শুক্রবার সকালে খবরের কাগজ দিতে এসে হকার ভদ্রলোক আপন মনেই বলছিলেন, ‘‘খারাপ লোক রয়ে গেল, আর ভাল লোকটা চলে গেল!’’ মৃত্যু জীবনের অনেক কলুষই মুছে দেয়। তবু আমজনতার আক্ষেপ সঙ্গী করে চলে যেতে পারাটা, বিশেষ করে রাজনীতিকদের পক্ষে, শ্লাঘার বইকি।
অটলবিহারী বাজপেয়ী পরিণত বয়সেই প্রয়াত হয়েছেন। গত প্রায় এক দশক ধরে তিনি ছিলেন রুদ্ধবাক্, বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন। তবু তাঁর মৃত্যুতে জনজীবনে যে শূন্যতার বোধ তৈরি হল, সেটা নেতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতারই মাপকাঠি।
কিন্তু সেই সঙ্গে আর একটা জিনিসও মনে হচ্ছে। শাসকের যে ছবি আজ আমাদের চোখের সামনে, সেটাই বোধ হয় বাজপেয়ী-আমলের স্মৃতি আরও বেশি করে উস্কে দিল। মনে করিয়ে দিল, সে সময়টা আলাদা ছিল। অনেক বেশি উদার ছিল, সহনীয় ছিল।
অথচ অটলবিহারী বাজপেয়ীর যোগ্য উত্তরসূরি সাজতে কী মরিয়া চেষ্টা এখন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীর! সামনে লোকসভা ভোট এবং দলের অবস্থাটা আর ২০১৪-র মতো দেখাচ্ছে না বলেই বোধ হয়। কী জানি যদি নিজের জোরে সরকার গড়া না যায়। ফের হাত বাড়াতে হয় শরিকদের দিকে!
তাই বাজপেয়ীর মৃত্যুর পরে মোদী দাবি করেছেন, বাজপেয়ী ছিলেন তাঁর বাবার মতো। সংগঠন আর প্রশাসন কী ভাবে চালাতে হয়, সেটা বাজপেয়ীর কাছ থেকেই শিখেছেন তিনি। গুজরাতে সাড়ে তেরো বছর আর কেন্দ্রে সাড়ে চার বছরের মোদী-জমানার দিকে তাকালে অবশ্য তাঁকে ‘সুসন্তান’ বলা কঠিন। শিক্ষাটা যথাযথ হয়েছে কি না, তা নিয়েও সংশয় থেকেই যায়। কারণ বাজপেয়ী আর মোদীতে তো আসলে যোজন ফারাক। কী রাজনৈতিক দর্শনে, কী জীবনযাপনে।
রাজনীতির সিঁড়ি বেয়ে যখন ওঠা শুরু করেছেন মোদী, তখন তিনি ছিলেন, বাজপেয়ীর নয়, বিজেপির আর এক স্তম্ভ ‘লৌহপুরুষ’ লালকৃষ্ণ আডবাণীর অনুগামী। দল এবং সঙ্ঘ পরিবারের উপরে নিয়ন্ত্রণ যদি থাকত বাজপেয়ীর, তা হলে সেই ২০০২ সালেই, দাঙ্গার পরে, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে বিদায় নিতে হত মোদীকে। কিন্তু সেই রাশ তখন আডবাণীর হাতে। অতএব পানজিমে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটল মোদীকে অপসারণের সম্ভাবনার। আডবাণীর প্রচ্ছন্ন মদতে।
ভারতীয় রাজনীতির সেই ক্রান্তিকালে মোদীকে স্রেফ রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হল বাজপেয়ীকে। সাংবাদিক বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর মুখে এমন কথা শুনেই বাজপেয়ীর দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় মোদী বলেছিলেন, ‘‘হাম ভি ওহি কর রহে হ্যায়, সাহাব।’’ বাজপেয়ীকে বলতে হল, ‘‘আমার বিশ্বাস, নরেন্দ্রভাই সেটাই করবেন।’’ ২০০৪ সালে লোকসভা ভোটে হারের পর বাজপেয়ী বলার চেষ্টা করেছিলেন, এ জন্য গুজরাতের ঘটনাই দায়ী। দল মানেনি।
পরস্পরবিরোধী ধ্যানধারণার শরিকদের নিয়ে চলতে গিয়ে বার বার হোঁচট খেতে হয়েছে বাজপেয়ীকে। কিন্তু জোট সরকার চালানোর বাধ্যবাধকতার বাইরে গিয়েও বজ্রমুষ্টিতে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করা অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। তাঁর সরকারে আলোচনার অবকাশ ছিল, ভয়ের বাতাবরণ নয়। মন্ত্রিসভার বৈঠকে বর্ষীয়ান মন্ত্রীর তাঁর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতেন। তর্ক করতে পারতেন। দলে তো অনেক সময়ই অগ্রাহ্য হত তাঁর মত। এ দিক থেকে দেখলে বাজপেয়ী ছিলেন জওহরলাল নেহরুর গণতান্ত্রিক ভাবনার উত্তরসূরি।
যে বিশ্বাস তাঁকে খোদ নেহরুর সমালোচনা করার সাহস জুগিয়েছিল। সংসদে নেহরুর মুখের উপরে বলতে পেরেছিলেন, আপনি একই সঙ্গে চার্চিল এবং চেম্বারলিন। নেহরু পিঠ চাপড়ে বলেছিলেন, ভাল বলেছ। এ হেন বাজপেয়ী জনতা পার্টির আমলে বিদেশমন্ত্রী হয়ে সাউথ ব্লকে এসে দেখলেন, সেখানে নেহরুর যে ছবি ঝোলানো ছিল, সেটি আর নেই। ফিরিয়ে আনলেন সেই ছবি। গল্পটা বলে আক্ষেপ করেছিলেন বাজপেয়ী, ‘‘সেই গণতান্ত্রিক ভাবনা আজ কোথায়! এখন তো কেউ বিরুদ্ধে কিছু বললেই শত্রু বলে গণ্য করা হয়।’’ সেই আক্ষেপের পরে দেড় দশকের বেশি কেটে গিয়েছে। মোদী-জমানায় শত্রুসন্ধানের ভুলভুলাইয়ায় ক্রমশই আরও বেশি করে বন্দি হয়ে পড়েছে দেশ। প্রশ্নহীন আনুগত্যই আজ শাসকের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।
অতুলনীয় বাগ্মী ছিলেন বাজপেয়ী। একটা বাক্য বলার পরে দীর্ঘ বিরতি। ১৯৯৯-২০০০ সালে বেসরকারি টেলিভিশনের যুগ তখন সবে শুরু হয়েছে। ‘বাইট’ কাটতে গিয়ে মাথার ঘাম পায়ে পড়ত এডিটরদের। কিন্তু তার পরেই যে বাক্যটা আসত, তাতে কখনও হিরের দ্যুতি, কখনও ক্ষুরধার ব্যঙ্গ। নিজেকে নিয়ে পরিহাস করতেও দ্বিধা ছিল না। ১৯৯৬ সালে ১৩ দিনের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষে লোকসভায় আস্থা প্রস্তাবের উপরে তাঁর বক্তৃতা তো লোককথা হয়ে রয়েছে। সেখানেও গণতন্ত্রের কথাই বলেছিলেন বাজপেয়ী। ‘‘সত্তা কা তো খেল চলেগা। সরকার আয়েগি, জায়েগি। পার্টিয়া বনেগি, বিগড়েগি। লেকিন ইয়ে দেশ রহনা চাহিয়ে। ইস দেশ কা গণতন্ত্র অমর রহনা চাহিয়ে।’’
বক্তৃতার সুনাম রয়েছে নরেন্দ্রভাইয়েরও। কিন্তু সে যেন ঘরের লক্ষ্মী নয়, রুপোলি পর্দার সাজগোজ করা নায়িকা। তার হাসি মাপা, কান্না মাপা, হাততালির ক্ষণটিও পূর্বনির্ধারিত। সেই অঙ্ক-কষা ভাষণে রাষ্ট্রনীতির চিরাচরিত রীতিনীতি ভেঙে ফেলতে কসুর করেননি মোদী। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে সমালোচনা করেছেন পূর্বসূরি মনমোহন সিংহের সরকারের।
এমন কাণ্ড বাজপেয়ীর কাছে অভাবনীয় ছিল। রাষ্ট্রপুঞ্জে কাশ্মীর নিয়ে পাকিস্তানের আনা প্রস্তাবের উপর আলোচনায় ভারতের পক্ষ সমর্থন করতে বিরোধী দলনেতা বাজপেয়ীকে পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও। বিজেপিরই কেউ কেউ বলেছিল, নরসিংহ চাণক্য। যদি পাক প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়, তা হলে বলির পাঁঠা হবেন বাজপেয়ী। অটল শোনেননি। গণতন্ত্রের ব্যাপ্তিতে তাঁর বিশ্বাস ছিল।
আর সম্ভবত আপত্তি ছিল ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ রাজনীতিবিদ হতেও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy