Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Higher Secondary

তা হলে এত নম্বর কেন!

লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রী মজা করে বলেছেন যে তাঁদের সময়কার প্রথম-দ্বিতীয়দের নম্বর শুনলে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে।

ফল বেরোনোর পর

ফল বেরোনোর পর

রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

পরীক্ষার ফল বেরোনোর পরের দিন একটি ছেলে আত্মহত্যা করেছে। তা হলে নিশ্চয়ই সে ফেল করেছিল। আসল ঘটনাটা হল সে খুব ভাল ভাবে পাশ করেছিল, কিন্তু আর পড়া হবে না এই দুঃখে যে মরে যেতে চেয়েছে। গল্পের নাম ‘পাশফেল’; লেখক— মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এক কালে উচ্চ মাধ্যমিকের পাঠ্যক্রমে এই গল্প পড়তে হত। এক দিকে যাদবপুরে প্রবেশিকা পরীক্ষার দাবিতে আন্দোলন, অন্য দিকে অম্লান সরকারের আত্মহত্যা আমাদের আবার সেই গল্পের কাছে নিয়ে গেল। কেন, তা বুঝতে গেলে দুটো দশক পিছিয়ে যেতে হবে।

আমরা যাঁরা আশি-নব্বইয়ের দশকের মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের কথা মনে করতে পারি, তাঁদের কাছে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল নম্বর সঙ্কোচনের মাধ্যম। মাধ্যমিকের ৮০-৮৫% পাওয়া ছেলেমেয়ের টেনেটুনে ৬০% কী আরও কম পাওয়া সে কালে খুব সাধারণ ঘটনা ছিল। ৬০% মানে মোটামুটি ভাল নম্বর আর ৭৫-৮০% পাওয়াটা ছিল আশ্চর্য সাফল্য। সুতরা়ং মাধ্যমিকে কেউ ভাল নম্বর পেলে উচ্চ মাধ্যমিক নামক অগ্নিপরীক্ষার দিকে সবাই তাকিয়ে থাকতেন। তুলনায় আইএসসি বা সিবিএসই-তে (তখন বলা হত দিল্লি বোর্ড) তখনও গড়ে নম্বর অনেক বেশি উঠত আর তাই নিয়ে নানা রকম জটিলতার সৃষ্টি হত। তবে এ সবই মূলত বিজ্ঞান বিভাগের কথা, মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেলেই ‘সায়েন্স নেওয়ার’ দৌড় আর পরবর্তী অধঃপতন কিংবা চোখ ধাঁধানো ফলাফল করে শীর্ষে উঠে আসা ছিল বিজ্ঞানের একচেটিয়া। কলাবিভাগে এত নাটকীয়তার সুযোগ ছিল না, ইংরেজিটা আয়ত্তে থাকলে ভাল ভাবেই পাশ করা যেত, কিন্তু ‘আর্টস’-এ নম্বর কম ওঠে বলে অর্থাৎ প্রত্যাশা কম থাকায় তেমন কিছু আলোড়ন ঘটত না। যদিও ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান এবং বাংলা-ইংরেজি কোনওটাতেই খুব বেশি নম্বর পাওয়ার উদাহরণ ছিল বিরল।

উচ্চ মাধ্যমিকে এই ধারাবাহিক খারাপ ফলাফলের পিছনে কারণ ছিল অনেক। একাদশ-দ্বাদশ মিলিয়ে বিশাল সিলেবাস, অল্প সময়, কঠিন প্রশ্নপত্র আর সেই সঙ্গে মূল্যায়নের যে পদ্ধতি চালু ছিল তাকে ‘মার্কস কনস্টিপেশন’ বললে বোধ হয় সঠিক বলা হয়। আর এখন? উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে এই বছর চমকের ছড়াছড়ি। সিবিএসই দ্বাদশ আর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার শীর্ষে এসেছে কলাবিভাগের দু’জন ছাত্রছাত্রী যারা বেশির ভাগ বিষয়ে একশোয় একশো পেয়েছে। লেখিকা অনিতা অগ্নিহোত্রী মজা করে বলেছেন যে তাঁদের সময়কার প্রথম-দ্বিতীয়দের নম্বর শুনলে এখনকার ছেলেমেয়েরা হাসবে।

ছাত্রের মূল্যায়ন মানে সে কতটা জানে সেটা বুঝতে পারা। যে পদ্ধতি বেশির ভাগ ছাত্রকে ‘জানে না’ হিসেবে চিহ্নিত করে, তা কতটা যথাযথ এবং ভরসাযোগ্য সেটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা নিশ্চয়ই হয়েছিল, তাই দেরিতে হলেও, দু’দশক পরে ছবিটায় বদল হল। নম্বর পাওয়া সহজ হতে লাগল। তার পর শুধু দ্বাদশের পাঠ্য নিয়েই পরীক্ষা চালু হওয়ার পর থেকে নম্বর পাওয়ার হার বেড়েই চলেছে। আর এই বাড়বৃদ্ধি শুধু বিজ্ঞানে নয় কলা ও বাণিজ্যবিভাগেও ঘটেছে। তাই সিবিএসই কিংবা আইসিএসই-র সঙ্গে পাল্লা দেওয়াই নয়, কলা বা বাণিজ্যবিভাগে কম নম্বর ওঠার ‘মিথ’ও ভেঙে চুরমার হয়েছে। মাধ্যমিকের ভাল ছাত্ররা বিজ্ঞান ছাড়াও অন্য কিছু পড়ছে, এবং প্রথম-দ্বিতীয় হচ্ছে, যেটা খুবই ভাল কথা।

কিন্তু নম্বর নামক মাপকাঠিটার ওপর কি ভরসা বেড়েছে? নাহ্‌। কারণ, নম্বর একটা বিষয় যা একটা সীমা অবধি ছাত্র জানে কি না তার বিচার করে এবং তার ওপর গিয়ে কতটা জানে তার আপেক্ষিক মূল্যায়ন করে। ফার্স্ট ডিভিশন বা ৬০% নম্বর পাওয়াকে যদি ‘জানা’ বলে ধরা হয় তা হলে তার চেয়ে ওপরের ধাপগুলো মানে ৭৫%-৮০%-৯০% ইত্যাদি আরও বিস্তৃত বা গভীর ভাবে জানা বোঝানো উচিত। কিন্তু কোনও মূল্যায়ন পদ্ধতির ঘোষিত উদ্দেশ্য যদি হয় ‘ঢালাও নম্বর দেওয়া’ (সৌজন্য শিক্ষামন্ত্রী) যা একটা বিরাট সংখ্যক ছাত্রকে বিভিন্ন বিষয়ে ওই ৯০% পাওয়া ধাপে পৌঁছে দেয় তা হলে এই আপেক্ষিক মূল্যায়নটা আর হয় না। অর্থাৎ যথাসাধ্য ভালর সঙ্গে ‘আরও ভাল’র আর কোনও তফাত থাকে না। এইটাই এখন ফলাফলে দেখা যাচ্ছে। মোটামুটি পড়াশোনা করলেই ৮০-৮৫%-এর ওপর নম্বর পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ সেটাই দাঁড়াচ্ছে ‘জানা’র স্বীকৃতি। কিন্তু তার ওপরে মাত্র ১৫-২০ নম্বর, তার মধ্যে আপেক্ষিক মূল্যায়নের ধাপগুলো ঠিক ভাবে চিনে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আগেকার অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে এখনকার অবস্থাটাকে ‘মার্কস দূষণ’ বলা যাবে না কি ‘মার্কস লুজ় মোশন’ বলা হবে সেটাই চিন্তার।

তার ফলে প্রথমত কোনও বিষয়ে কেউ ৮৫ বা ৯০ পেলেও জোর গলায় বলা যাচ্ছে না যে সে বিষয়টা খুব ভাল জানে। মোটামুটি ভাল আর খুব ভালর মধ্যে তফাত থাকছে মাত্র ৫ নম্বরের। সেই নম্বরের মধ্যেও অসংখ্য ছাত্র পাওয়া যাচ্ছে। সাহিত্য বিষয়ে ৯৫-১০০% নম্বর যারা পাচ্ছে তারাও অনেকেই যখন সাহিত্য নিয়ে পরে পড়ছে না, তখন বলতেই হয় শুধুমাত্র নম্বর আর বিশেষ ব্যুৎপত্তি বা গভীর আগ্রহের দিক নির্দেশ করছে না।

যাদবপুরে প্রবেশিকা পরীক্ষার দাবিতে যে আন্দোলন হচ্ছে, তাকে এ দিক দিয়েও বুঝতে হবে আমাদের। আর দ্বিতীয় কথাটাও মনে রাখতে হবে। এক সময় কম নম্বর পেয়ে যা যা হত, মানে ভাল কলেজে ভর্তি হতে না পারা, পছন্দের বিষয় না পাওয়া, আজ কিন্তু বেশি নম্বর পেয়েও সেই সবই হচ্ছে আর সেই গোলমালের ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়ছে নানা রকম বেনোজল, যার একটা ফল হল টাকা দিয়ে কলেজে ঢোকা, যা গত কয়েক বছরে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।

অম্লান সরকার ৭৯ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল। তবু সে স্বাভাবিক নিয়মে নিজের পছন্দমতো কোনও কলেজে ভর্তি হতে পারেনি। তা হলে এখনকার ছেলেমেয়েদের মার্কশিটে এত নম্বর কেন?

ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের শিক্ষিকা

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Higher Secondary Marks Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE