Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পুরুষ ও নারীর জীবনের মূল অভিষেক পর্বে প্রবেশ

কুড়িটি ক্রমপর্যায়ে এই যে সাঁওতালি বিবাহ, তা তাঁদের প্রকৃতি নির্ভরতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এঁদের মূল্যবোধ, সারল্য, চারিত্রিক সততা এঁদের অমলিন আনন্দঘন জীবন উপহার দেয়। অভাবকে এঁরা পাত্তাই দেন না। সামগ্রিক মানসিকতা দিয়ে তা জয় করে নেন। লিখছেন প্রণব হাজরা এইগুলি হল: কনেঘরের গাছ তলায় বরের পৌঁছনো, সর্দারের কাছে জল বিবাহের সামাজিক অনুমতি, জলাধার খনন, জলাধার প্রতিষ্ঠা, জল সিঞ্চন, জল আহ্বান, জল অভিষেক, জল বরন, জল পূজা, জলকে নিমন্ত্রণ করে ঘরে তোলা, তেল মাখানো, জল শান্তি, জল আশীর্বাদ, জল মাঙ্গলিক ও জল অনুমতি।

বিয়ের অনুষ্ঠানে। নিজস্ব চিত্র

বিয়ের অনুষ্ঠানে। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০১৯ ১০:২২
Share: Save:

সুনুম সাসাঙ (গায়ে হলুদ): এ বার সাঁওতাল বিয়ের মূল অনুষ্ঠানে প্রবেশ। গায়ে হলুদ। প্রথমে গ্রাম পঞ্চায়েতের অনুমতি নেওয়া। তারপর নায়কের পায়ে, সর্দার ও গ্রাম সভ্যদের গায়ে পায়ে, সস্ত্রীক পরিবারকে এবং শেষে কনেকে হলুদ মাখানো হয়। আর এর পরেই মেয়েরা গেয়ে ওঠে, ‘‘হিজুপে সাসাহঁ যযঞগে/ অনুঙ লজা আঃ/ জাবায়ঃ গে মেনাক দুলাইঞ।/ অত কুলিঞসুচারে দা মিন্এম,/ বুরুরে পলাশ বাহা,/ খুজুরি জিয়ালো আড়ি খুশিঞ।’’ অর্থাৎ, ‘‘সবাই গায়ে হলুদ দিই/ লজ্জা করিস না/ বর খুব ভাল হবে,/ ঘরের কাছে পুকুর ভরা জল/ পাহাড়ে পলাশ ফোটে/ বনের বাতাসে মন খুশি।’’
এ ভাবেই গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে মেয়েকে আশ্বাস দেওয়া হয়। এই অনুষ্ঠান শেষে হয় হাঁড়িয়া পান। তার পরই মাদলে পড়ে কাঠি, বেজে ওঠে বাঁশি। সেই সুর তালে মাতৃভাবনায় গেয়ে ওঠে গান: ‘‘চহার হড়মে হরেগেতে/ হরেগেতে রাকঞাপ এনা/ আলেম কুড়ি মোঞ্জ সেবেলা/ মেৎ দা জর কানা।’’ অর্থাৎ, ‘‘মুখে হলুদ গায়ে হলুদ/ হলুদ শরীর ঝিলমিল/ মেয়ে আমার সুখি হুক/ কাঁদতে যেন না হয়।’’

দা বাপলা (জল বিবাহ): দু’টি পুরুষ ও নারীর জীবনের মূল অভিষেক পর্বে প্রবেশের আগে জীবনের অপর নাম যে জল, সেই জলকে শ্রদ্ধা জানানোই এর মূল উদ্দেশ্য। কনে গ্রামে বরের উপস্থিতিতে এই অনুষ্ঠান হয় ষোলোটি পর্বে। এইগুলি হল: কনেঘরের গাছ তলায় বরের পৌঁছনো, সর্দারের কাছে জল বিবাহের সামাজিক অনুমতি, জলাধার খনন, জলাধার প্রতিষ্ঠা, জল সিঞ্চন, জল আহ্বান, জল অভিষেক, জল বরন, জল পূজা, জলকে নিমন্ত্রণ করে ঘরে তোলা, তেল মাখানো, জল শান্তি, জল আশীর্বাদ, জল মাঙ্গলিক ও জল অনুমতি।

জল বিবাহের অনুষ্ঠানের মাঝে একটি মানবিক গান রয়েছে। গানটি এইরকম, ‘‘দাকা গেচং জানাম আয়ো/ উঁ উনিঞ হারা আঃ/ তিনা দুলাড় তিনা সুহাগ/ তিনা দুলাড় তিনা সুহাগ।’’ যা বাংলা করলে দাঁড়ায়, ‘‘জল আমাদের আপন মা/ তার স্নেহে বেঁচে থাকা/ মন প্রাণের ভালোবাসা/ মন প্রাণের ভালোবাসা।’’ জাঁওয়ায় হিজুঃ (বরানুগমন): এই বরানুগমন পর্বে পনেরটি ক্রমপর্যায় পেরিয়ে আসতে হয়, যার কিছু অনুষ্ঠান বরের ঘরে, কিছু কনের ঘরে, কিছু উভয়েরই গ্রামে অনুষ্ঠিত হয়।
এখন এই ১৫ টি ধাপ হল: গায়ে হলুদ, জল বিবাহ, নিতবর বা নমত, বরের সাজ, বরযাত্রী বা সমাবেশ, বাজনার দল, মাতৃআজ্ঞা, বরসহ কনে গ্রামের পথে, কনে গ্রামে পৌঁছনো, নকল যুদ্ধে হাসি আনন্দ, গুড়জল, জামাতা বরণ, কনে বাড়িতে বরের প্রস্তুতি, আতপ চাল উৎসব ও কনে দৌওড়া।

মিৎ বাপলা (কনে ঘরে বিয়ের প্রথম অনুষ্ঠান): এ বার মুখোমুখি দুজন। ছাঁদনাতলায় বর ও কনে। বিবাহের এই পর্যায়টি ছটি ক্রমানুযায়ী হয়। এইগুলি হল, কনে সাজানো, দেবতার অনুমতি, দওৈড়া অনুষ্ঠান, মেয়ে থেকে কনে, কাজললতা ও ছামড়াতে কনে নিয়ে যাওয়ার জন্য সর্দারের অনুমতি।

সিন্দ্রদৈান তথা সিন্দুর দান (মূল বিবাহ অনুষ্ঠান): এখন সর্দার সহ বর ও কনে যাত্রী সবাই ছাঁদনাতলায় চলে আসেন। এই পর্যায়ে আটটি ক্রমে অনুষ্ঠানটি হয়। এইগুলি হল: কনে অভিসার, বিয়ের মুহূর্ত, বরকে বরণ কনেকে দিয়ে,কনেকে বরণ বরকে দিয়ে,সিঁদুর দান,ঘোমটা টানা,বর কনে দরজা দিয়ে বাইরে আসবে, এবং বরযাত্রীদের খাওয়ানো।
পৌড়ছৌ আদের (মাতৃ বা স্ত্রী আচার): এ বার স্ত্রী আচারের পালা। মেয়ের মা এতে মুখ্য ভূমিকা নিয়ে থাকে। এই পর্যায়ে আছে সাতটি ধাপ। যেমন, বর কনেকে বরণ করে ফিরিয়ে আনে মা, গুড়জল, আশীর্বাদ, ঘরে তোলা, জলঘটি, হাঁড়িয়া ও খাবার পরিবেশন এবং নাচ ও গান।

কনে বিদায় (বিদৈয় বেড়া): এটি বিয়ের পরের দিনের অনুষ্ঠান। এই পর্যায়ে আছে ৭ টি ক্রম। যেমন, প্রভাতি হাঁড়িয়া তথা মদ্যপান, বরযাত্রীদের সঙ্গে হাসি তামাশা, খাসি উৎসর্গ, আশীর্বাদ, দুপুরের খাওয়া, কনেযাত্রী এবং কনে বিদায়।
নাওয়া বাহু দারাম (বধূবরণ, প্রতিষ্ঠা ও কুমারী থেকে স্ত্রী হওয়ার ক্রম): বর কনে বরের ঘরে ফিরে এসেছে। এ বার বধূবরণ নিম্নলিখিত ৭টি ক্রমপর্যায়ে। যেমন,আপ্যায়ন কনে সহ কনে পক্ষীয়দের,বিশেষ ভাবে আপ্যায়ন করবে বরপক্ষ, বর কনের আশীর্বাদ, রাতের খাওয়া নাচ গান, সকালের মদ, দুপুরে খাওয়া এবং বর সহ কনের বাপের বাড়িতে
ফিরে আসা।

বধূ প্রতিষ্ঠা: কনে শ্বশুর ঘরে এক রাত এবং পরের দিন বিকাল পর্যন্ত থেকে ফের ফিরে যাবে বাপের বাড়িতে। সঙ্গে যাবে গাতেকুড়ৈ (কনের বান্ধবী)। তিনদিন পর ওই ঘটক আবার স্বামী স্ত্রীকে বরের গ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।
কুমারী থেকে স্ত্রী হওয়ার শেষ ক্রম: এটি সাঁওতালি বাপলার শেষ পর্যায় এই পর্যায়ে আছে দুটি ক্রম। ১) স্বামী-স্ত্রীকে বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে। ২) শ্রম অধিকার বা স্বামী স্ত্রীর মর্যাদা পাবে।

এই কুড়িটি ক্রমপর্যায়ে এই যে সাঁওতালি বিবাহ, তা তাঁদের প্রকৃতি নির্ভরতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এঁদের মূল্যবোধ, সারল্য, চারিত্রিক সততা এঁদের অমলিন আনন্দঘন জীবন উপহার দেয়। অভাবকে এঁরা পাত্তাই দেন না, যা সামগ্রিক মানসিকতা দিয়ে জয় করে নেন। গানের মধ্যেও থাকে সেই ইঙ্গিত:
‘‘নিত মেনা মা ধিননৈ বানুম
হররে মেনা এটেৎ জানুম
এনতে রিহঞ সাহাকাতে
লাহা হোয় গাতে সাতে।’’
এর অর্থ: ‘‘ক্ষণ ভঙ্গুর জীবন
তথাপি মানুষ সমস্যা সংকুল
চলতে হবে বাঁচার নেশা
এরই মাঝে সবার সাথে।’’ (শেষ)

লেখক গ্রন্থাগারিক, সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Santhali Wedding
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE