বয়স তখন তিয়াত্তর। বাপুর সঙ্গে পুণের কাছে আগা খান প্রাসাদে অন্তরিন কস্তুরবা গাঁধী। বহু বছর পর মোহনদাস আবার কস্তুরবাকে পড়াশুনা শেখাতে উদ্যোগী হয়েছেন। তরুণ বয়সে স্ত্রীকে অক্ষর পরিচয় করাতে উদ্যোগী হতেন— কস্তুরের ঘোর অনিচ্ছা। মোহনদাসের অধ্যবসায় ভেসে যেত মিলনবাসনায়। এখন স্মৃতিশক্তি আর আগের মতো নেই। স্লেেট লিখে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। একদা নিরক্ষর তরুণী কিছুটা গুজরাতি, ইংরেজি লিখতে পড়তে শিখেছেন এত দিনে। বাপুকে বলেছিলেন, আমার একটা নোটবুক চাই, তাতে লিখব। নানা সমস্যার চিন্তায় গাঁধীর সে দিন মেজাজ উত্তপ্ত। বললেন, আগে ঠিক করে লিখতে শেখো, তার পর নোটবুক পাবে। ক্ষুব্ধ কস্তুরবা নিজের স্লেটখানিও ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, আমার লেখাপড়া শেষ। পরে বাপু নোটবই আনিয়ে দিয়েছিলেন, কস্তুরবা নেননি। ১৯৪৪ সালে অন্তরিন অবস্থায় চলে যান কস্তুরবা। স্ত্রীর মৃত্যুদিন পর্যন্ত খাতাটি কাছে রেখে ছিলেন গাঁধীজি, ভুলতে পারেননি সেই আহত চাহনি। সামান্য ঘটনা। এমন কত অভিমান তরঙ্গ সংসারে ওঠে আর ভেঙে যায়। ওই বয়সে খাতায় কতই বা লিখতেন কস্তুরবা? তবু, পঁচাত্তর বছর আগে চলে যাওয়া এই অসামান্যা নারীর কথা ভেবে মনে হয়, এমন কত না-পাওয়া নোটখাতার অভাবে নারীর জীবন পরিণত হয় অগ্রন্থিত মৌখিক ইতিহাসে।
ভারতীয় রাজনীতিতে, জনমানসে গাঁধীর প্রভাব যত বেড়েছে, সময় এগিয়েছে, কস্তুর পরিণত হয়েছেন কস্তুরবা এবং পরিশেষে বা-তে। তাঁর নিজস্ব সত্তা লীন হয়ে গিয়েছে গাঁধীর সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়ায়। ১৮৯৭ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত তিন দশকের বেশি জুড়ে যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ভারতে অসহযোগ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, বহু বার কারাবরণ করেছেন, লিখেছেন জাতির প্রতি বার্তা, এমনকি বিপুল জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন ১৯৪২ সালে গাঁধী গ্রেফতার হওয়ার পর, তাঁকে গাঁধী জীবনীকাররা সুশীল শান্ত পতির অনুগমনকারিণী ‘বা’তে পরিণত করে রেখেছেন। সুবিচার কি গাঁধীও করেছেন? তাঁর নিজের লেখায় যতটা এসেছে নিজের সিদ্ধান্ত, অনুশোচনা, নিজের মনোভাবের বিশ্লেষণ, ততটাই উহ্য থেকেছে কস্তুরবার মনের কথাগুলি।
কেমন ছিল কস্তুরবার ভাবনা? কী ভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন তিনি? সাত বছর বয়সে বিবাহ। ১৫ বছরে প্রথম বার মা হওয়া। সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যুশোক। তখনও কস্তুরবার বাইরের জগৎ ছিল না। স্কুলপড়ুয়া স্বামীর সত্য নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা আর কামনাবাসনার উচ্ছ্বাস, তার সঙ্গে নানা সন্দেহে বিপর্যস্ত মন। স্বামীর বিরহ ছিল জীবনের অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ। দেশান্তরি হলে কবে ফিরবেন জানা নেই। অহিংসার সঙ্গে আলিঙ্গন করেছেন স্বেচ্ছাদারিদ্রকে। ডারবান যাত্রায় জাহাজে পুরোটা সময় গাঁধী স্ত্রীপুত্রদের ইউরোপীয় কেতা, চলনবলন শেখালেন। শেষে বর্ণবিদ্বেষী জনতার হিংস্র আক্রমণের ভয়ে জাহাজ আটকানো হল। তাও শেষ রক্ষা হল না, পথে আক্রান্ত হলেন গাঁধী। বন্ধুর বাড়ি স্ত্রীপুত্র-সহ আশ্রয় নিলেন, ঘিরে থাকল জনতা। জোহানেসবার্গের বড় বাড়িতে সবে গুছিয়ে বসেছেন, ভারতীয়দের কলোনিতে হানা দিল বিউবোনিক প্লেগের মহামারি। গাঁধী কিছু বলার আগেই কস্তুরবা যেতে চাইলেন প্লেগ-আক্রান্তদের কাছে, সেবার জন্য। গাঁধী স্ত্রীকে বুঝিয়েসুজিয়ে পাঠান, ভারতীয় পরিবারগুলির কাছে গিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা বোঝাতে। সেই প্রথম কস্তুরবার অন্য পরিমণ্ডলে প্রবেশ। যেন এক নতুন মানুষ। পতি-অনুগামিনী নন, নিজের বিশ্বাসের শক্তিতেই কস্তুরবার জনসেবায় প্রথম অংশগ্রহণ।