খবরে প্রকাশ, ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড বা বিপিসিএল সরকার বেচে দিচ্ছে আগামী বছরের মার্চ মাসের মধ্যেই। যখন শুনি সরকার কোনও সংস্থা বেচে দেবে আমরা ধরেই নিই সংস্থাটি লাভজনক নয়, বা সরকার তাকে লাভজনক ভাবে চালাতে পারছে না, তাই এই সিদ্ধান্ত। কলকাতার এক কালের গর্ব ও পরবর্তী কালের ভগ্নদশায় পড়া গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল এ রকম এক উদাহরণ। বিপিসিএল-ও কি সেই দশায় পড়েছে?
১৯৬৭ সালের ২৪ জানুয়ারি বর্মা শেল অয়েল স্টোরেজ ও ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি ও বর্মা শেল রিফাইনারিজ় লিমিটেডকে একত্র করে তৈরি হয়েছিল বিপিসিএল। তেরো হাজারের ওপর কর্মী, সম্মিলিত পঁয়ত্রিশ মিলিয়ন মেট্রিক টন পরিশোধিত তেল উৎপন্ন করে এই কোম্পানি প্রতি বছর। এদের আছে দু’টি রিফাইনারি, পঞ্চাশটি এলপিজি বটলিং প্লান্ট, প্রায় চোদ্দো হাজার পেট্রলপাম্প, এবং প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার পাইপ-লাইন। এ কোম্পানির টার্নওভার প্রায় পঞ্চাশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (চৌত্রিশ হাজার কোটি টাকার বেশি)। এ বছরে, অর্থাৎ ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর অবধি মুনাফা করেছে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অর্থাৎ, ছাত্র ফেল করেনি, বরঞ্চ বেশ ভাল ফল করেছে, কিন্তু সরকার এই সংস্থাকে জনসাধারণের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে দিয়ে দিচ্ছে কোনও পুঁজিপতির হাতে। এ-হেন সিদ্ধান্তের কারণ কী? কারণ বিপিসিএল ও এয়ার ইন্ডিয়া— এই দুই সংস্থাকে বিক্রি করে সরকার একটি ফান্ড তৈরি করবে, এক লক্ষ কোটি টাকার। বেহাল অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে অ-সাধারণ পদক্ষেপ, সন্দেহ নেই!
প্রসঙ্গত, এ দেশে ডিজেলের দাম কম ও পেট্রলের দাম বেশি। ডিজেল নাকি জনসাধারণের ও পেট্রল ‘বড় লোকের’। এমন নিয়ম পৃথিবীতে কোথাও নেই। প্রস্তুত করতে খরচ পড়ে প্রায় সমান, ও দাহ্য-ক্ষমতা বা ক্যালরিফিক ভ্যালু পেট্রলের সামান্য বেশি। তেলের যে দাম, তার প্রায় সাতচল্লিশ শতাংশ পেট্রলের ক্ষেত্রে আর উনচল্লিশ শতাংশ ডিজেলের ক্ষেত্রে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের পকেটে ঢোকে। ডিজেল গরিবের, তাই ডিলারদের দাম দিতে হয় বেশি, লাভ থাকে কম। সুতরাং সার্ক গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির মধ্যে তেলের দাম এখানেই সব থেকে বেশি। পৃথিবীতে এই তালিকায় ভারতের স্থান ৭৯। সেখানে আফগানিস্তান ২৫, পাকিস্তান ৩০, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান— যথাক্রমে ৫৩, ৫৭ ও ৫৯ নম্বরে। আমাদের কাছাকাছি, বাংলাদেশ, ৭৩ নম্বরে।
অপরিশোধিত তেলের দামে ধস নেমেছিল ২০১৫-২০১৭ সালে। আমেরিকাতে ২০১৩ সালের দামের প্রায় ৬০% দামে ২০১৭-তে পেট্রল বিক্রি হয়েছে। অর্থাৎ সে দেশের সরকার কম দামে অপরিশোধিত তেল পাওয়ার সুবিধেটা মানুষকে পেতে দিচ্ছে। এ দেশে উল্টো। এতে সরকারের তেলের দাম ধার্য করা সম্বন্ধে মনোভাব বোঝা যায়। উপায় থাকলে সরকার তেল কোম্পানিদের বেশি লাভ করতে দেবে, কিন্তু জনগণের বেলায় লবডঙ্কা। সরকারি ক্ষেত্রে উৎপন্ন ১৯৬ মিলিয়ন মেট্রিক টন তেলের বিশ শতাংশ আসে বিপিসিএল, যা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ সাধারণ মানুষের সে তেলের ওপর কোনও দাবি থাকবে না, তেলের বিপুল রাজস্ব আসলে মানুষের উন্নয়নের কাজে লাগে বলে সরকারের যে দাবি, তাও টিকবে না। যে সরকার পরিশোধিত তেলের দাম এক তৃতীয়াংশে নেমে গেলেও জনগণকে কোনও সুবিধে দেয় না। তেলের উৎপাদন বিশ শতাংশ কমে গেলে তারা যে তেলের দাম আরও বাড়িয়ে দেবে, তাতে সন্দেহ থাকে কি?
ভারতীয় রেল যেমন শুধু রেল নয় একটি রাজনৈতিক অস্ত্র, ব্যক্তি ও দলের প্রভাব বিস্তারের অস্ত্র, তেলের ব্যাপারটাও এক রকম। তেল কোম্পানিগুলি অনেক প্রকল্প নেয়, যা প্রযুক্তিগত সিদ্ধান্ত চালিত নয়, তথাকথিত ‘জনগণের প্রত্যাশা’ দ্বারা চালিত। স্বাভাবিক ভাবেই সেখানে লাভের মাত্রা কম, আর সেই ক্ষতিপূরণ করতে সারা দেশের লোককে তেল গ্যাস ইত্যাদির বর্ধিত মাসুল গুনতে হয়। তৈল শোধনাগারে দেখেছি, ষাট শতাংশ ব্যবহারের অযোগ্য বলে ঘোষিত ‘স্ক্র্যাপ’, তবুও মানুষের সেন্টিমেন্টের জন্য সেই শোধনাগার বন্ধ করা যাবে না। তা ছাড়া বিশ্বের অনেক বড় কোম্পানি যখন তেল তোলা ও পরিশোধন করা, দুটো কাজই নিজেরা করে, এখানে কিন্তু তা নয়। এক কোম্পানি তেল তুলছে তো পরিশোধন করছে আর এক জন। এত সব কোম্পানি রাখার খরচ অনেক বেশি। যদি পেট্রোলিয়াম মন্ত্রকের ছাতার তলায় কোম্পানিগুলিকে একত্র করা হত?
তা হল বিশ্বের প্রথম দশটি কোম্পানির মধ্যে সেই কোম্পানির স্থান করে নিত শুধু নয়, এসে যেত একেবারে পঞ্চম স্থানে। অর্থাৎ, পৃথিবীর তেলের মানচিত্রে একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে নিত ভারত। আন্তর্জাতিক বাজারের নিয়ন্ত্রণ অনেকটাই চলে আসত ভারতের হাতে। এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে যে শক্তির দরকার হয়, তা কিন্তু এই সরকারের ছিল। কিন্তু তারা সে কথা না ভেবে উল্টে একটি সুস্থসবল সংস্থাকে বিক্রি করে দিয়ে আরও নীচের দিকে নামিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy