Advertisement
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

ক্রান্তিকাল

পাকা প্রমাণ না মিলিলেও অনুমান যথেষ্ট পাকা যে, সুবোধকুমারের বিরুদ্ধে পুলিশবাহিনীর মধ্যেই ষড়যন্ত্র ঘটিয়াছিল। পুলিশ অফিসারের নিজেরই যখন এতখানি নিরাপত্তার অভাব, নিরপেক্ষ তদন্তের দায়ে তিনি নিজেই যখন ঘাতকের নিশানা, তখন সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি কেমন, তাহা বুঝিতে কষ্ট হয় না।

—ছবি এপি।

—ছবি এপি।

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সুবোধকুমার সিংহ উত্তরপ্রদেশে পুলিশের চাকরি করিতেন। পুত্রকে তিনি শিক্ষা দিয়াছিলেন মানবিকতার ধর্ম পালন করিতে, ধর্মের ভিত্তিতে ভেদাভেদ না করিতে। তাঁহার নিজের রাজ্যে এই স্বাভাবিক মূল্যবোধটি পালন করিতে গেলে যে দাম কতখানি পড়িতে পারে, তাহা অবশ্যই তিনি আগে বোঝেন নাই। পুত্র অভিষেক এখন তাহা বুঝিতেছেন। বুঝিয়াও পিতৃদত্ত শিক্ষা তিনি মানিয়া চলিবেন কি না, তাহা ভবিষ্যতের বিষয়। বর্তমান কালে অন্তত এইটুকু বলা যায় যে নরেন্দ্র মোদী শাসিত দেশে, যোগী আদিত্যনাথ শাসিত রাজ্যে, সুবোধকুমারের আদর্শ মানিয়া চলিতে গেলে প্রাণে বাঁচিবার আশা কম— নাই বলিলেও চলে। সুবোধকুমার দাদরির মহম্মদ আখলাকের নিধন-কাণ্ডের তদন্ত করিতেছিলেন, আখলাকের গ্রামে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কমাইবার প্রয়াস করিয়াছিলেন, সম্ভবত সেই কারণেই তাঁহাকে এতখানি ‘দাম’ দিতে হইল। পাকা প্রমাণ না মিলিলেও অনুমান যথেষ্ট পাকা যে, সুবোধকুমারের বিরুদ্ধে পুলিশবাহিনীর মধ্যেই ষড়যন্ত্র ঘটিয়াছিল। পুলিশ অফিসারের নিজেরই যখন এতখানি নিরাপত্তার অভাব, নিরপেক্ষ তদন্তের দায়ে তিনি নিজেই যখন ঘাতকের নিশানা, তখন সাধারণ মানুষের পরিস্থিতি কেমন, তাহা বুঝিতে কষ্ট হয় না। আরও এক বার প্রতিষ্ঠা হইল, বিজেপির শাসনে কেবল সংখ্যালঘু হওয়াই অপরাধ নয়, ধর্মের প্রশ্নে নিরপেক্ষ হওয়াও মোক্ষম অপরাধ। এই রাজ্যে ইতিমধ্যেই অপরাধচক্র ও প্রশাসন প্রায় একই মুদ্রার দুই পিঠ হইয়া বসিয়াছিল— বিজেপির কল্যাণে এখন সংখ্যালঘু প্রশ্নে সেই প্রশাসন-মাফিয়া পূর্ণোদ্যমে সক্রিয়।

ঠিক এই কারণেই, রাজকুমার চৌধুরী ও তাঁহার স্ত্রী প্রীতি যখন সকালে উঠিয়া নিজেদের জমিতে বহুসংখ্যক গরুর লাশ পড়িয়া আছে দেখিয়া মানসিক ধাক্কা কাটাইয়া প্রথমেই লাশগুলিকে জমিতে পুঁতিয়া সঙ্কটমোচন করিতে চাহিয়াছিলেন, তাঁহারা ভুল ভাবিয়াছিলেন। গরুর লাশ লইয়া অশান্তি পাকানো যেখানে লক্ষ্য, সঙ্কটমোচনের প্রশ্ন সেখানে উঠে কী ভাবে। আবারও প্রমাণ হইল যে, সাধারণ নাগরিক ধর্মান্ধ নহে— রাজনৈতিক দালালরাই তাঁহাদের ধর্মান্ধতার পথে চলিতে বাধ্য করে। এতগুলি গরুর লাশের সামনে দাঁড়াইয়াও সাধারণ নাগরিক ভাবেন, কোনও মতে সেগুলির গতি করিয়া অঞ্চলের শান্তি নিশ্চিত করাই উচিত। আর, আরএসএস-এর ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ বাহিনী তাঁহাদের ঘাড়ে ধরিয়া বুঝাইয়া দেয় যে, অঞ্চলে আগুন ধরাইয়া দেওয়াই তাহাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। বিজেপি শাসিত উত্তরপ্রদেশে এখন মুসলিমবিদ্বেষের কার্যক্রম এতটাই তীব্র, তীক্ষ্ণ ও গভীর যে বিশ্বাস করাই কঠিন— গরুর লাশগুলি ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ বাহিনীর দৌলতেই চৌধুরী পরিবারের জমিতে আসিয়া উপস্থিত হয় নাই!

আখলাকের তদন্তে সুবোধকুমারের ভূমিকার সহিত তাঁহার নিধনের যোগ আছে, ইহা তাঁহার পরিবারেরই মত। দাদরি ঘটনার পর এই পরিবার বারংবার হুমকি পাইয়াছেন। তাঁহাদের সন্ত্রস্ত করিবার চেষ্টা চলিয়াছে। তাঁহারা বাড়িতে লুকাইয়া থাকিতে বাধ্য হইয়াছেন। তবুও সুবোধকুমার থামেন নাই, নিজের কর্তব্য করিয়াছেন। তিনিও জানিতেন, গরু নিমিত্তমাত্র, গরুর মাংস কিংবা গরুর লাশের অছিলায় মানুষ মারাই ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ শাসনের কাজ। রবীন্দ্রনাথের বিদ্রুপবাণীকে এই শাসন সত্যে পরিণত করিতে বদ্ধপরিকর: গোহত্যা পাপ হইলেও তদুপলক্ষে মানবহত্যা পাপ নয়। তবু পুলিশ অফিসারটি তাঁহার আদর্শে স্থিত ছিলেন, নতিস্বীকার করাইতে তাঁহাকে মারিতে হইল। আদ্যন্ত গুন্ডাদর্শপরায়ণ প্রশাসনের মধ্যে ‘সিস্টেম’-এর সহিত লড়াই করিবার মতো এখনও যে কিছু ব্যতিক্রম আছেন, ছিলেন, সুবোধকুমার একাই তাহা প্রমাণ করিয়া গেলেন। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে এইটুকুই রুপালি রেখা।

অন্য বিষয়গুলি:

Mob Violence Uttar Pradesh Bundelshahr
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy