Advertisement
E-Paper

জলাভূমিই যাঁর চারণক্ষেত্র

শুরু প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে। ১৯৮১ সালে রাজ্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হঠাৎ খেয়াল হল যে শহর থেকে প্রতি দিন যে লক্ষ লক্ষ লিটারে ময়লা জল বেরোচ্ছে, তা যাচ্ছে কোথায়? কারণ কলকাতায় ময়লা জল পরিশোধনের জন্য কোনও ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই।

জয়ন্ত বসু

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০৬:১০

প্রায় দু’দশক আগের কথা। হাওড়ায় কাঁচা রাস্তায় লাফাতে লাফাতে চলেছে সরকারি সাদা অ্যাম্বাসাডর, গাড়িতে বসে প্রবল উত্সাহে তিনি আমায় বোঝাচ্ছেন, কী ভাবে পূর্ব কলকাতার জলাভূমির মডেলকে ব্যবহার করে এখানেও ময়লা জল প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোধন করিয়ে পুনর্ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছেন, “আমি এখানে লাস্ট কয়েক মাস নিয়মিত আসছি, দেখি কিছু করা যায় কি না?”

তিনি, ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ, এক জন প্রাক্তন সরকারি আধিকারিক, কিন্তু তার থেকেও অনেক বেশি পরিবেশ বিশেষজ্ঞ, প্রশিক্ষণগত পরিচয়ে ইকলজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এবং পূর্ব কলকাতার জলাভূমি নিয়ে কাজ করার সূত্রে বিশ্ববন্দিত ও আন্তর্জাতিক একাধিক পুরস্কারে পুরস্কৃত। ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ সুনীতা নারায়ণের এসএমএস: ‘ভেরি স্যাড, অ্যামেজিং ম্যান’। সত্যি এক জন আশ্চর্য মানুষ, যিনি সারা জীবন ধরে তত্ত্ব আর বাস্তবকে জুড়তে চেয়েছেন, খুঁজে ফিরেছেন— কিছু করা যায় কি না, এবং সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চেনা ছকের অনেক বাইরে। একমাত্র সম্বল প্রবল ইচ্ছাশক্তি, আর সঙ্গে প্রবলতর মেধার সংমিশ্রণ। পূর্ব কলকাতার জলাভূমি তাঁর প্রধান চারণক্ষেত্র হলেও, কখনও কাঁচড়াপাড়ায় সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে আবর্জনা নিয়ন্ত্রণে নতুন মডেল তৈরি করা, কখনও প্রত্যন্ত অঞ্চলের মহিলাদের দিয়ে অল্প খরচে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরি করিয়ে তাঁদেরই ব্যবহার করতে উত্সাহ দেওয়া, এমন অন্য রকম কাজেরই পথিকৃৎ ধ্রুবজ্যোতিবাবু।

শুরু প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে। ১৯৮১ সালে রাজ্য সরকারের কর্তাব্যক্তিদের হঠাৎ খেয়াল হল যে শহর থেকে প্রতি দিন যে লক্ষ লক্ষ লিটারে ময়লা জল বেরোচ্ছে, তা যাচ্ছে কোথায়? কারণ কলকাতায় ময়লা জল পরিশোধনের জন্য কোনও ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই। এই রহস্য উদ্ধার করতে গিয়ে ধ্রুবজ্যোতিবাবু এক লুকনো রত্নের সন্ধান পেলেন, যা ওঁর বাকি জীবনটাকেই পালটে দিল, খানিকটা কলকাতার ভবিষ্যৎকেও। ওঁর কথায়, “তখন তো বিশেষ রাস্তাটাস্তা নেই, কোনও ক্রমে ময়লা জল যাওয়ার নালা ধরে ধরে পৌঁছে দেখি এক অদ্ভুত ম্যাজিক। সাধারণ মানুষ দেখালেন কী ভাবে তাঁরা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে নিজে থেকে শোধিত হওয়া শহর থেকে বেরোনো ময়লা জল ব্যবহার করে ধান, সবজি আর মাছ চাষ করছেন।” ধ্রুবজ্যোতিবাবু বুঝে গেলেন যে কলকাতা শহরের বাঁচা-মরার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জুড়ে আছে শহরের পূর্ব দিকে থাকা ১২৫০০ হেক্টর বিস্তৃত এই জলাভূমির ভবিষ্যৎ, যা শুধুমাত্র প্রতি দিন শহর থেকে নিষ্কাশিত হওয়া প্রায় ৭৫০ মিলিয়ন লিটার ময়লা জলকেই প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পরিশোধন করে না, সেই জল ব্যবহার করে এই অঞ্চলে থাকা হাজার হাজার কৃষিজীবী ও জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন।’’

তিনি আরও শোনালেন, “আসলে কলকাতা হল পরিবেশের অপার দাক্ষিণ্য পাওয়া শহর, যার এক দিকে গঙ্গা নদী, যেখান থেকে আমাদের পানীয় জল আসে, অন্য দিকে পূর্ব কলকাতার বিশাল জলাভূমি, যা কিডনির মতো শহরের যাবতীয় ময়লা জল বিনা খরচে শোধন করছে ও শোধিত জলে মাছ, সবজি চাষ হচ্ছে; আর মাটির তলায় জলের ভাণ্ডার। আমরা বড়লোকের বাউন্ডুলে ছেলের মতো সেই সুবিধা হেলায় হারাচ্ছি।”

দ্রুত ধ্রুবজ্যোতিবাবু ও পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সমার্থক হয়ে উঠল। কিন্তু বাদ সাধল তত্কালীন সরকার। উন্নয়নের গাজর ঝুলিয়ে জলাভূমি বুজিয়ে নানা প্রকল্পের পরিকল্পনা হতে শুরু করল, প্রমাদ গুনলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবু। ফলে নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ‘পাবলিক’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যখন পূর্ব কলকাতা জলাভূমি বাঁচাতে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করল, তখন— সরকারি আধিকারিক হওয়া সত্ত্বেও— পিছন থেকে যাবতীয় সহায়তা করেছিলেন ধ্রুবজ্যোতিবাবুই। “যে ম্যাপের ভিত্তিতে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির ১২৫০০ হেক্টর সংরক্ষিত বলে নির্দেশ দিয়েছিল হাই কোর্ট, এখানে জমির চরিত্র পালটানো বা নির্মাণ কার্য করা যাবে না বলে আদেশ দিয়েছিল, সেই ম্যাপ তো আমিই তৈরি করে দিয়েছিলাম গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে”— বলেছিলেন পরিবেশ আর মানুষের সঙ্গে জুড়ে যাওয়া বিশেষজ্ঞ। আসলে আরও অনেক পরিবেশবিদের মতো মানুষকে বাদ দিয়ে পরিবেশ রক্ষার কথা ভাবেননি এক সময় বামপন্থী রাজনীতি করা ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ। এক বার জলাভূমি অঞ্চলের এক কৃষিজীবীর মৃত্যুতে বলেছিলেন, “জানো, এরা মারা যাওয়া মানে পূর্ব কলকাতা জলাভূমির এক একটা চ্যাপ্টার চিরদিনের মতো হারিয়ে যাওয়া।”

আর সেই চিন্তার সুবাদেই পূর্ব কলকাতা জলাভূমির জন্য আন্তর্জাতিক রামসার তকমা আনতে পেরেছিলেন ২০০২ সালে। কিন্তু পরের প্রায় দেড় দশক আদালতের নির্দেশ অমান্য করে চলে জলাভূমিকে নষ্ট করার ইতিহাস। এখনও এক প্রকার রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক আধিকারিক ও জমি লুটেরা নেমে পড়েছে জলাভূমি বুজিয়ে উন্নয়ন করতে। সেই চেষ্টাতেও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি।

জীবনের শেষের দিকে একটি লেখায় নিজেকে তকমা দিয়েছিলেন ‘ব্যর্থ প্রকৃতিবিদ’ বলে। কিন্তু ধ্রুবজ্যোতি ঘোষরা ব্যর্থ হতে পারেন না। ব্যাটনটা রাজ্যের পরিবেশবিদদের হাতে দিয়ে একটি প্রস্তাব রাখতে ইচ্ছা করছে: পূর্ব কলকাতা জলাভূমির নামকে বর্ধিত করে কি ‘ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ পূর্ব কলকাতা জলাভূমি’ রাখা যায় না? তা হলে হয়তো গড়পড়তা কলকাতাবাসী জানতে পারবে যে শিরোনামের বাইরে থাকা এই মানুষটা প্রায় সারা জীবন জুড়ে আমাদের শহরটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গিয়েছেন।

Dhrubajyoti Ghosh East Kolkata Wetlands Ecologist
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy