Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

কে আছে শিশুর পাশে

প্রথম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ শিশু স্কুলছুট হয় এ রাজ্যে।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৯ মার্চ ২০১৯ ০০:০৪
Share: Save:

ইতিহাস ক্লাসে ‘প্রজেক্ট’ দেওয়া হয়েছে, ‘আমার পরিবার’। দিদিমণি বলেছেন, বাবা-মায়ের সঙ্গে নিজের ছবি যেন আনে পড়ুয়ারা। একটি ছেলে ছবি জমা দিল, তাতে বাবার মুখের অংশটা ছেঁড়া। কেন ছিঁড়লে? খুদে ছাত্রের নালিশ, বাবা মদ খায়, গায়ে হাত তোলে। সে চায় না তার পাশে ওই লোকটার ছবি থাক।

শিশুর জীবনে এমনই ক্ষত তৈরি করছে মদ্যপের উন্মত্ততা। দারিদ্র, শিশুশ্রম, ভিনরাজ্যে কাজ, এমন কঠিন সব বাধা যারা পেরোচ্ছে, সেই শিশুরাও আটকে যাচ্ছে নেশা-সর্বস্বতায়। সেই সত্যটা কাঁটার মতো বিঁধল কুমারীগ্রাম প্রাথমিক স্কুলের এক কন্যাকে দেখে। ছবির মতো স্কুলটি দাঁড়িয়ে নেদাবহড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের গা ঘেঁষে। ক’দিন আগেও ঝাড়গ্রামের এই এলাকা ছিল মাওবাদীদের দুর্গ। তিন জন স্কুলশিক্ষক খুন হয়েছেন। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে কুমারীগ্রাম যাওয়ার শালবন-চেরা পিচ রাস্তায় শিক্ষকদের মোটরবাইক পড়ে যায় দাঁতাল হাতির মুখে। সেই স্কুলের মেয়ে নির্ভুল বানানে তরতরিয়ে লিখে যাচ্ছে!

প্রান্তিকতা তো শুধু ওর মানচিত্রে নয়, ইতিহাসেও। ও যে পরিবারের মেয়ে (পদবি ‘বাগাল’) দশ-বারো বছর আগেও তাঁরা ছিলেন ‘ভাতুয়া’। বড় চাষির গরু-ছাগলের বাগালি করতেন, জমিতে মুনিশ খাটতেন স্রেফ ভাতের বিনিময়ে। বড় জোর কার্তিকে ক’বস্তা ধান, কাপড়। প্রায়-দাসত্ব থেকে এখন ‘ভাতুয়া’-রা খেতমজুর, দিনমজুর। ঠিকাচাষ করে কেউ-বা একটু সচ্ছল। এই মেয়ের জেঠতুতো দাদা কলেজে পড়ে। তুইও পড়বি তো কলেজে? বালিকা চুপ। তার তিন দিদিই ক্লাস নাইনে পড়া ছেড়েছে। কেন? প্রধান শিক্ষক বললেন, ‘‘আসলে ওর বাবা...’’

এ রাজ্যে এমন গ্রাম পঞ্চায়েত নেই, যেখানে মেয়েরা একজোট হয়ে চোলাইয়ের ভাটি না ভেঙেছে। জড়ো হওয়ার মঞ্চটা সাধারণত স্বনির্ভর গোষ্ঠী, আর গোষ্ঠীর মেয়েরাই মিড ডে মিল রান্না করেন। তাই স্কুলের সঙ্গে মদ-বিরোধিতার একটা সম্পর্ক রয়েইছে। কুমারীগ্রাম স্কুলের দুই রন্ধনকর্মীও গত বছর ভাটি ভেঙেছিলেন। তিন মাস বন্ধ ছিল। তার পর? ঘরে-বাইরে মারধরের মুখে আর রুখে দাঁড়াতে পারেননি মেয়েরা। তবে পুরুলিয়ার বিন্দুইডিহি প্রাইমারি স্কুলের রন্ধনকর্মী সবিতা বাউড়ি বেশ দাপুটে। তিন বছর আগে যে সব ভাটি ভেঙেছিলেন, সে আর খুলতে দেননি। তাতে কী, পাশের গ্রাম থেকে খেয়ে আসছে পুরুষেরা।

মায়েরা যত দূর যেতে পারে মদ ঠেকাতে, তত দূর গিয়ে থমকে যেতে চায় শিশুদের পড়াশোনা। ‘‘কোন পরিবারে মদের সমস্যা, শিশুকে দেখেই ধরতে পারি’’, বললেন প্রধান শিক্ষক সৌম্যেন্দ্রনাথ মণ্ডল। নিতুড়িয়া চক্রের বিন্দুইডিহি স্কুলটি আদিবাসী এলাকায়, মেয়ে-পুরুষ সকলেই রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন। তবু যে পরিবারে মত্ততা নেই, সেখানে স্কুলের নির্দেশ মানার চেষ্টা থাকে। শিশুদের মধ্যে শিক্ষকের কথা শোনার প্রবণতা থাকে। যে ঘরে মদের প্রকোপ, তার শিশুরা অপশব্দ ব্যবহার করে বেশি, বকলেও গায়ে মাখে না। ‘‘এদের মনে রাখার ক্ষমতাও কম’’, বললেন এক শিক্ষক।

শহরতলি থেকে প্রান্তিক গ্রাম, সর্বত্র শিক্ষাহানির নকশা তৈরি করছে মদের নেশা। মাতালের তাণ্ডবে বিপর্যস্ত মা সন্তানদের নিয়ে চলে যান বাপের বাড়িতে। সন্তানের স্কুলে আসা বন্ধ থাকে, নইলে বহু দূর থেকে যাতায়াত করতে হয়। আবার, মত্ততার অশান্তি শুরু হয় সন্ধ্যায়, যখন পড়ার সময়। শিশুদের পিছিয়ে পড়তে দেখলে মিটিং ডাকে স্কুল। ‘‘মায়েরা কাজ কামাই করেও আসে। আর যে বাপেরা মদ খায়, তারা ঘরে বসে থাকলেও আসে না’’, বললেন সৌম্যেন্দ্রনাথবাবু।

‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’ দলের নেতা যোগেন্দ্র যাদব মনে করেন, বেকারের জন্য চাকরি, চাষির জন্য ফসলের দাম পাওয়ার দাবির সমান মান্যতা দিতে হবে মদ নিষিদ্ধ করার দাবিকে। তিনটিই উঠে এসেছে জীবন ছারখার হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা থেকে। ১৯৯২ সালে অন্ধ্রপ্রদেশের মেয়েদের মদ বিরোধিতা ভারতের নারী আন্দোলনের মাইল ফলক। ২০১৯ জানুয়ারিতে একই দাবিতে কর্নাটকের নানা গ্রামের চার হাজার মহিলা বারো দিন হেঁটে জড়ো হন বেঙ্গালুরুতে।

শিশুরাও কি ওই যন্ত্রণার অংশীদার নয়? শিক্ষার অধিকার আইনের দশ বছর হয়েছে। অথচ স্কুলে আসা-যাওয়া করেও কিছু শিখছে না, এমন শিশু পঁচিশ-ত্রিশ শতাংশ। শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ তো আছেই। আবার লেখাপড়া শেখানোর কাজে প্রাণ ঢেলে দিচ্ছেন, সরকারি স্কুলে এমন শিক্ষকও আছেন। জেলায় জেলায় সেই শিক্ষকদের মদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। বীরভূমের মলয় ভট্টাচার্য, দক্ষিণ দিনাজপুরের পবিত্র মোহান্ত, সুন্দরবনের বালিদ্বীপের সুকুমার পাড়িয়া প্রচার করছেন, মিটিং করছেন গ্রামবাসীদের জড়ো করে। ফলও হয়েছে। মায়েরা সংগঠিত হয়েছেন, শিশুরা ক্লাসে আসছে নিয়মিত, শিখছেও বেশি।

এই মুহূর্তে এমন কিছু গল্প ছাড়া হাতে কিছু নেই। কারণ, স্কুলছুটের হার বা পরীক্ষায় মন্দ ফলের সঙ্গে নেশাসক্তির সম্পর্ক তেমন জানা নেই। মত্ততার সঙ্গে গার্হস্থ্য হিংসার, তার সঙ্গে শিশুপুষ্টির যোগ নিয়ে কাজ হয়েছে। আইআইটি কানপুর-এর একটি গবেষণা বলছে, মায়ের উপর অত্যাচার শিশুর দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি (‘স্টান্টিং’) বাড়ায়। শিক্ষার সঙ্গে নেশার সংযোগ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন মায়েরা, শিক্ষকরা। কিন্তু গবেষক, নীতি-প্রণেতারা তা উপেক্ষা করে চলেছেন।

অথচ সে সম্পর্কটা স্পষ্ট করা চাই। লড়াইটা তো শুধু গোটাকতক বিপথে যাওয়া মানুষের সঙ্গে নয়। মদের পাইকারি বিক্রেতা স্বয়ং পশ্চিমবঙ্গ সরকার, রাজস্বের এক প্রধান উৎস মদ, আয় বাড়াতে গ্রামে গ্রামে লাইসেন্স বিলি করছে সরকার। যে শিক্ষক বহু বছরের চেষ্টায় চোলাই বিক্রি বন্ধ করেছেন, গ্রামের গুমটিকে মদ বিক্রির সরকারি লাইসেন্স পেতে দেখে তিনিও আজ হাল ছেড়ে দিচ্ছেন। সরকার ব্যবসায় নামার পর এক বছরে ষোলো শতাংশ বেড়েছে বিলিতি মদের বিক্রি।

প্রথম থেকে দশম শ্রেণির মধ্যে প্রায় ছয় লক্ষ শিশু স্কুলছুট হয় এ রাজ্যে। এই সংখ্যা কমছে না। মিনিমাগনা ব্যাগ-বই-জুতো সত্ত্বেও না। তার একটা কারণ, লেখাপড়া না শিখতে পেরে নিচু ক্লাসেই বহু শিশু হারিয়ে যাচ্ছে। তা হলে মদ বিক্রির টাকায় ‘সবুজসাথী’র সাইকেল বিলি করা কেন? গোড়া কেটে আগায় জল দিয়ে লাভ কী?

যে রাজনীতি দাঁড়িয়ে স্কুলশিক্ষার পথ আটকে, তার নেতানেত্রী কি স্থান পেতে পারেন শিশুর পাশে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Child Education School Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE