Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ১

পিএফ-এর টাকা শেয়ার বাজারে কেন

দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার সঙ্গে সুযোগসন্ধানী শিল্পপতির বার বার একটা অশুভ মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই আশঙ্কা হয়, সাধারণ মধ্যবিত্তের সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় শেয়ার বাজারের মাধ্যমে ভুল জায়গায় চলে গিয়ে নয়ছয় হয়ে যাবে না তো?কে ন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের একটা অংশ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হবে। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বান্দারু দত্তাত্রেয় জানিয়েছেন, এ বছর প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্তৃপক্ষ যে টাকাটা নতুন করে বিনিয়োগ করবে, জুলাই মাসে তার এক শতাংশ লগ্নি করা হবে দেশের শেয়ার বাজারে।

অভিরূপ সরকার
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০১৫ ০০:২৯
Share: Save:

কে ন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে সরকারি কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের একটা অংশ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা হবে। কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী বান্দারু দত্তাত্রেয় জানিয়েছেন, এ বছর প্রভিডেন্ট ফান্ড কর্তৃপক্ষ যে টাকাটা নতুন করে বিনিয়োগ করবে, জুলাই মাসে তার এক শতাংশ লগ্নি করা হবে দেশের শেয়ার বাজারে। ক্রমে এই এক শতাংশটা বাড়িয়ে চলতি অর্থবর্ষে, অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে, পাঁচ শতাংশ করা হবে। সরকারের লক্ষ্য, আগামী কয়েক বছরের মধ্যে শেয়ার বাজারে লগ্নির অংশটা বাড়িয়ে পনেরো শতাংশে নিয়ে যাওয়া। শতাংশটা সেখানেই থেমে থাকবে কি না আমরা জানি না। এত দিন সরকারি ও কিছু অতি-নিরাপদ বেসরকারি ঋণপত্রে প্রভিডেন্ট ফান্ডের লগ্নি সীমাবদ্ধ থাকত। নতুন নীতির ফলে প্রভিডেন্ট ফান্ড ভোক্তাদের ঝুঁকির মাত্রা বাড়বে।

নতুন নীতির সপক্ষে সরাসরি দু’টো যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। প্রথমত বলা হচ্ছে, ভাল শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করতে পারলে প্রভিডেন্ট ফান্ড লগ্নির ওপর লাভের অঙ্কটা বাড়বে, কারণ অতীতে দেখা গেছে সরকারি বা বেসরকারি ঋণপত্রের তুলনায় শেয়ার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের গড় মুনাফার হার অনেক বেশি। অর্থাৎ সরকার বলছে, প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে খাটলে অধিকতর লাভের মধ্য দিয়ে আখেরে ভোক্তাদেরই উপকার হবে। দ্বিতীয় যুক্তি, প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপুল টাকা শেয়ার বাজারের মাধ্যমে কোম্পানিদের হাতে পৌঁছে গেলে বিনিয়োগের জন্য আর টাকার অভাব হবে না। এখন প্রতি বছর গড়ে প্রভিডেন্ট ফান্ড ম্যানেজাররা এক লক্ষ কোটি টাকা নতুন লগ্নি করেন। বলা হচ্ছে, এর একাংশ শিল্পপতিদের হাতে পৌঁছলে বিনিয়োগ, শিল্পায়ন, কর্মসংস্থান সবই গতি পাবে। এ ছাড়া শেয়ার বাজারে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা লগ্নি করার পিছনে সরকারের একটা স্বার্থ আছে। বর্তমান সরকার পরিকল্পনা করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির কিছুটা বিলগ্নীকরণ করে, অর্থাৎ বাজারে তাদের শেয়ার বিক্রি করে একটা মোটা টাকা ঘরে তুলবে। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা বাজারে ঢুকলে শেয়ার বিক্রি করতে সরকারের সুবিধে হবে।

খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, সরকারি যুক্তিতে বিস্তর ফাঁক আছে। শেয়ার বাজারে দীর্ঘমেয়াদি গড় লাভের হার সরকারি বা বেসরকারি ঋণপত্রের হারের তুলনায় খানিকটা বেশি, ঠিকই। কিন্তু শেয়ার বাজারের বিনিয়োগ যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ, যেহেতু পরস্পর অসম্পৃক্ত নানা রকমের শেয়ার ঝুলিতে রেখেও এই ঝুঁকি সম্পূর্ণ দূর করা যায় না, তাই ঝুঁকিহীন ঋণপত্রের লাভের হারের সঙ্গে শেয়ার বাজারে প্রত্যাশিত লাভের হােরর পাইকারি তুলনা অনুচিত। তুলনা করতে পারেন একমাত্র তিনি যাঁর টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু সে ক্ষেত্রে ঝুঁকিহীন ঋণপত্রের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারের তুলনাটি হবে একান্তই ব্যক্তিনির্ভর। যাঁরা ঝুঁকি নিতে ভালবাসেন, তাঁরা শেয়ারে বিনিয়োগ পছন্দ করবেন। যাঁদের পছন্দ নিরাপদ বিনিয়োগ, তাঁরা শেয়ার বাজারের ধার মাড়াবেন না। সরকারের উচিত ছিল প্রভিডেন্ট ফান্ডের ভোক্তাদের হাতে পছন্দ করার ক্ষমতাটা ছেড়ে দেওয়া, যে ক্ষমতাবলে ভোক্তা ঠিক করতে পারবেন তাঁর সঞ্চয় কতটা শেয়ার বাজারে যাবে, বা আদৌ যাবে কি না। ভোক্তাদের হাতে এই ধরনের একটা ক্ষমতা দেওয়ার কথা নতুন প্রভিডেন্ট ফান্ড প্রকল্পে বলা হয়েছিল, এখন আর তার উল্লেখ দেখছি না।

শেয়ার বাজারে প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ঢুকলেই শিল্পে পরিকাঠামোয় পরিষেবায় বিনিয়োগ হু-হু করে বেড়ে যাবে এমন মনে করারও তেমন কারণ নেই। বর্তমানে আমাদের দেশে শুধু নয়, বস্তুত পৃথিবীর কোথাওই তেমন বিনিয়োগ হচ্ছে না। কিন্তু বিনিয়োগকারীদের হাতে টাকা নেই বলে বিনিয়োগ হচ্ছে না, এটা জোর দিয়ে বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে, এখনও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা হতাশাপীড়িত দৃষ্টিভঙ্গি অধিষ্ঠান করছে। মূলত এই মন্দাগ্রস্ত প্রত্যাশার ফলেই বিনিয়োগ হচ্ছে না। এর সঙ্গে বিনিয়োগ-ভাণ্ডারের ঘাটতির তেমন সম্পর্ক নেই।

কিন্তু তা যদি থাকতও, তা হলেও কি শেয়ার বাজারে টাকা ঢুকে রাতারাতি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দিতে পারত? নানা কারণে আজকাল দেশের শেয়ার বাজারকে মাঝে মাঝেই চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেখি। কিন্তু তার ফলে প্রকৃত বিনিয়োগ এক পয়সাও বাড়ে কি? আসলে শেয়ার বাজারে বাড়তি টাকা ঢুকলে সেই টাকার সিংহভাগ খরচ হয় পুরোনো নামী কোম্পানির শেয়ার কেনাবেচায়। এবং অবশ্যই ফাটকা খেলায়। নতুন অনামী কোম্পানির শেয়ার, যা বিক্রি হলে নতুন বিনিয়োগকারীর হাতে টাকা আসতে পারত, হয়তো বিনিয়োগও খানিকটা বাড়তে পারত, কালেভদ্রে বিক্রি হয়। ফলে শেয়ার বাজারে টাকা ঢুকলেও নতুন বিনিয়োগ তেমন বাড়তে পারে না।

শেয়ার বাজারের প্রবক্তারা অবশ্য বলেন, পুরনো শেয়ারের কেনাবেচা বাড়লে নতুন শেয়ারের চাহিদা বাড়ে, কারণ ক্রেতা ভাবেন পুরনো শেয়ার যখন সহজে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে তখন নতুন যে শেয়ারটি তিনি কেনার কথা ভাবছেন দরকার পড়লে সেটিও সহজে বিক্রি করা যাবে। এটা নেহাতই তাত্ত্বিক যুক্তি। নামী কোম্পানির পুরনো শেয়ার বেশি কেনাবেচা হচ্ছে বলে অনামা কোম্পানির নতুন শেয়ার বাজারে বেশি বিক্রি হবে, এ ধারণার বাস্তব ভিত্তি নেই।

তা হলে কার স্বার্থে প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে ঢুকছে? ভোক্তাদের স্বার্থে নয়, উন্নয়নের স্বার্থেও নয়। বস্তুত, প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপুল টাকা শেয়ার বাজারে ঢুকলে দ্ব্যর্থহীন ভাবে লাভবান হবেন হাতে-গোনা কয়েক জন অতি সম্পদশালী শিল্পপতি, বাজারে যাঁদের কোম্পানির শেয়ার সব থেকে বেশি কেনাবেচা হয়। বাজারে বাড়তি টাকা ঢুকলে রাতারাতি এই সব শেয়ারের চাহিদা ও দাম বেড়ে যাবে। ফলে নিজস্ব কোম্পানির যে সব শেয়ার এঁদের নিজেদের হাতে আছে তারও রাতারাতি মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। কৃত্রিম ভাবে বৃদ্ধি পাবে এঁদের কোম্পানি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্য। এই মূল্যবৃদ্ধিকে কৃত্রিম বলছি, কারণ এর পিছনে উৎপাদন বৃদ্ধি নেই, বিক্রয় বৃদ্ধি নেই, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি নেই। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপুল অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এই কতিপয় অতি বিত্তশালী শিল্পপতির প্রভাবে। মোদ্দা কথাটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, হাতে-গোনা কয়েক জন অতি বিত্তশালী শিল্পপতিকে আরও বিত্তশালী করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের সারা জীবনের সঞ্চয়কে শেয়ার বাজারের অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে।

এখানে সমস্যার শেষ নয়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে খাটানোর মানে হল, একটা বিপুল পরিমাণ অর্থ সরকারের ইচ্ছাধীন থাকা, যে অর্থ সরকার নিজের পছন্দের কোম্পানিগুলিতে বিনিয়োগ করতে পারবে। কিন্তু সরকার তো আর কোনও নৈর্ব্যক্তিক সত্তা নয়, এর মাথায় যাঁরা থাকেন তাঁরা রাজনীতির লোক। আমরা দেখেছি, দলনির্বিশেষে এঁদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এটাও দেখেছি, দুর্নীতিগ্রস্ত নেতার সঙ্গে সুযোগসন্ধানী শিল্পপতির বার বার একটা অশুভ মেলবন্ধন ঘটেছে। তাই আশঙ্কা হয়, সাধারণ মধ্যবিত্তের সারা জীবনের কষ্টার্জিত সঞ্চয় শেয়ার বাজারের মাধ্যমে ভুল জায়গায় চলে গিয়ে নয়ছয় হয়ে যাবে না তো? সরকার অবশ্য নিজে সরাসরি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করছে না। বিনিয়োগ করার জন্য রয়েছেন স্বাধীন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল থেকে নির্দেশ এলে এঁরা কতটা স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারবেন, সন্দেহ আছে।

নতুন প্রভিডেন্ট ফান্ড নীতির মধ্যে একটা গভীর স্ববিরোধ আছে। এক দিকে সরকার বাজার অর্থনীতির ভাষায় বিলগ্নীকরণের কথা বলছে, অন্য দিকে আবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিপুল অর্থ নিয়ে খোলা শেয়ার বাজারে সরকারি হস্তক্ষেপের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে। আর শুধু ভোক্তাদের স্বার্থ দেখা হলে এখনই শেয়ার বাজারে টাকা খাটানোর দরকার ছিল না। গত অর্থবর্ষে প্রভিডেন্ট ফান্ডের বিনিয়োগের ওপর লাভের হার ছিল ৯.২২%। ভোক্তারা সুদ পেয়েছিলেন ৮.৭৫%। কাজেই প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদ দিতে গিয়ে সরকার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলেন, এমনটা বলা যাবে না। পক্ষান্তরে, ভোক্তাদের দিক থেকে দেখলে, করহীন ৮.৭৫% সুদের হার মোটেই কম নয়। অতএব প্রশ্ন উঠবেই, কার স্বার্থে চালু ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা হল?

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউট, কলকাতায় অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE