Advertisement
E-Paper

‘বাজারকে সংযত করতে পারে ক্রেতার নৈতিকতা’

বললেন বিশ্ব ব্যাংকের প্রাক্তন মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুআমার মধ্যে অন্যের প্রতি মমতা থাক আর না-ই থাক, আমি জানি যে জিনিসটা ভাল। আমি নৈতিকতাকে মূলত এই ঠিক-ভুলের মাপকাঠিতে দেখছি।

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৪৬

প্রশ্ন: আপনি অর্থনীতির নিয়মের সঙ্গে মরালিটি বা নৈতিকতার সম্পর্ক নিয়ে ভাবছেন। নৈতিকতা বলতে ঠিক কী বুঝব?

কৌশিক বসু: নৈতিকতা বলতে আমি যা বুঝছি, সেটার একেবারে নিখুঁত সংজ্ঞা দেওয়া খুব কঠিন। সব ধর্মগ্রন্থেই নৈতিকতার সংজ্ঞা থাকে। অনেকে তার থেকে শেখে। আমি সে কথা বলছি না। কোনও একটা বইয়ে লেখা আছে বলেই কোনও কাজ নৈতিক হবে, এ কথা বলছি না। আসলে মানুষের ভিতরেই ‘ঠিক-ভুল’-এর ধারণা আছে। কেউ বলে না দিলেও আমরা আসলে জানি, কোন কাজটা ঠিক, কোনটা ভুল। ইদানীং ইভলিউশনারি সোশ্যাল সায়েন্স, মানে বিবর্তনবাদী সমাজবিজ্ঞানের চর্চা বেড়েছে। যাঁরা এই বিষয়ে গবেষণা করছেন তাঁদের মতে, বিবর্তনের ফলেই মানুষের মনে নৈতিকতার ধারণা তৈরি হয়। যেমন, মমতা, অন্যের প্রতি সহানুভূতি, অথবা কথা দিয়ে কথা রাখা বা মিথ্যে কথা না বলার মতো কাজগুলো যে ভাল, আর স্কুলে কোনও ছাত্রকে ‘বুলি’ করা যে খারাপ— এই কথাটা শিশুরাও কিছু দিনের মধ্যেই জেনে যায়। আমার মধ্যে অন্যের প্রতি মমতা থাক আর না-ই থাক, আমি জানি যে জিনিসটা ভাল। আমি নৈতিকতাকে মূলত এই ঠিক-ভুলের মাপকাঠিতে দেখছি।

প্র: কিন্তু, অর্থনীতি তো চিরকাল এই নৈতিক ঠিক-ভুলের প্রশ্নটাকে এড়িয়েই এসেছে।

উ: অর্থনীতিতে সত্যিই আমরা এই নিয়ে উচ্চবাচ্য করি না। সেখানে লাভ আছে, ইউটিলিটি ম্যাক্সিমাইজেশন আছে— সেটাই যথেষ্ট বলে ধরে নিই। ঘটনা হল, অ্যাডাম স্মিথ যে ‘বাজারের অদৃশ্য হাত’-এর কথা বলেছিলেন, সেটা সত্যিই একটা বিরাট আবিষ্কার। আমরা প্রত্যেকেই নিজের ভালটুকুর কথা ভেবে কাজ করলেও তাতে শেষ অবধি সমাজের ভাল হচ্ছে— স্মিথের ‘ওয়েলথ অব নেশনস’ যখন ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত হল, তখন এই ধারণাটা রীতিমত চমকে দেওয়ার মতো ছিল। কিন্তু এতে যেটা হল, এই কথাটার ধাক্কায় মানবচরিত্রের, এবং সমাজের, অন্য অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ দিক ঢাকা পড়ে গেল। অ্যাডাম স্মিথ কিন্তু নিজে সেই ভুল করেননি। তিনি এর আগে ‘থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস’ লিখেছেন। ডেভিড হিউমের সঙ্গে তাঁর দীর্ঘ বন্ধুত্ব ছিল, ইন্টেলেকচুয়াল এক্সচেঞ্জ হয়েছে প্রচুর। হিউম নৈতিকতার ওপর খুব জোর দিয়েছেন। ঘটনা হল, স্মিথের জীবদ্দশায় যখন ওয়েলথ অব নেশনস-এর পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, তিনি কিন্তু সে বইয়ের ইনডেক্সে ‘ইনভিজ্‌বল হ্যান্ড’ কথাটা রাখেননি। অর্থাৎ, তাঁর কাছে এই ধারণাটা তাঁর তত্ত্বের কেন্দ্রের কাছাকাছিও ছিল না। তিনি ভাবেননি, লোকে বাকি সব কিছু ভুলে শুধু স্বার্থপরতার কথাটাই মনে রাখবে।

প্র: এটা কেন হল?

উ: হওয়ার একটা স্বার্থপর কারণ আছে। সমাজে যারা ভাল করছিল, তারা নিজেদের সমৃদ্ধি টিকিয়ে রাখার জন্য বলতে আরম্ভ করল, আপনা থেকে যেটা হচ্ছে, সেটাই ভাল। ভারতীয় সমাজে বর্ণাশ্রমের প্রথার ক্ষেত্রে যেমন ব্রাহ্মণরা বলত, নিম্নবর্ণের লোকরা যে কষ্ট পাচ্ছে, তা ন্যায্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে বলা হয়, যে গরিব, তার গরিবই হওয়ার কথা। দাসপ্রথার সময় এই কথাটাই লোকেদের বোঝানো হত। এটা আসলে কায়েমি স্বার্থের খেলা। অমর্ত্য সেন যেমন দেখিয়েছেন, ঔপনিবেশিক আমলে দুর্ভিক্ষ হলেও ব্রিটিশরা স্মিথের দোহাই পেড়ে বলত, বাজারে হস্তক্ষেপ না করাই ভাল। মজার কথা হল, যে কেনেথ অ্যারো স্মিথের তত্ত্বকে অর্থনীতিতে অঙ্কের ভাষায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন— ‘আ কশাস কেস ফর সোশ্যালিজম’। সেখানে তিনি বলেছিলেন, মানুষের মধ্যে যদি সততা, পরার্থপরতার মতো গুণগুলো না থাকে, তবে আধুনিক সমাজ মুহূর্তের মধ্যে ভেঙে পড়বে।

প্র: কিন্তু নৈতিকতার নামে নানা রকম কুযুক্তিও তো ঢুকে পড়তে পারে! কমার্শিয়াল সারোগেসি-র কথাই ধরুন। সেখানে সরকারপক্ষের মূল আপত্তিই হল যে, টাকার বিনিময়ে মাতৃত্ব বিক্রি করা ভারতীয় সংস্কৃতির নৈতিকতার বিরোধী। নৈতিকতার সূত্রে এই ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র যুক্তি ঢুকে পড়লে তো আটকে যেতে পারে অনেক কিছুই।

উ: সারোগেসি থেকে যৌনশ্রম, প্রতিটি বিষয়কেই আলাদা করে দেখতে হবে। যেহেতু কোনও একটা কথা আমাদের সংস্কৃতিতে আছে, হাজার বছর আগেকার কোনও বইয়ে লেখা আছে, অতএব সেই কথাটা মেনে চলতে হবে— আমি এটা একেবারেই মানি না। আমি মনে করি আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে নৈতিকতার বোধ আছে। সেই বোধ অনুযায়ী চলতে হবে। এবং, ভেবে দেখতে হবে, যে জিনিসগুলো চলে আসছে, সেগুলো ঠিক না ভুল। ভুলগুলোকে বাদ দিতে হবে। গভীরতর মানবিক নৈতিকতাকে প্রশ্ন করতে হবে। সে প্রথা সেই নৈতিকতার মানদণ্ডে আটকে যাবে, সেটাকে বাদ দিতে হবে।

প্র: মূলধারার অর্থনীতিতে জাস্টিস বা ন্যায্যতার ধারণাটাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ধরে নেওয়া হয়, বাজার ঠিক ভাবে কাজ করলেই সম্পদের ন্যায্য বণ্টন হবে। কেন?

উ: অর্থনীতি আর নৈতিকতার মাঝের পরিসরটায় দুনিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষটি হলেন অমর্ত্যদা। তিনি অনেক লিখেছেন। জন রলস-এর কাজও অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রবার্ট নজিক-এর বাজারকেন্দ্রিক দর্শনেও ন্যায্যতার ধারণা আছে। কিন্তু, এগুলো সবই ‘প্রান্তিক’ কাজ। আমার ধারণা, এখানেও কায়েমি স্বার্থেরই গল্প। যাঁরা আর্থিক ভাবে ভাল করেছেন, উত্তরাধিকার সূত্রে যাঁদের ছেলেমেয়েরা সম্পদের মালিক হবে, সমাজকে ন্যায্যতার কথা মনে করিয়ে তাঁদের কোনও লাভ নেই। এই অন্যায্য ব্যবস্থা তাঁদের পক্ষে ভাল। তবে, মার্কিন সমাজে একটা বদল আসছে, যেটা দেখে আমি আশাবাদী হই। সেখানে যাঁরা আর্থিক ভাবে খুবই ভাল অবস্থায় আছেন— বিলিয়নেয়ার— তাঁদের একটা অংশের মধ্যে একটা বোধ তৈরি হয়েছে যে আমাদের থেকে আয়কর নিয়ে সেই টাকা গরিবদের দেওয়া দরকার। সিএনএন-এর প্রতিষ্ঠাতা টেড টার্নার অনেক দিন আগে একটা কথা বলেছিলেন। কথাটা অনেকটা এই রকম— সমাজের প্রচলিত নিয়ম মেনে আমি জীবনে খুবই সমৃদ্ধি অর্জন করেছি। কিন্তু, যেখানে সমাজে এতখানি দারিদ্র আছে, সেখানে এই নিয়মগুলো পালটানো দরকার। এমন ভাবে, যাতে কেউ এতখানি সমৃদ্ধি অর্জন না করতে পারে। আমার কাছে এই জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক ভাবে সবচেয়ে বড় উদাহরণ ফ্রেডরিক এঙ্গেল্‌স। ব্যাবসা করে প্রচুর টাকা আয় করছেন, আবার চেষ্টা করছেন যাতে ভবিষ্যতে শোষণ শেষ হয়। ব্যবসায় যে লাভ হত, তার বেশির ভাগটাই মার্কসের হাতে তুলে দিতেন।

প্র: অর্থনীতির মূলধারার তত্ত্বে ন্যায্যতার প্রশ্নটা কি এই কারণেও গুরুত্ব পায়নি যে অর্থনীতি মূলত কনসিকোয়নশিয়ালিস্ট দর্শনে বিশ্বাসী, যেখানে কোনও কাজের বিচার হয় তার পরিণাম অনুসারে? ন্যায্যতা তো পরিণামের ওপর নির্ভরশীল নয়, বরং কী ভাবে কাজটা করা হচ্ছে, সেটা ন্যায্য কি না— পরিণতি যা-ই হোক, সেটা গুরুত্বপূর্ণ।

উ: হ্যাঁ, অর্থনীতি পরিণামবাদী। ফলাফলটাই মুখ্য, কী ভাবে সেখানে পৌঁছনো গেল, সেটা নয়। আমি আগে সম্পূর্ণত এই দর্শনে বিশ্বাসী ছিলাম। মানুষের নৈতিক বিশ্বাস বদলায় কি না জানি না, কিন্তু এখন বিশ্বাস করি, ডিঅন্টলজিকাল এথিকস-এর একটা মস্ত ভূমিকা আছে। কথা দিলে কথা রাখতে হয়, এই কথাটা শুধু নিজের কারণেই গুরুত্বপূর্ণ— কথা না রাখলে কী ক্ষতি হয়, অথবা রাখলে কতখানি লাভ, এই সব বিচার করে তার গুরুত্ব নির্ধারিত হয় না। মূলধারার অর্থনীতি এই কথাটা বিশ্বাস করবে না।

আমার মনে হয়, ডিঅন্টলজিকাল এথিকস-এর একটা গভীর, বৃহত্তর কনসিকোয়েনশিয়ালিস্ট যৌক্তিকতা থাকতে হবে। যেমন, মিথ্যে কথা না বলাই উচিত। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য মিথ্যে কথা বলা সব সময়ই অনৈতিক। কিন্তু, আমার কোনও একটা মিথ্যে যদি কাউকে কোনও বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে, অথবা সত্যি কথাটা যদি কাউকে গভীর ভাবে আঘাত করে, তা হলেও কি মিথ্যে কথা বলাটা অনৈতিক হবে? এই প্রশ্নগুলো ভাবা প্রয়োজন। তবে, এর আবার একটা গোলমেলে দিক আছে। সবাই যদি অন্যকে আঘাত না করার জন্য মিথ্যে বলতে আরম্ভ করে, তা হলে ভাষার নিজস্ব ক্ষমতা চলে যাবে। লোকে আমায় কিছুতে ভাল বললেও আমি সেটা আর বিশ্বাস করব না। এই দিকটাও মাথায় রাখা ভাল। তবে, এখানের দ্বন্দ্বটা কিন্তু এক নৈতিকতার সঙ্গে অন্য নৈতিকতার। নৈতিকতার সঙ্গে স্বার্থপরতার কোনও দ্বন্দ্ব নেই, কোনও যুক্তিতেই স্বার্থপরতাকে নৈতিকতার ওপরে জায়গা দেওয়া চলতে পারে না।

প্র: নৈতিকতার তো কোনও সর্বত্র প্রযোজ্য ‘থাম রুল’ থাকতে পারে না। তা হলে মানুষের নিজের বিচারবুদ্ধির ওপরই ভরসা রাখতে হবে? যে মানুষ নরেন্দ্র মোদীকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পকে সমর্থন করে, তার বিচারবুদ্ধির ওপর কি ভরসা করা যায়?

উ: এই আপত্তিটা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু মানুষের তো ভুল হয়। যখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, অন্যরা এগিয়ে যায়, তখন রাগ হয়। হিন্দুদের হয়তো মনে হয়, আমরাও মুসলিম মৌলবাদের নকল করি। আমেরিকাতেও হোয়াইট সুপ্রিমেসি-র একটা মুভমেন্ট ফের তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, আগে যেমন বললাম, মানুষ নিজের ভুল বোঝেও। আর, তার নৈতিকতার বোধের ওপর ভরসাও করা যায়। এক বহুজাতিক সংস্থা প্রায় অমানবিক ভাবে জুতো তৈরি করাত এবং প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থার চেয়ে খানিক কম দামে বাজারে বেচত। সেই খবরটা জানাজানি হওয়ার পর এমনই প্রতিবাদ হল, দুনিয়া জুড়ে ক্রেতারা সেই ব্র্যান্ডটাকে বয়কট করতে আরম্ভ করলেন যে সংস্থাটি নতুন করে ভাবতে বাধ্য হয়েছে। মানে, সাধারণ মানুষের নৈতিকতার বোধ কাজ করতে আরম্ভ করলে কিন্তু বাজারকেও সংযত করা যায়। অনেক মার্কিন সংস্থাই এখন কিছু প্রাথমিক নিয়ম মেনে চলে, কারণ তারা জানে, ক্রেতারা রুখে দাঁড়ালে তাদের বিপুল লোকসান হবে।

আর একটা কথা বলি। যে সব সমাজে দ্রুত আর্থিক উন্নতি হয়েছে, সেখানে কিন্তু মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস আছে। সুইডেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড— সর্বত্রই তাই হয়েছে। ছোটখাটো ব্যাপারে পরস্পরকে বিশ্বাস করতে পারলে আর্থিক বৃদ্ধি দ্রুত হয়। জাপানে হয়েছে। ভারতেও হতে পারে। এ দেশে একটা বিচিত্র ব্যাপার আছে। এখানে চেনাজানা মানুষের মধ্যে— আত্মীয়, বন্ধুদের মধ্যে— পারস্পরিক বিশ্বাসের পরিমাণ বিপুল। কিন্তু, পরিচিতির গণ্ডি টপকালেই সেটা উবে যায়। অচেনা মানুষকে পেলেই ঠকাব, এই মানসিকতাটা ছেড়ে বেরোতে হবে।

প্র: আপনি সম্প্রতি বলেছিলেন, যদি কোনও ভাবে অসাম্য কমানো সম্ভব হয়, তবে একশো বছর পরের মানুষ আজকের দুনিয়ার চূড়ান্ত অসাম্যের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হবে। এই অসাম্যের একটা বড় উৎস সম্পদের উত্তরাধিকার। বাজার ব্যবস্থা বা পুঁজিবাদী অর্থনীতি সেই উত্তরাধিকারে কোনও আপত্তি করে না। তা হলে কি পুঁজিবাদের মধ্যে থেকে অসাম্য কমানোর কোনও উপায় নেই?

উ: এটা শুধু বাজারের গল্প নয়। আসল কথা হল, আমরা কি আইনের মাধ্যমে আর্থিক উত্তরাধিকার নিশ্চিত করছি? এমন সমাজ হতেই পারে যেখানে বাজার আছে, কিন্তু আর্থিক উত্তরাধিকার বলে কিছু নেই। কেউ মারা গেলে তার সম্পত্তির বেশির ভাগের ওপর তার পরিবার বা সন্তানের আর কোনও অধিকার থাকবে না। আবার, অন্য রকম সমাজে রাষ্ট্র এই উত্তরাধিকারকে রক্ষা করতে পারে। উত্তরাধিকার হল রাষ্ট্রের স্তরে হস্তক্ষেপ— আমার সম্পত্তি কে পাবে, আমার সেই ইচ্ছেটাকে রাষ্ট্র রক্ষা করছে, অথবা করছে না। মজার কথা হল, যাঁরা আর পাঁচটা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রবল বিরোধী, তাঁরা কিন্তু এই ক্ষেত্রে উচ্চবাচ্য করেন না। রাষ্ট্রের এই অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। আমার মতে, উত্তরাধিকারের কোনও নৈতিক ভিত্তি থাকতে পারে না। যদি এ কথাটা মেনেও নিই যে আমি খেটে রোজগার করলে সেই টাকার ওপর আমার হক আছে, জন্মের সময় কিন্তু তেমন কোনও অধিকার থাকতে পারে না। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি ন্যায্য ব্যবস্থা চালু হওয়া প্রয়োজন।

যারা বড়লোক হয়েছে, তারা বলবে, খাটলেই সমৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব। এটা পুরোপুরি সত্যি কথা নয়। গরিব মানুষদের মধ্যে অনেকেই উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন, কারণ সেই খাটুনির ওপর তাঁদের বেঁচে থাকা নির্ভর করে। কিন্তু, তাঁরা বড়লোক হচ্ছেন না। বাজার তো সব ধরনের কাজকে পরিশ্রমের হিসেবে সমান দাম দেয় না। এখানেও কিন্তু রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা আছে। শুধু রাষ্ট্রের নয়, আমাদের সবার। যারা আর্থিক ভাবে ভাল করেছি, তাদের দায়িত্ব হল এই মানুষগুলোর কথা ভাবা। বিশেষত উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে একটা বড় অংশ করবাবদ কেটে নিয়ে গরিব মানুষের কাজে ব্যয় করা দরকার।

প্র: অসাম্য যদি কমাতে হয়, তবে চেষ্টাটা কোথা থেকে শুরু করা দরকার?

উ: যখন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হচ্ছিল, তার গোড়ার দিকে উদ্দেশ্য কিন্তু সৎ এবং মহান ছিল। সাম্য, সমতার দাবি ছিল। কিন্তু, পাশাপাশি বাজারকেও কাজ করতে দিতে হবে। রাশিয়ার উদাহরণটা মোক্ষম। সে দেশে সমাজতন্ত্র যখন শেষ অবধি ভেঙে প়ড়ল, তখন তো একটা বিকৃত পুঁজিবাদ চলছিল। দেশের প্রায় সব সম্পদ কিছু লোকের হাতে। সে দেশে সমাজতন্ত্রের গোড়ায় সব কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত হল, তার পর কিছু লোক পুরোটা দখল করে ফেলল। কাজেই, পুনর্বণ্টন জরুরি, কিন্তু তার জন্য মানুষের কাজ করার বা নতুন আবিষ্কার করার প্রণোদনাকে নষ্ট করে ফেললে চলবে না। আর সব কিছুর কেন্দ্রীকরণ করে পুরোটা রাষ্ট্রের হাতে তুলে দিলে বিপদ— কিছু লোক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সেই সম্পদের মালিক হতে চাইবেই। কাজেই, অসাম্য কমাতে হবে, এই কথাটা ভাবাই যথেষ্ট নয়। কী ভাবে নতুন ব্যবস্থাটা চলবে, তার একটা ব্লুপ্রিন্ট থাকা দরকার।

সাক্ষাৎকার: অমিতাভ গুপ্ত

Kaushik Basu Economy Market Interview
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy