লার্জার দ্যান লাইফ— চুম্বকে এই হলেন বঙ্গজীবনে দিতিপ্রিয়া রায়।
কখনও কখনও জীবন তার পরিধি ছাড়িয়ে অনেকটা বিস্তৃত হয়ে পড়ে। তখন সেই জীবনকে জীবনের চেয়েও বৃহত্তর মনে হয়। শব্দবন্ধটা বাঙালির চেনা। কিন্তু তা ব্যবহারের লাগসই চরিত্র ইদানীং বাঙালি পায়নি। ‘ইদানীং’ শব্দটা থমকে গেল ‘রানি রাসমণি’র চৌকাঠে এসে। নাকি দিতিপ্রিয়ার দরজায় এসে। যাঁর নাম তাঁর ছায়াশরীরকে ছাড়িয়ে খানিক বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলা মেগা সিরিয়ালের নামভূমিকায় অভিনয় করে এক সদ্য কৈশোর-উত্তীর্ণা এখন বাঙালির গেরস্থালির অঙ্গ। ড্রইংরুমের এলইডি স্ক্রিনে দর্শকের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া অস্তিত্ব।
এমন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র বহুকাল দেখেনি বাঙালি।
দিতিপ্রিয়া অবশ্য ‘রাসমণি’ হয়ে ওঠার আগেই ছোট এবং বড়পর্দায় এসেছিলেন। টেলি সিরিজ ‘ব্যোমকেশ’-এর ‘মগ্নমৈনাক’ পর্বে ‘চিংড়ি’র ভূমিকায় বা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ছবিতে তাঁকে দেখেছিলেন দর্শক। কিন্তু ‘করুণাময়ী রানি রাসমণি’ থেকে এই কিশোরীর ছায়া পড়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে! রানি রাসমণির ভূমিকায় দিতিপ্রিয়ার ঠোঁটে ‘এয়েচো’ হয়ে গিয়েছে বাঙালির বৃহত্তর প্রকাশভঙ্গিমা। যে মেয়েকে বলা হয়েছিল মাস তিনেক অভিনয় করলেই চলবে, সেই কন্যাকেই পার করাতে হল মেগা সিরিয়ালের তিন-তিনটি বছর। কিশোরী রাজবধূ থেকে প্রৌঢ়া ব্যক্তিত্বময়ী বিধবার ভূমিকা পর্যন্ত দিতিপ্রিয়া টেনে নিয়ে গেলেন রানি রাসমণিকে। সঙ্গে টেনে নিয়ে গেলেন বাঙালিকেও।
রানি রাসমণি সংক্রান্ত স্ক্রিন-স্মৃতি বঙ্গজীবনে আটকে ছিল মলিনাদেবীর কল্পে। তা-ও উপযুক্ত প্রিন্টের অভাবে ১৯৫৫ সালের কালীপ্রসাদ ঘোষ পরিচালিত ‘রাণী রাসমণী’ দেখার সুযোগ বেশ কয়েক প্রজন্মের বাঙালির ঘটেনি। ফলে দিতিপ্রিয়ার ‘দায়’ ছিল দু’টি। প্রথমত, রাসমণি সম্পর্কে অজ্ঞ বাঙালির সামনে এক মহিয়সীকে সম্পূর্ণ নতুন করে দাঁড় করানো। দুই, যাঁরা পুরনো ছবি দেখেছেন, তাঁদেরও তৃপ্ত করা।
দেখা গেল, সে দায় তিনি কতটা সফল ভাবে সামলেছেন বা কতটা পারেননি, সেই প্রশ্নটাই উঠল না! কারণ, দিতিপ্রিয়ার ‘রাসমণি’ একেবারেই আনকোরা অভিজ্ঞতা হয়ে দেখা দিল বাঙালির কাছে। উজ্জ্বল কিশোরী ম্যাজিকের মতো শুভ্রবসনা ‘রানিমা’-য় পরিণত হয়ে গেলেন। বাঙালি হাঁ করে দেখল, দেখল এবং দেখতেই থাকল। এই বিবর্তনকে চিত্রনাট্য, মেকআপ, সিরিয়ালের পর্ব বা পর্বান্তর দিয়ে মাপা যাবে না।
পারিবারিক কূটকচাল, বহুবিবাহ-বহুপ্রণয়ে উথালপাথাল সিরিয়াল জগতে ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’ আদ্যন্ত ব্যতিক্রম। এবং এ শুধু এক নারীর সংগ্রামের কাহিনিও নয়। যেখানে প্রথম মহিলা চিকিৎসক কাদম্বরী গঙ্গোপাধ্যায়ের বায়োপিক টিআরপি না পেয়ে বন্ধ হয়ে যায় বা অঘটন ঘটন পটিয়সী নায়িকা সাইকেল চালাতে না জানলেও বিনা প্রশিক্ষণে বিমান চালিয়ে টিআরপি কুড়িয়ে আনেন, তখন ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা সামাজিক-রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক আখ্যান বিজড়িত কাহিনির তিন বছর পার করা বিস্ময়কর তো বটেই!
সেই বিস্ময়ের সঙ্গে পরতে পরতে জড়িয়ে দিতিপ্রিয়া। তিনি কি শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতা থেকে উঠা আসা একটি চরিত্র? নাহ্! তিনি কি শুধুই নিজের বয়সকে অতিক্রম করে প্রৌঢ়া রানির ভূমিকায় অভিনয়ে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন মাত্র? নাহ্, তা-ও নয়। দিতিপ্রিয়ার ম্যাজিক আসলে অন্যত্র। দিতিপ্রিয়া ‘পাশের বাড়ির মেয়ে’ নন। তিনি বাঙালির ‘নিজের বাড়ির মেয়ে’। ‘করুণাময়ী রাণী রাসমণি’-র দর্শক অনুভব করেন, তাঁর পাশে বসে রয়েছেন রানিমা। সাদা থান-চাদর পরিহিতা, চুলে অল্প পাক ধরা মেয়েটি। তাঁর রাজপাট, তাঁর আধ্যাত্ম, তাঁর মন্দির গড়ে সমকালীন রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ সমাজের সামনে প্রতিস্পর্ধার স্তম্ভ স্থাপনের চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায় তাঁর ‘ঘরোয়া’ উপস্থিতি। যা ‘মহিয়সী’ হয়ে ওঠার চেয়েও কঠিন। দিতিপ্রিয়া প্রমাণ করেছেন, ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্রও বহমান জীবনের খাপে নিজেকে মেলে দিতে পারে।
২০২০ সাল সারা পৃথিবীর কাছেই এক দুর্বহ বছর। বাঙালির এমনিতেই ফিকে জীবনে তা আরও বেশি নীরক্ত হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন এক সময়ে বাঙালিকে একাত্ম রেখেছেন তিনি। উনিশ শতকের ‘সেই সময়’ এখনকার আম-বাঙালির বড় অংশের কাছেই অজানা জগৎ। কিন্তু অষ্টাদশী কিশোরী নিজেকে গলিয়ে দেননি ‘সেই সময়’-এর খাপে। বরং ছাপোষা বাঙালির দাওয়ায় নিয়ে এসেছেন দুঃসময়কে পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। সেখানেই তিনি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। জীবনের চেয়েও বড়। বঙ্গজীবনের অঙ্গ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy