Advertisement
E-Paper

তন্ত্র আছে গণ নাই

গদি-উপবিষ্ট মানুষের গাড়ি যাইলে রাস্তা ছাড়িতে হয়, শহরে রাষ্ট্রনিয়ন্তা আসিলে যানজটে ভোগান্তি তো হইবেই: এইগুলি প্রায় বিনা আপত্তিতে স্বীকৃত।

শেষ আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০১৭ ০০:০০

এমন রটনা রহিয়াছে, ভারতে গণতন্ত্র নামে এক ব্যবস্থা চলিতেছে। কিন্তু অহরহ ইতস্তত কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় এবং বোধ হয়— প্রকৃতপক্ষে এই দেশে প্রতিষ্ঠিত এক ছদ্মবেশী রাজতন্ত্র, যেখানে রাজা এক জন নহেন, ক্ষমতাশালী রাজনীতিকরা অনেকেই। তাঁহাদের দেখিলেই কুর্নিশ করিতে করিতে পথ ছাড়িয়া দিতে হইবে, নিজেদের অধিকার বিসর্জন দিয়া তাঁহাদের অগ্রাধিকারকে স্বীকার করিতে হইবে, এই আচরণবিধি সকলেই জানেন ও প্রায় প্রশ্ন না করিয়াই মানেন। বুধবার ইম্ফল বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতির বিমান নামিবে বলিয়া, প্রায় দুই ঘণ্টা অন্যান্য সব বিমানের উড়ান ও অবতরণ স্থগিত রাখা হইল। এক মহিলা তাঁহার স্বজনের অন্ত্যেষ্টিতে যোগ দিতে যাইতেছিলেন, তিনি এই বিলম্বে ও হয়রানিতে কাঁদিয়া ফেলেন ও রাষ্ট্রপতিকে অভ্যর্থনা জানাইতে আসা পর্যটনমন্ত্রীর নিকট ক্ষোভের কথা উগরাইয়া দেন। মন্ত্রী জানান, তাঁহার কিছু করিবার নাই, এই প্রোটোকল বা নিয়ম সত্তর বৎসর ধরিয়া চলিয়া আসিতেছে। মুশকিল হইল, সকল যাত্রী দুঃখের কথা মন্ত্রীকে জানাইবার সাহস রাখেন না, সুযোগও হয় না, আর অন্ত্যেষ্টির ন্যায় স্পর্শকাতর ও আবেগঘন বিষয় ব্যতীতও বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম তাঁহাদের থাকে, যাহা ফসকাইয়া যাইবার বিরক্তি বেদনা গিলিয়া লইয়া গুমরাইতে হয়। যাহা বিস্ময়কর: গণকে বাদ দিবার এই তন্ত্রটি ঔচিত্যের আলোকে দীপ্ত। গদি-উপবিষ্ট মানুষের গাড়ি যাইলে রাস্তা ছাড়িতে হয়, শহরে রাষ্ট্রনিয়ন্তা আসিলে যানজটে ভোগান্তি তো হইবেই: এইগুলি প্রায় বিনা আপত্তিতে স্বীকৃত। সত্তর বৎসর ধরিয়া এই প্রকারের অনুশাসন চলিয়া আসিতেছে বলিয়াই কেন তাহা এখনও চলিবে?

ইহার এক সর্বনাশা উত্তর: এই ব্যবস্থা কায়েম রাখিতে নেতানেত্রীদের অনেকেই উৎসাহী। কয়েক জন ব্যতিক্রম অবশ্যই রহিয়াছেন, তাঁহারা ‘ভিভিআইপি সংস্কৃতি’ বিনাশের সক্রিয় চেষ্টা করিতেছেন, কিন্তু অধিকাংশের বিশ্বাস: জনগণ ও ক্ষমতাবান কখনও একাসনে বসিতে পারেন না, রাজনীতির কর্তা-কর্ত্রীদের জন্মগত অধিকার অন্যকে বঞ্চিত করিয়া বিশেষ সুবিধা গ্রহণ। গত মাসে এক নেতা নয়াদিল্লির বিমানবন্দরে একটি বাসে একা চড়িয়া বোর্ডিং গেট হইতে বিমান পর্যন্ত যাইতে চাহিয়াছিলেন এবং সেই দাবি মানা হইয়াছিল, গত মার্চে এক সাংসদ উড়ান-কর্মীকে চটি দিয়া পিটাইয়াছিলেন (তাঁহার নিজ অহংকারী গণনা অনুযায়ী পঁচিশ ঘা)। মন্ত্রীসান্ত্রি নিজ অন্যায় সুবিধার পান হইতে চুন খসিতে দেখিলে সৎ সাধারণ কর্মীকে অপমান করিবেন, ইহা এই দেশে আশ্চর্য সংবাদ নহে। কোনও মুরুব্বি রাজধানী এক্সপ্রেসে উঠিয়া তাঁহার দেহরক্ষীদের বসাইবার জন্য সাধারণ যাত্রীদের দাঁড়াইয়া যাইতে বাধ্য করেন। কেহ টোল প্লাজার কর্মী তাঁহার কনভয়ের নিকটে শুল্ক দাবি করায়, তাঁহাকে বেদম প্রহার করেন। পশ্চিমবঙ্গে এক নেতার নামে টোল প্লাজার কর্মীকে জুতা দিয়া পিটাইবার অভিযোগ উঠিয়াছিল। আর এক সাংসদ ট্রাফিক পুলিশকে চড় মারিয়াছিলেন, কারণ পুলিশকর্মী বলিয়াছিলেন অাইন ভাঙিবার অধিকার সাংসদের গাড়িরও নাই। এই সকল কাণ্ডের কান্ডারিরা কখনও কংগ্রেস কখনও বিজেপি কখনও তৃণমূল, সাল কখনও ২০১২ কখনও ২০১৪, ২০১৭। কিন্তু সময় বা দল বদলায়, মনোভঙ্গি বদলায় না, তাঁহারা রাজা, বাকিরা সামান্য প্রজা, তাঁহারা ভোট যাচনার কালে জনগণের নিকট প্রণত, জিতিবার পরে জনগণের পাঁজরের উপর দাপটে সঞ্চরমান। ভারতীয় সমাজের বিন্যাসেই ক্ষমতার প্রতি এই নিঃশর্ত ভয়-ভক্তি নিহিত, না কি ইহা সাধারণের মেরুদণ্ডকে পরিকল্পিত ভাবে গুঁড়া করিবার এক প্রতিষ্ঠিত কৌশল, না কি ঔপনিবেশিক শাসনের ক্বাথ, না এই সকলের মিশ্রণ, জটিল প্রশ্ন। কিন্তু ইহা স্পষ্ট, ক্ষমতাসীনদের মনোবৃত্তি না বদলাইলে, প্রোটোকল বদলাইয়া লাভ হইবে না, ওই কল ভিন্ন রূপে কারখানা বিস্তার করিবে।

Democracy India Imphal
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy