Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪
Politics

রাহুল গাঁধী হিন্দু না অহিন্দু এই বিতর্ক কি জরুরি?

রাহুলকে ঔরঙ্গজেব আখ্যা দিয়ে মোদী মেরুকরণের রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছেন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষালরাহুলকে ঔরঙ্গজেব আখ্যা দিয়ে মোদী মেরুকরণের রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছেন। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

আশীর্বাদী: স্বামীনারায়ণ মন্দিরে প্রার্থনা রাহুল গাঁধীর। গুজরাতের বোতাডে। —ফাইল চিত্র।

আশীর্বাদী: স্বামীনারায়ণ মন্দিরে প্রার্থনা রাহুল গাঁধীর। গুজরাতের বোতাডে। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

রাহুল গাঁধী হিন্দু না অহিন্দু তা নিয়ে বিজেপির শীর্ষ নেতারা খুবই চিন্তিত। খোদ প্রধানমন্ত্রী তাঁকে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করেছেন উচ্চকিত কণ্ঠে। রাহুল গাঁধী পৈতেধারী হিন্দু এটা শোনার পর থেকেই বিচলিত দেখছি এই বিজেপি নেতাদের। আবার রাহুল এ কথাও জানিয়েছেন যে তিনি এক জন শিব ভক্ত। কী কাণ্ড? সোমনাথ মন্দিরে রাহুল গাঁধী গিয়েছেন এটাও মোটেই ভাল লাগছে না মোদী-অমিত শাহের। এ বার গুজরাত প্রচারের সময় রাহুল নাকি প্রায় কুড়িটা মন্দির পরিদর্শন করেছেন। মোদী নিজেই এত বেশি মন্দির যাননি এ বার।

ভোট প্রচারের সময় এত বার মন্দির যাওয়াটা রাহুল গাঁধীর দিক থেকেও উচিত কাজ না অনুচিত সে-ও এক অন্য প্রশ্ন। সেটা নিয়েও বিতর্ক হতে পারে। ভোটের ফলাফল কী হবে তা নিয়েও আমার কোনও ভবিষ্যদ্বাণী নেই। কিন্তু বিজেপি জিতুক, সেটা ছোট প্রশ্ন। ভোট এক জন জিতবে আর এক জন হারবে। সেটাই গণতন্ত্রের দস্তুর। কিন্তু তা বলে রাহুল গাঁধী হিন্দু না অহিন্দু এই বিতর্কটা কি জরুরি?

প্রথমত, হিন্দুধর্মে গোঁড়া মুসলমানদের মতো কাউকেই অহিন্দু ঘোষণা করা, হিন্দু ধর্ম থেকে এক জন ঘোষিত হিন্দুকে বের করে দেওয়া, এটা কিন্তু হিন্দু ধর্মের প্রথা নয়। ইসলামের মধ্যেও দার্শনিক ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা আছে তবু গোঁড়া হিন্দু মুসলমান তাদের ধর্মে আচার না মানলে মুসলমানকেও বিধর্মী ঘোষণা করে। একে বলা হয় TAK FIRISM। এই Tak Firism নিয়ে সুফি সম্প্রদায়ের সঙ্গে সুন্নিদেরও মতপার্থক্য আছে।

রাজীব যখন মারা যান তখন দীর্ঘ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া আমরা দেখেছিলাম টেলিভিশনের সৌজন্যে। তখন রাজীবের মরদেহে রাহুলকে পবিত্র ঘৃত মাখাতে দেখেছি আমরা। সদ্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফেরা রাহুল হাতে চন্দনকাঠ নিয়ে প্রয়াত বাবার মুখাগ্নি করেন। যে ভাবে রাহুল সমস্ত হিন্দু আচার নিষ্ঠাভরে জানেন তার পিছনে আর একটি বড় কারণ ছিলেন সনিয়া গাঁধী। সনিয়া নিজে সারা জীবন শাশুড়ির সঙ্গে থেকে হিন্দু শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানগুলো কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি নিজে ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলে কী হবে, বিবাহসূত্রে তিনি শুধু ভারতীয় নন, পুজোআচ্চাও করেন। হাতে তো ওঁর লালসুতোও দেখি।

রাজীব গাঁধী যখন প্রধানমন্ত্রী তখন ব্রিটিশ সাংবাদিক ইয়ান জ্যাক তাঁর সাক্ষাত্কার নেন। সেই সাক্ষাত্কারের কথা ইয়ান তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন। রাজীবকে ইয়ান জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁর ধর্ম নিয়ে। রাজীব তাঁকে বলেছিলেন যে তিনি নাস্তিক নন, কিন্তু তিনি গোঁড়া ধার্মিক প্রকৃতির মানুষও নন। ধর্ম জিনিসটা রাজীবের কাছে যতটা ‘রিচুয়ালিস্টিক’ তার চেয়ে বেশি ছিল ‘স্পিরিচুয়াল’। রাজীবের ভাষায়: ধর্মে নৈতিকতার বিষয়টি তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রাজীব ইয়ান জ্যাককে বলেন, স্ত্রী সনিয়া জন্মসূত্রে খ্রিস্টান। ঠাকুর্দা ছিলেন জন্মসূত্রে পার্সি। নেহরু হিন্দু হলেও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত। ভীষণ ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ছিলেন তিনি। নেহরু মৃত্যুর আগেই জানিয়েছিলেন যে তাঁর ইচ্ছা তাঁর অস্থিভস্ম গঙ্গার জলে ফেলা হোক। দেশের নানা প্রান্তে গঙ্গার জলে সেই অস্থিভস্ম ফেলা হয়েছিল চপার থেকে। সে ব্যাপারেও নেহরু বলেছিলেন যে, এই অস্থিভস্ম গঙ্গায় বিসর্জন কোনও ধর্মীয় আচার নয়। গঙ্গা ভারতীয় জীবনের সঙ্গে যুক্ত। যে জীবন অখণ্ড ভারতীয়ত্বর। যে জীবন সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে।

এ হেন নেহরু-রাজীবের পরিবারের ছেলে রাহুল যিনি বলছেন যে তিনি এক জন শিবভক্ত। পৈতেধারী শিবভক্ত, কিন্তু এই ধর্ম তার ব্যক্তিগত বিষয়।

হিন্দুধর্মে অন্য ধর্মের মতো এক জন দেবদেবী যেমন নেই, সে ভাবে এই হিন্দুধর্মে যে কেউ থাকতে পারেন। হিন্দুধর্মের মধ্যে ন্যায়-বৈশেষিক ও বেদান্ত দর্শন আছে, আবার চার্বাক, সাংখ্য ও বৌদ্ধদর্শনও আছে। বৌদ্ধদর্শনকে হিন্দুধর্মের ছাতার নীচে দেখতে অনেকেই রাজি নন, কিন্তু হিন্দুরা সকলকে নিয়েই চলতে পারেন। হিন্দু হওয়ার জন্য হলফনামায় স্বাক্ষর করতে হয় না। হিন্দু আচরণ না মেনেও হিন্দু হওয়া যায়। তাই রাহুল হিন্দু কি হিন্দু নন, এ কথাটা তোলাটাই অবান্তর।

রাহুলকে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে তুলনা করাও এক অস্বাভাবিক ঘটনা। ঔরঙ্গজেব কেমন ব্যক্তি ছিলেন, কেমন সম্রাট ছিলেন তা নিয়ে ভারতের জনসমাজে অনেক বিতর্ক আছে। কিন্তু সাধারণ ভাবে আমজনতার ধারণা, ঔরঙ্গজেব সাম্প্রদায়িক খলনায়ক। ঔরঙ্গজেব আখ্যা দিয়ে মোদী মেরুকরণের রাজনীতিকে উস্কে দিচ্ছেন। রাহুলের মন্দিরে যাওয়ার রাজনীতির পাল্টা কৌশল।

আমি অবশ্য মনে করি আধুনিক ভারত গঠনের স্বার্থে মন্দির-পর্যটন রাজনীতিও বন্ধ করে দেওয়া উচিত। রাহুল কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাইছেন, তিনি নিজেই এই রাজনীতিতে খুব অভ্যস্ত ছিলেন না। বিজেপির রাজনীতি রাহুলকেও বাধ্য করেছে এই পাল্টা রাজনীতির তাস খেলতে। তবে এই রাজনীতি যত কম হয় ততই ভাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE