লোকবলের কথা তো আছেই। তা ছাড়াও ব্রিগেডে সভা করাকে প্রচার ও প্রভাবের দিক থেকে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের দক্ষতার পূর্ণ প্রকাশ বলে মনে করে। তাই আকস্মিক কোনও কারণ না ঘটলে ব্রিগেড করার আগে তারা নানা দিক খতিয়ে দেখে। প্রস্তুতিও শুরু হয় হাতে সময় নিয়ে। এই ব্রিগেডের তোড়জোড় সিপিএম অনেক দিন ধরে করছে।

ব্রিগেড নিয়ে সিপিএমের অভিজ্ঞতা অন্য যে কোনও দলের চেয়ে বেশি। সাড়ে তিন দশক টানা ক্ষমতায় থাকার সময়ে এটা তাদের প্রায় বাৎসরিক কর্মসূচি ছিল। সব আমলেই সরকারি দল হওয়ার বাড়তি কিছু সুবিধা থাকে। বলা চলে, ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’! ক্ষমতাময় সিপিএমের ব্রিগেডেও তার প্রকাশ ঘটত। ভিড় এবং জৌলুসের নিরিখে একটা সমাবেশ যেন অন্যটাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিত।

সেই সিপিএমও নেই, সেই রাজত্বও নেই। আর, হাতের কাছেই তুলনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক ব্রিগেড। ফলে মুখে না বললেও ভিতরে ভিতরে আলিমুদ্দিনের উপর এখন একটা বাড়তি চাপ থাকবেই। আসলে এ ধরনের বিশাল জমায়েতে ভিড় করা এবং ভিড় ধরে রাখা, দুটোই বেশ চাপের ব্যাপার। রীতিমতো সংগঠিত ভাবে দু’এক দিন আগেই লোককে দূরদূরান্ত থেকে নিয়ে আসতে হয়। থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। আবার সভা শেষে তাঁদের বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত রাখতে হয়।

একই রকম গুরুত্বপূর্ণ হল, ভিড় ধরে রাখা। যার জন্য প্রয়োজন জন-আকর্ষণী ক্ষমতাসম্পন্ন বক্তার, যাঁকে দেখার জন্য, যাঁর কথা শোনার জন্য ময়দান অপেক্ষা করবে। তাঁরা মূলত ‘ভোট-ক্যাচার’ বলে গণ্য হন। অর্থাৎ জনসমর্থন টেনে আনার ক্ষেত্রে তাঁদের সামনে রাখে দল। সব দলেই এমন নেতার সংখ্যা হাতে গোনা। তৃণমূলে যেমন এক এবং অদ্বিতীয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমে কয়েক দশক ব্যাপী জ্যোতি বসু এবং তাঁর পরে কিছুটা সময় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। চল্লিশের দশকে বিলেতফেরত কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতিবাবু চলনবলন, ব্যক্তিত্ব, সব কিছু মিলিয়ে জনমনে এমন ছাপ ফেলেছিলেন, যা পরবর্তী প্রায় সত্তর বছর সিপিএমকে ‘অহং’ নিয়ে বাঁচার রসদ জুগিয়েছে। প্রবীণদের মুখে শুনেছি যখন তিনি বিরোধী নেতা তখনও তাঁকে সভায় নিয়ে যাওয়ার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ত। এক বার কোনও এক জেলায় সভা করতে গিয়ে রাস্তার কাদা পার করানোর জন্য দলের কমরেডরা নাকি জ্যোতিবাবুকে চেয়ারে বসিয়ে কাঁধে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন।

মুখ্যমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেওয়ার আট বছর পরেও ২০০৮ সালে সিপিএমের ব্রিগেড সমাবেশে অশক্ত শরীর নিয়ে আসতে হয়েছিল নবতিপর জ্যোতি বসুকে। চেয়ারে বসে বক্তৃতা করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, ‘‘শরীর খুব খারাপ। তবু বিমান (বসু) জোর করে বলল, আপনাকে যেতেই হবে। এক বার শুধু মঞ্চে উঠে হাত নাড়বেন।’’

এতটা না হলেও, জ্যোতিবাবুর পরে সিপিএমে জনতার কাছে তুলে ধরার মতো মুখ বলতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সংস্কৃতি পরিশীলন ইত্যাদি মোড়কে তিনি বাম-সমর্থকদের কাছে নিজের একটি গ্রহণযোগ্য অবয়ব তৈরি করতে পেরেছিলেন। দশ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বে দল তাঁকে শেষ পর্যন্ত কাজে লাগিয়েছে। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরেও ২০১৫ সাল পর্যন্ত সিপিএমের সব ক’টি ব্রিগেড সমাবেশে মুখ্য আকর্ষণ ছিলেন বুদ্ধবাবুই। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে তিনি নিজে না লড়লেও পথে নেমেছেন। মিছিল করেছেন।

এই ব্রিগেড সে দিক থেকে অবশ্যই ব্যতিক্রমী। জ্যোতিবাবু তো নেই-ই, শারীরিক কারণে বুদ্ধবাবুও আসতে পারবেন না বলে খবর। অসুস্থতার ফলে অনেক দিনই তিনি এ সব থেকে দূরে থাকতে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ সে অর্থে সিপিএমের জন-আকর্ষক কোনও নেতা এ বার মঞ্চে থাকছেন না।

প্রসঙ্গত, দেশে শাসন-ক্ষমতায় থাকাকালীন কংগ্রেস এই রাজ্যে ব্রিগেডে সমাবেশের জন্য প্রধানমন্ত্রীদের উপর বেশি নির্ভর করেছে। কারণ প্রধানমন্ত্রীর ‘ওজন’ সবচেয়ে বেশি। এখন কংগ্রেসের ব্রিগেড সমাবেশ হলে রাহুল তো বটেই, প্রিয়ঙ্কা হয়তো ভিড় টানতে আরও বেশি ‘কার্যকর’ হবেন।

মমতাদের বিরোধী সমাবেশের পিছু পিছু ব্রিগেডে সভা করার রব তোলে বিজেপিও। তাতেও নরেন্দ্র মোদীর উপস্থিতি অনিবার্য। কিন্তু এখনই ব্রিগেড ভরানো কষ্টকর বুঝে রাজ্য বিজেপি নেতারা আপাতত সে ভাবনা থেকে পিছিয়ে গিয়েছেন।

এই জায়গায় সিপিএমের সাহস এবং দৃঢ়তার প্রশংসা করতেই হয়। কোনও ‘তারকা’ নেতা ছাড়াই দল এ বার এত বড় মাঠে সমাবেশ করতে চলেছে। নির্ভরতা মূলত সাংগঠনিক শক্তির উপর। রাজ্যে ক্ষমতা হারানোর পরে গত সাত বছরে দলের চেহারা ক্রমেই ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। একের পর এক ভোটের ফলে তা ক্রমেই স্পষ্টতর। যে দলকে এক সময় ‘অপ্রতিরোধ্য’ বলে ভাবা হত, তাদের হাল এতটাই করুণ যে, ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দলের মান্যতাও তারা হারিয়েছে। তবু যা আছে তা তাদের আছে, এমন একটি বিশ্বাস থেকে ব্রিগেড ডেকে ফেলার মধ্যে একটি ‘বিপ্লবীয়ানা’ আছে বইকি!

এ বার প্রশ্ন, যে উদ্দেশ্যে এই ব্রিগেড সমাবেশ ডাকা, তার ফলিত প্রয়োগ হবে কোথায়, কী করে? সিপিএম বলেছে, এই ব্রিগেড থেকে তারা যুগপৎ বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে আহ্বান জানাবে। বলা হবে দেশ থেকে বিজেপি এবং রাজ্য থেকে তৃণমূলকে হটানোর কথা। রাজনৈতিক ভাবে তারা এটা বলতেই পারে। কিন্তু সম্ভাব্যতা? সিপিএম কি কোনওটাই পারবে?

তৃণমূলের প্রসঙ্গে পরে আসছি। কিন্তু বিজেপিকে হারানোর জন্য সিপিএমের নিজস্ব রোড-ম্যাপ কী? কলকাতায় সম্মিলিত বিরোধী দলের সমাবেশ তারা বর্জন করেছে তৃণমূল ‘অচ্ছুৎ’ বলে। কেরল ছাড়া দেশের অন্য কোনও রাজ্যে সিপিএম এখন প্রাসঙ্গিক শক্তি বলে মনে করার কারণ নেই। তা হলে কোথায় কী ভাবে বিজেপিকে হটাবে তারা? কার সঙ্গে যাবে? দেশের কোনও রাজ্যে বড় কোনও দল কি সিপিএম বা তার বাম-সঙ্গীদের ভোটের দিকে তাকিয়ে বিজেপি-হটানোর হিসেব কষছে? যদি তা না হয়, তা হলে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে সিপিএম দেশের স্বার্থে বিরোধী মঞ্চে শামিল না হয়ে ভাবের ঘরে চুরি করল কেন? এক দিন কংগ্রেসকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ভিপি সিংহকে মধ্যমণি করে জ্যোতিবাবু কিন্তু ব্রিগেডেই অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরেছিলেন।

তৃণমূলকে রাজ্যপাট থেকে নামিয়ে দেওয়ার রাজনৈতিক শক্তি আজকের সিপিএমের আছে বললে এখন তা হবে অতিকথন। তা ছাড়া যে সব দোষে আজকের শাসক দলকে দোষী করা হচ্ছে— গণতন্ত্র ধ্বংস করার, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের, জুলুম করার, নির্বাচনকে কলুষিত করার সেই সব অভিযোগ থেকে সিপিএম কি নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিল? তাদের পতনের জন্য এ সব কারণই তো দায়ী। স্মৃতি সহজে ভোলার নয়!

তবু বলব, সিপিএমের ব্রিগেড ডাকার এই হিম্মত প্রশংসনীয়। বলতেই হবে, ‘‘তোমার যা আছে, তা তোমার আছে। তুমি নও গো ঋণী কারও কাছে...’’!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

CPM Politics Rally Brigade Parade Ground
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE