Advertisement
E-Paper

পুজো এখন বাজারের পণ্য

বাজারের দুটো দিক। এক দিকে বিক্রেতার দল, যারা দ্রব্য ও পরিষেবা উৎপাদন আর বিক্রি করে আর অন্য দিকে আমাদের মতো ক্রেতারা যারা সেগুলো কিনি।

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৬:০০

পুজো এলেই সবার মুখে নানা কারণে আক্ষেপের সুর শোনা যায়, “পুজোর বাজার, এমনটা তো হবেই!” ঠারেঠোরে গালমন্দটা শুনতে হয় যাঁরা আধুনিক অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন তাঁদেরও; যেন, পুজো-বাজারের দাম নির্ধারণ করার দায়িত্বটা তাঁদেরই ছিল। এ কথা ঠিক, বাজার অর্থনীতির সার কথাই হল যে কোনও দ্রব্য বা পরিষেবার হাত-বদল হবে বাজারে তা কেনাবেচার মাধ্যমে, বাজারি মূল্যে। তবে, বাজারই যে সমাজে বিনিময়ের একমাত্র উপায় তা মোটেই নয়; মূল্য না ধরেও সামাজিক বণ্টন অবশ্যই হতে পারে: বামপন্থী সমবায়, যৌথ উপার্জন থেকে শুরু করে আপৎকালীন কোটা বা আবশ্যিক খাদ্যদ্রব্য রেশন, এমন অজস্র অ-বাজারি উদাহরণ অর্থনীতির বইয়ে মিলবে। কিন্তু বাজার এক বিশেষ কারণে অনন্য। অঙ্ক কষে প্রমাণ করা যায়, বাজারি ফল হল ‘এফিশিয়েন্ট’, হিতকর ও কল্যাণময়! কে কতটা উপভোগ করবে তা স্থির করার জন্য বাজারব্যবস্থাকে টেক্কা দেওয়া অসম্ভব।

বাজারের দুটো দিক। এক দিকে বিক্রেতার দল, যারা দ্রব্য ও পরিষেবা উৎপাদন আর বিক্রি করে আর অন্য দিকে আমাদের মতো ক্রেতারা যারা সেগুলো কিনি। আমাদের চাহিদা আর বিক্রেতাদের জোগান অনুযায়ী স্থির হয় বাজারে পণ্য ও পরিষেবার মূল্য, সেই মূল্য জেনেই আপনি-আমি ঠিক করি আমরা কে কে কী কী জিনিস কত পরিমাণে কিনব।

তবে বাজারও ফেল মারতে পারে বইকি; পাঠ্যপুস্তকের পরিভাষায় একে বলে মার্কেট ফেলিয়োর। এই ফেলিয়োর ঘটতে পারে নানান কারণে ও নানাবিধ পরিস্থিতিতে। বাজার ফেল করেছে, এই তাত্ত্বিক কথাটার মানে হল বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে যা ফল পাওয়া গেছে তা এফিশিয়েন্ট নয়— অন্য কোনও ভাবে বণ্টন সম্ভব, যাতে সকলের অবস্থার উন্নতি হবে। তবে, তার জন্য হয়তো দরকার সরকারি হস্তক্ষেপ বা যৌথ উদ্যোগ।

এমনই এক পরিস্থিতি হল, কেনাবেচার জিনিসটাই যদি প্রাইভেট বা ব্যক্তিগত না হয়ে পাবলিক বা সমষ্টিগত হয়। বাজার থেকে আমরা সাধারণত যে সব জিনিস কিনি সেগুলো সব ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য; পুজোর আগে নতুন জামাজুতো থেকে শুরু করে নিজের পুজোর ফুলমালা অবধি সব ব্যক্তিগত পণ্য। এই সব দ্রব্য কেনাবেচার জন্য বাজারের জুড়ি নেই। তবে, এর বাইরেও তো আমরা অনেক কিছু উপভোগ করি, অনেকে মিলে, একসঙ্গে। এ সবের জন্য খরচও করি, হয়তো বা পরোক্ষে; যেমন, রাস্তার ধারের ত্রিফলা আলো অথবা রেডিয়োতে মহালয়ার ভোরের গান। এগুলো হল সমষ্টিগত পণ্য। এই সব জিনিস বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থা কিন্তু বুবুনের অঙ্কের মতোই, ডাহা ফেল। এই সব জিনিসের বণ্টন হওয়া দরকার সরকারের মাধ্যমে, কর আদায় করে অথবা সমবেত ভাবে দান করে বা চাঁদা তুলে।

ব্যক্তিগত থেকে সমষ্টিগত পণ্যকে আলাদা করব কী ভাবে? পাঠ্যপুস্তকের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোনও দ্রব্যের দুটো বৈশিষ্ট্য থাকলে তাকে পাবলিক গুড বলব। প্রথমত, সমষ্টিগত পণ্য ‘নন-রাইভাল’ বা অ-প্রতিদ্বন্দ্বী, আর ব্যক্তিগত পণ্য হল ‘রাইভাল’ বা প্রতিদ্বন্দ্বী। আপনি আপনার ভোগের জন্য কোনও জিনিস কিনলে আমি সেটা আর পাব না। বাজারের সবচেয়ে ভাল ইলিশটা আপনি তুলে নিলে, যত পয়সাই দিই না কেন, আমি তা কিনতে পারব না; ব্যক্তিগত দ্রব্যের এই দ্বন্দ্ব ত্রিফলা আলোর ক্ষেত্রে নেই— আপনি আলোর তলায় দাঁড়িয়ে থাকলেও আমি আলো পাব।

ব্যক্তিগত পণ্যের দু’নম্বর বৈশিষ্ট্য হল, তা ‘এক্সক্লুডেবল’— সংবাদপত্রের পাতায় বিজ্ঞাপনের জন্য আমার কোম্পানিকে বাদ দিয়ে আপনার কোম্পানি চুক্তি করতে পারে; কিন্তু, বেতার তরঙ্গ এ ভাবে কাউকে বাদ দেয় না— আপনি মহালয়া শুনুন, আমিও শুনছি!

সমষ্টিগত পণ্যের উদাহরণ হিসেবে আশ্বিনের দেবীপক্ষে মাথায় আসে শৈশবের সেই পাড়ার পুজোটা, যা আক্ষরিক অর্থেই ছিল সর্বজনীন, এক আদর্শ পাবলিক গুড! অর্থনীতির পাঠ্যে পাবলিক শব্দের অনুবাদ সর্বজনীন হলে বোধকরি তত্ত্বের সংজ্ঞাটা খাপে খাপে মিলত। সর্বজনীন দুর্গোৎসব অ-প্রতিদ্বন্দ্বী তো বটেই— পাড়ার পুজো আপনার পরিবারের জন্য যতটা, আমার জন্যও ততটাই; আর কাউকে বাদ দেওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না, সকলের জন্য অবারিত দ্বার, সকলে মিলেই পুজো।

পাবলিক গুড বলেই সাবেকি এই পুজো চলত বাজারকে সরিয়ে রেখে; পুজো নামক এই দ্রব্য সকলে মিলে উৎপাদন ও উপভোগ করত। আর কেনাবেচার বদলে ছিল সকলে মিলে চাঁদা তুলে ব্যয়ভার বহন করা, ঠিক অর্থনীতির তত্ত্ব মেনেই যেন। সবাই সমান চাঁদা দেবেন না, তবু ফলটা এফিশিয়েন্ট। ক্রয়বিক্রয়, লাভক্ষতি, বিজ্ঞাপন-স্পনসর ছিল না।

সেই শৈশব যেমন আর নেই, তেমনই আমরা হারিয়েছি এক অসামান্য পাবলিক গুডকেও—সর্বজনীন পুজো কবে যেন এক প্রাইভেট গুড হয়ে গেছে। এখন পাড়ায় পাড়ায় বারোয়ারি পুজো এক একটা প্রোডাক্ট, অর্থনীতির সংজ্ঞা মেনে যেন কোনও কোম্পানি দ্বারা উৎপাদিত। বারো জন ইয়ার মিলে তা সরবরাহ করবেন লাভ-ক্ষতি বিবেচনা করেই; বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতারা তাঁদের চাহিদা মেনে কিনবেন। পুজো নামক এই প্রাইভেট গুড তার পর আমাদের কাছে প্রদর্শিত, বিনামূল্যে বিতরিত হবে; আমরা দর্শক হিসেবে উপভোগ করব, আমাদের সময়ের মূল্যের বিনিময়ে।

এ এক অন্য পুজো— নামেই এখনও সর্বজনীন, আদতে বাজারি। পুজোর বাজার। মার্কেট ইকনমি।

ব্রিটেনে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

Durga puja Market product
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy